বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার সমুদ্র উপকূলীয় বিশাল অঞ্চলজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মনে অজানা ভয়ভীতি শঙ্কা আর আতঙ্ক। শঙ্কার কারণ সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়। উড়ে আসছে আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। গতকাল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় ‘বুলবুল’ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। সমুদ্রে ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় একশ’ কিলোমিটার। গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী এটি ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করছে। ‘বুলবুল’ আগামী ১০ অথবা ১১ নভেম্বর (রোববার কিংবা সোমবার) বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-ওডিশা উপকূল অতিক্রম করতে পারে। বহুল পরিচিত ছোট্ট একটি পাখির নাম ‘বুলবুল’। যা এদেশে বুলবুলি, বুলবুল, পাপিয়া নামে পরিচিত। ‘বুলবুল’ শব্দটি মূলত আরবি-ফারসি ভাষা থেকে আগত। বাংলা ভাষায়ও এটি বহুল ব্যবহৃত।
‘বুলবুল’র শক্তি সঞ্চয় যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ১০ নভেম্বর রোববার বঙ্গোসাগরে অবস্থানকালে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’র গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কি.মি. এমনকি ১৩৫ কিলোমিটারে উঠতে পারে। দেরিতে যদি উপকূলে আছড়ে পড়ে তাহলে ‘বুলবুল’র শক্তি হ্রাস এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ-ওডিশা উপকূলে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে শেষ মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড়েরর মতিগতি ও দিক পরিবর্তন হতে পারে। ‘বুলবুল’ বাংলাদেশের উপকূল থেকে ৭শ’ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান করছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক আবহাওয়া নেটওয়ার্ক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে ‘বুলবুল’ সৃষ্টি হওয়ার আগেই ভারত মহাসাগর ও এর সংলগ্ন আরব সাগরে আরও দুইটি ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান মাত্র গত কয়েকদিনে। অপর দুই ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে ‘কীয়ার’ এবং ‘মাহা’। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একযোগে তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের নজিরবিহীন চোখ রাঙানি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে গত ৬০ বছরের মধ্যে নজিরবিহীন। এটি আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের আলামত বহন করছে। ঘূর্ণিঝড়গুলো কেটে যাওয়ার পর এ উপমহাদেশে আবহাওয়ায় কিছুটা ‘অস্বাভাবিক’ পরিবর্তন আসতে পারে।
‘বুলবুল’র সক্রিয় প্রভাবে বঙ্গোপসাগর খুবই উত্তাল হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে তিন নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। ‘বুলবুল’ আরও এগিয়ে এলে পর্যায়ক্রমে সঙ্কেত বেড়ে যেতে পারে। সামুদ্রিক ট্রলার নৌযানযোগে মাছ শিকার প্রায় বন্ধ। মৎস্য পোতাশ্রয়ে ভিড় করেছে হাজারো মাছশিকারি নৌযান। তবে গতকাল রাত অবধি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ‘বুলবুল’র তেমন সক্রিয় প্রভাব পড়েনি। আজ (শুক্রবার) দেশের উপকূলীয় এলাকার কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাতের আভাস রয়েছে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’
গতকাল গভীর রাতে সর্বশেষ আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানান, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আরও উত্তর, উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। ‘বুলবুল’ পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় (১৬.০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থান করছে। এটি গতকাল গভীর রাতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৯৫ কি.মি. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৩৫ কি.মি. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৩৫ কি.মি. দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৭০৫ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থান করছিল।
বুলবুল আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর, উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’র অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে সমুদ্র বন্দরসমূহ, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কি.মি., যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে একশ’ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছাকাছি সাগর বিক্ষুব্ধ অবস্থায় রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতি সত্ত্বর নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি অনেক্ষণ স্থির থাকার পর শক্তি সঞ্চয় করে অবশেষে আরও ঘনীভূত হয়ে বুধবার মধ্যরাতের পরই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। এর নামকরণ করা হয় ‘বুলবুল’। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর একটি যৌথ প্যানেল কমিটি বিভিন্ন দেশে প্রচলিত নামানুসারে পর্যায়ক্রমে একেকটি ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে থাকে। যেমন- সিডর, আইলা, নার্গিস, রোয়ানু, মোরা, বায়ু, ফণি ইত্যাদি। ধারাবাহিকভাবে দুর্যোগের রেকর্ড ধরে রাখার জন্যই এ নিয়ম চালু আছে।
বঙ্গোপসাগরে বর্তমান ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ কোন দিকে ধেয়ে আসবে? আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানায়, এর মতিগতি এখনও স্পষ্ট নয়। কেননা ‘বুলবুল’ বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ও উপকূল থেকে এখন পর্যন্ত কমবেশি প্রায় ৭শ’ কিলোমিটার দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে। বুলবুলের মতিগতির দিকে সতর্ক পর্যবেক্ষণ রাখছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারের আবহাওয়া বিভাগ।
বৃষ্টির সম্ভাবনা, তেঁতুলিয়ায় পারদ ১৫.২ ডিগ্রি
পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’র দূরবর্তী প্রভাবে আজ (শুক্রবার) খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়া পূর্বাভাসে আরও জানা গেছে, ওইসব এলাকা ছাড়া দেশের অন্যত্র আকাশ আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। দক্ষিণাঞ্চলে দিনের তাপমাত্রা এক থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস এবং অন্যত্র অপরিবির্তিত থাকতে পারে। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল উত্তর জনপদের তেঁতুলিয়ায় ১৫.২ ডিগ্রি সে.।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৩৪ ডিগ্রি সে.। ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩০.৭ এবং সর্বনিম্ন ২০.৭ ডিগ্রি সে.। গতকাল সন্ধ্যা অবধি পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশের কোথাও বৃষ্টিপাত হয়নি।
‘বুলবুল’র সক্রিয় প্রভাবে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় আবহাওয়ার অবনতি ঘটতে পারে। পরবর্তী ৫ দিনে আবহাওয়ার উন্নতির সম্ভাবনা থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন