কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা অবিভক্ত ঢাকা মহানগরীর সর্বশেষ নির্বাচিত মেয়র বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা আর নেই। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটান শ্লোয়ান ক্যাটারিং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর দেড়টায় ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। দলমত নির্বিশেষে সর্ব মহল তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লড়াকু নেতা সাদেক হোসেন খোকা বিএনপির প্রথম সারির নেতা ও ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ায় আওয়ামী লীগের এ দাবির অসত্যতা প্রমাণিত হয় যে, আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র সমর্থক রাজনৈতিক সংগঠন। কারণ শুধু সাদেক হোসেন খোকাই নন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানও স্বয়ং অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সীমাহীন জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে যারাই আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে যান, তাদেরই তিনি যত দ্রুত সম্ভব ভারতে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। পক্ষান্তরে তিনি স্বয়ং তাঁর বাসভবনে অবস্থান করে স্বেচ্ছায় পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধরা দিয়ে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ কালে পাকিস্তানে কারাবন্দি থাকেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অতঃপর সেক্টর কমান্ডার হিসাবে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং খ্যাতিলাভ করেন।
একাত্তরের সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শ মোতাবেক আওয়ামী লীগ সমর্থক ও কর্মীরা ভারতে পালিয়ে গিয়ে নিরাপদে অবস্থান করতে পারলেও জিয়াউর রহমান স্বয়ং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই বাস্তবতার স্বীকৃতি স্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী কালে স্বাধীন বাংলাদেশের কিংবদন্তি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলেই জিয়াউর রহমানকে একাধিকবার পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানে পরিণত করা হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে যারা খবর রাখেন তারা সাক্ষ্য দেবেন, পাকিস্তান আমলে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধার কারণে গণতন্ত্র বাস্তবে কখনও রূপায়িত হতে পারেনি। এজন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যই ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের জন্য যে চারটি মূলনীতি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে তা ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ।
দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে প্রথম সরকারের আমলেই সমস্ত রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একমাত্র সরকারি দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর বেশকিছু দুঃখজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ওই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা।
এর প্রধান কারণ এই ছিল যে, উৎখাত হওয়া ওই নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল রাজনীতি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ স্বৈরশাসন। পাশাপাশি শুরু হয় বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ এসব আন্দোলন থেকে বহু দিন দূরে থাকায় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে রাজনীতিতে নবাগতা বেগম খালেদা জিয়া আপোসহীন নেত্রী হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে উঠলে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগও যোগ দেয়। আরও পরবর্তীকালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে উঠলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি সাধারণ নির্বাচনের প্রশ্নে একমত হয়। দেশের এই দুই প্রধান দল একমত হয় যে, নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য নির্বাচন পরিচালিত হবে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। যেমনটা আশা করা গিয়েছিল নির্বাচন তেমনই অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে বলেন, আমি সকল জেলায় খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আপনারা লক্ষ রাখবেন, ভোটে হেরে গিয়ে এর মধ্যে কেউ যেন আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে। ভোট গণনা শেষে যখন জানা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি। অবলীলাক্রমে তিনি তখন বলে ফেললেন, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কেউ গুরুত্ব না দেওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলো। শেখ হাসিনা হলেন সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষে প্রধানত বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, এই মর্মে সংবিধান সংশোধিত করা হলো। এই ব্যবস্থায়ই যে বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের জন্য সব চাইতে অনুকূল তা বাস্তবে প্রমাণিত হয়। ফলে দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশ চালনার সুযোগ লাভ করে। দুঃখের বিষয়, কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা ক্ষুধার কারণে এই সুন্দর ব্যবস্থাকেও পচিয়ে ফেলা হয়।
এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংবিধান পুনঃ সংশোধন করে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় আনা হয়নি। তদুপরি এই দেশের অন্যতম প্রধান দলের সঙ্গে আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে যে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাও লংঘিত হয়। বিএনপি নতুন ব্যবস্থার প্রতিবাদে নির্বাচন বয়কট করে। ফলে নির্বাচন হয়ে পড়ে একটি নির্বাচনী প্রহসন।
এ নির্বাচন দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি বর্জন-বয়কট করায় হয়ে পড়ে অর্থহীন। এমতাবস্থায় বিএনপি নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগে শাসকদল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই তাদের প্রার্থীদের ব্যালট পত্রে বেশি বেশি সিল মেরে শাসক দলের প্রার্থীদের অকল্পনীয় অধিকভোটে বিজয়ী হওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে।
এ নির্বাচনে শুধু বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীরাই বর্জন করেনি, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীও ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। কারণ, তারা জানতেন, তারা না গেলেও দলের পক্ষ থেকে তাদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। দেশের অধিকাংশ ভোটার এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় জনগণ এ নির্বাচনকে নাম দিয়েছিল ভোটারহীন নির্বাচন।
এভাবে ভোটারবিহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা দেশে চালু হওয়ার পর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ব্যবস্থার অপমৃত্যু ঘটে, যা অদ্যাবধি চালু রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরীক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে এর স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তিনি বলেন, জনগণ ভোট দেয়নি, আমরা ঠিকই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। পরে অবশ্য তিনি সরকারের চাপের মুখে তাঁর বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন।
যে সরকার এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, তা একটি ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার। তার ফলেই এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপির কোনো নেতার আগ্রহ নেই। শুধু তাই নয়, বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে নিয়মিত। এ ধরনের মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে বিএনপির অন্যতম নেতা ও ভাইস চেয়ারম্যান ঢাকার সাবেক নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সেখানেই ইন্তেকাল করেন।
অপরপক্ষে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলার অজুহাতে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাঁকে জামিনে মুক্তি দিয়ে বিদেশে সুচিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তাই জনগণের মনে প্রশ্ন জাগছে, বিদেশে গিয়ে সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুবরণের পর বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার পরও তাঁকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে বা দেশে তাঁর পছন্দ মোতাবেক সুচিৎসার সুযোগ দিতে অস্বীকার করার অর্থ কী তাকে মৃত্যুর মুখে সপে দিয়ে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা?
দেশের জনগণ বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে মুক্তি দিয়ে সুচিকিৎসার প্রশ্নে সরকারের দৃঢ় অসম্মতির মধ্যে কিন্তু এরকমটাই সন্দেহ করছেন। সেরকমটা বাস্তবে সত্য প্রমাণিত হলে দেশের জনগণ কিন্তু কিছুতেই বর্তমান সরকারকে ক্ষমা করবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন