মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সমাজ ও সভ্যতা বাঁচাতে মনুষ্যত্বের বিকাশ অপরিহার্য

মো. আমিনুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

মানুষ পৃথিবীতে অন্যদের মতো শুধু প্রাণী নয়। কিছু মানবীয় বৈশিষ্ট্য তাকে তাবৎ প্রাণীক‚ল থেকে আলাদা করেছে। মানুষের যেমন আছে জৈবিক বা বস্তুগত দিক, তেমনি রয়েছে নৈতিক দিক। মানুষের মধ্যে ক্ষুধা, বিশ্রাম, কাম-ক্রোধ, লোভ-লালসা, চাওয়া-পাওয়া, কামনা-বাসনা প্রবৃত্তি সক্রিয়। অপরদিকে ধৈর্য্য, উদারতা, ক্ষমা, মহত্ব, প্রেম-ভালবাসা, মহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি মহৎ নৈতিক গুনাবলীও মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। মানুষ অধিকমাত্রায় আত্মা সর্বস্ব। মানুষ ভাল ও মন্দের পার্থক্য করতে পারে। প্রাণীদের নৈতিক সত্ত্বা অনুপস্থিত। মানুষের স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার ইখতিয়ার আছে। অন্যান্য প্রাণী থেকে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এমন মর্যাদার পরও মানুষ যখন শুধু কু-প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ে তখন তার অবস্থা বন্যপ্রাণীদের চেয়ে নিম্ন স্তরে পর্যবসিত হয়। মনুষত্ব বলে কিছু থাকে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে সর্বোত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছি, অতপর (তাদের কতককে তার স্বভাবদোষে) সর্ব নিন্মে পতিত করেছি।’ সূরা ত্বীন, আয়াত: ৪-৫। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘তাদের রয়েছে অন্তর, কিন্তু তা দিয়ে তারা অনুভব করে না, তাদের চক্ষু রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা দেখে না, তাদের কর্ণ রয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না, তারা হলো পশুর ন্যায় বরং তা অপেক্ষাও অধিক অধম।’ সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৭৯।
তদুপরি আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন অতিমূল্যবান নেয়ামত জ্ঞান- যার দ্বারা মানুষ বোঝে, চিন্তা করে, উপলব্ধি করে ও কথা বলে। এই জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ আল্লাহকে চিনতে পারে। মানুষের চোখ, কান, নাক, জিহবা তথা পঞ্চ ইন্দ্রিয় জ্ঞান অর্জনের প্রথম মাধ্যম। আকল বা বিবেক জ্ঞান অর্জনে দ্বিতীয় মাধ্যম। আর অহীয়ে ইলাহী জ্ঞান অর্জনে স্বচ্ছ ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। অন্যদিকে বিদ্যা- যা মানুষকে বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কবি ও সাহিত্যিক তৈরী করে। বিদ্যাই মানুষকে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি বানায়। যাদের থেকে উপকৃত হয় সারাবিশ্বের মানুষ।
মানুষের নৈতিক সত্ত্বা বা গুণাবলীর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে মানবসমাজ। মানুষের জৈবিক আকৃতি ও গঠন নয় বরং নৈতিক সত্ত্বাই মানুষকে মনুষ্যত্বের চেতনায় রূপান্তরিত করে। মানুষকে প্রকৃত মানুষ বানায়। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘শপথ মানুষের এবং তার যিনি তাঁকে সুঠাম করেছেন। অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সেই সফলকাম হবে যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে এবং সেই ব্যর্থ মনোরথ হবে যে নিজেকে কুলষিত করবে।’ সুরা আস-শামছ আয়াত ৭-১০। নৈতিক সত্ত্বার পরিপূর্ণতার মধ্যেই মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য নির্ভরশীল ।
পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে কিন্তু সৎ মানুষ বাড়ছে না। শিক্ষিতের হার বাড়ছে, সুশিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে না। আইন বেড়েছে, অপরাধ কমেনি। দেহের সৌন্দর্য্য বাড়লেও চরিত্রের সৌকর্য বাড়েনি। শিক্ষক বেড়েছে, শিক্ষকদের নীতিবোধ বাড়েনি নেতার সংখ্যা বাড়লেও নীতিবানের সংখ্যা বাড়েনি। সমাজে মানুষ থাকলেও মনুষ্যত্ব আজ নিম্নগামী। আজ আমরা নৈতিকতার উন্নতির চেয়ে বস্তু সত্ত্বা ও প্রবৃত্তির উৎকর্ষতার জন্য বেশী ব্যস্ত। গুম, খুন, হত্যা, সন্ত্রাস, লুটপাট, চাঁদাবাজি চলছে অবলীলায়। দশ টাকার জন্য মানুষ খুন হয়। বাবা-মা সন্তান হত্যা করছে, সদ্য প্রসূত শিশুকে ডাস্টবিনে ফেলছে । শিশুরা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রেমিক সেজে বান্ধবীকে পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা ও লাশ টুকরা টুকরা করতেও কুন্ঠাবোধ করছেনা। জুয়ার ব্যবসা বসিয়ে হচ্ছে ক্যাসিনো কিং। মাদকের নেশায় ঘটছে রুচি বিবর্জিত সব জঘন্য অপরাধ। বিল্ডিং-এ রড এর পরিবর্তে দিচ্ছে বাঁশ। শেয়ার বাজার, ব্যাংক, কয়লা, পর্দা, বালিশ, টিন, বই ইত্যাদি নিয়ে ঘটছে কলঙ্কজনক কান্ড। মানুষ্যত্ব ও নৈকিতকতা আজ দুর্বৃত্তায়নে বন্দি। অথচ কুকুর প্রশিক্ষিত হয়ে গোয়েন্দার কাজ করছে, টিয়া পাখি মানুষের মত কথা বলছে, ডলফিন বিভিন্ন কসরত দেখিয়ে নৃত্য করছে, জঙ্গলের গাছ হচ্ছে সুসজ্জিত আসবাবপত্র। অথচ মানুষের অধঃপতন হচ্ছে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে অমানুষের মতো কাজ করছে, যা পশুবৃত্তির চেয়ে ভয়ংকর। মানুষের অন্তর যেন মরে যাচ্ছে, লোহার মত মনুষ্যত্বের উপর মরিচা ধরছে।
মুক্তির জন্য দরকার মনুষত্বের বিকাশ। নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং মানুষের বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা। মনুষত্বের পরিপুষ্টি দরকার। দরকার সুশিক্ষা। কোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমানবিক হামলা কিংবা ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করলেই যথেষ্ট। এতে কুশিক্ষায় শিক্ষিত ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে, ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা দালান কোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হবে । বিচারকদের হাতে বিচার ভুলুণ্ঠিত হবে। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার মানে হলো একটি জাতির অবলুপ্তি এবং দুর্নীতির মহোৎসব ও দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি চালুর শাশিল। মনুষত্ব বিকাশের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুশিক্ষা ও আদর্শ নির্ভর নৈকিত শিক্ষা দরকার।
আল্লাহর ভয় মানুষকে অবক্ষয় থেকে মুক্ত করে মনুষত্বের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করতে থাক, তাহলে তিনি তোমাদের অন্তরে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করার মাপকাঠি দান করবেন। তিনি তোমাদের ক্ষমা করে দেবেন।’ সুরা আল আনফাল, আয়াত : ২৯। আল্লাহকে ভয় করা ফরজ। আল্লাহর ভয় মানুষকে সবসময় খারাপ থেকে ফিরিয়ে রাখে। গুনাহ থেকে বিরত রাখে।
মনুষত্ব বিকাশে আখেরাতের ভয় জরুরী। পরকালের চিন্তা যদি মানুষের অন্তর ও হৃদয়ে পরিপূর্ণ রূপে স্থির হয়ে যায়, তাহলে সে আর অন্যায় কাজে হাত বাড়াবে না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দান কর অথচ আখেরাতের জীবনটাই হলো উত্তম ও চিরস্থায়ী।’ সুরা আল-আলা, আয়াত : ১৬-১৭। মৃত্যুর স্মরন পাপ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের পরিচয় লাভ করেছে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কাজ করেছে।’ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ১৬৫০১। মৃত্যুই মানুষের জীবনে শেষ নয়। ফলে আমাদের সবার উচিত আখেরাতের প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া।
প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ পাপ কাজে লিপ্ত হয়। কুপ্রবৃত্তি মানুষকে অন্যায় কাজে ধাবিত করে, মানুষত্বকে পরাজিত করে তাকে কুপ্রবৃত্তির দাস বানায়। সুকুমার বৃত্তির জন্য তাই কুপ্রবৃত্তির দমন দরকার। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করবে ও নিজের প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিরত থাকবে। অবশ্যই জান্নাত হবে তার ঠিকানা।’ সুরা আন-নাযেয়াত, আয়াত: ৪০-৪১। রাসুল (সাঃ) বলেন, ‘সেই লোক প্রকৃত মুজাহিদ যে নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে।’ আত-তীরমিযি: হাদীস: ১৫৪৬। এভাবে কুপ্রবৃত্তিকে আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত বানিয়ে আমাদের উচিত।
মনুষ্যত্বের বিকাশের জন্য চাই আত্মপর্যালোচনা। ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্য ছুটছি, না অনন্ত জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করছি-এ চিন্তা করতে হবে। রাসুলে করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমাকে হিসাবের জন্য ধরার আগেই তুমি নিজের হিসাবটা নিয়ে নাও।’ আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি অণুপরিমান ভাল কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে। আর যে অণুপরিমান মন্দ কাজ করবে, তাও সে দেখবে পাবে।’ সুরা যিলযাল, আয়াত: ৭-৮। ভাল ও মন্দ সব কাজই সামনে আসবে। আত্মপর্যালোচনাই পাপ বর্জনে সহায়তা করে।
সুসংস্কৃতি মনুষ্যত্ব বিকাশের ভিত্তি স্বরূপ। নৈতিক চরিত্র গঠনে সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, গানের সুস্থ্য সংস্কৃতি ভ‚মিকা রাখে। মানুষের চিন্তা, কল্পনা, আচার-ব্যবহার, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজকর্ম, সভ্যতা সবই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হতে হবে সমাজের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাসবোধে উজ্জীবিত, মানব কল্যাণধর্মী ও অশ্লীলতা মুক্ত। আমাদের সংস্কৃতি বোধ করি এগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে না। ফলে অপসংস্কৃতি আমাদের বিবেকবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মনুষ্যত্ব বিকাশে সমাজে সুস্থ্যসংস্কৃতির চর্চা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের বিবেক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আদালত। কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মনুষত্ব বা বিবেকবোধ অথবা নৈতিক চরিত্র প্রতিটি মানুষের অভ্যন্তরে একটি আদালত বা বিচার ব্যবস্থা হিসাবে কাজ করে। বিবেক স্বতঃস্ফুর্তভাবে ভিতর থেকে মানুষকে মনুষ্যত্বের পথে পরিচালিত করে। অন্যায় ও অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই ব্যক্তিকে সাবধান করে। যা বাহ্যিক আদালত বা প্রশাসন করতে পারেনা। অন্যায় ঘটার পর বাহ্যিক আদালতে বিচার হয়। যা আজকাল খুব কার্যকর মনে হচ্ছে না। বাহ্যিক আদালতে অনেক সময় দুষ্টের পালন ও শিষ্টের দমন, মিথ্যা স্বাক্ষী অথবা দলীল প্রমাণের অভাবে রাঘব বোয়ালরা ছাড়া পেয়ে যায়। অবিচার ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়। কিন্তু মনের আদালত বা বিবেককে কেউ পয়সা দিয়ে কিনতে পারে না। আর যত মানুষ ততটি আদালত হওয়ায় দ্রæত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। পশুবৃত্তি, পাশবিকতা, কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষ হয় পরিশুদ্ধ এবং সামাজ-জগৎ হয় নির্মল। ফলে মনুষ্যত্বের জন্য আমাদের বিবেক নামক আদালতকে শক্তিশালী করা দরকার। নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের বিশ্বাসবোধ ধ্বংস হলে মানুষ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব বিনাশ হতে বাধ্য। বস্তুত তার আলামত এখন দেখা যাচ্ছে। মানুষের এই সুকুমারবৃত্তি বিকাশের জন্য দেশে ও বিদেশে আন্দোলন দরকার। রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, প্রশাসন যন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা, আইনসভা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সর্বত্র দরকার এগুলোর লালন ও প্রতিপালন। দরকার ভাল মানুষের উদ্যোগ, অন্যথায় মানব সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য। কারণ অসৎ লোকদের কর্মকান্ডে সমাজ ধ্বংস হয় না, সমাজ ধ্বংস হয় সৎ লোকদের নিরবতায়।
লেখক : এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, আইবিবিএল।
aminurrahman1964@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন