বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব আজ সারাবিশ্বে তাকে মর্যাদাপূর্ন অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। এ অবস্থান থেকেই তিনি অনুভব করছেন- দেশকে আরো দ্রুততর সময়ের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরী। আর এ উপলব্ধি থেকেই তিনি সাম্প্রতিক সময়ে দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তিনি এখন যে কথাগুলো বলছেন - ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্ঠে বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে ঠিক এই কথাগুলোই উচ্চারিত হতে শুনেছি। তিনি শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ নিয়ে বলেছেন - ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’।
এই চোরারা কিন্তু সময় মতো চোর থাকেনি, হয়েছে খুনির সহায়তাকারী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব জানেন, সব দেখেছেন। রাতারাতি মানুষ কি ভাবে পাল্টে যায়, সেটাও তিনি নিজ চোখেই দেখেছেন। তাই আমরা আস্থা রাখতে চাই, আজকের এই চক্র তেমন সুযোগ কখনও পাবে না। তবে পাশাপাশি শঙ্কায় হৃদয় কাঁপে। কারণ কালো টাকার ক্ষমতার দৌড় অনেক দূর।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সত্তর বছর পার করে একাত্তরে পা রেখেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম দল, সেই সাথে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে দলটিতে কর্মী এবং নেতার সংকট নেই। তবে দলের সভানেত্রীকে মনে রাখতে হবে ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর দলের সাথে কারা ছিলেন? দুঃসময়ের বন্ধুরাই আসল বন্ধু, এটা পরীক্ষিত সত্য। অথচ আজকের প্রেক্ষাপটে বিভ্রান্তি এসে ভর করে; আজ চারিদিকে শুধু বঙ্গবন্ধুর উত্তরসুরী। আসলেই কি তাই?
এখানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলা একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন- ‘আজ যে মুক্তিযোদ্ধা, কাল যে সে রাজাকার হবে না, এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না কিন্তু আজ যে রাজাকার, সে অতিতেও রাজাকার ছিল, ভবিষ্যতেও রাজাকার থাকবে।’ অথচ পরিহাসের কথা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এই মন্তব্যকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা নিজেদের ক্ষমতা প্রতিপত্তি রাখতে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও তাদের সন্তানদের সাদরে বরণ করছেন সর্বত্র। ফলশ্রুতিতে কি ঘটছে, নেতা কাউকে ধরে আনতে বললে এরা অতি উৎসাহে তাকে লাশ বানিয়ে আনে। দায়টা নিতে হচ্ছে কাকে?
শুরু হতে যাচ্ছে মুজিব বর্ষ। চারদিকে শুধু বঙ্গবন্ধু ধ্বনি। জামাত-বিএনপি এমনকি জাসদ, হক-তোয়াহাবাদী দের মুখে বঙ্গবন্ধু নামের জয়ধ্বনি শুনলে সত্যিকার বঙ্গবন্ধু প্রেমীদের বুকে কষ্ট হয়। কারণ নব্য এসব বঙ্গবন্ধু প্রেমীদের স্লোগানের পেছনে আদর্শ নয়, স্বার্থ কাজ করছে। কারণে অকারণে তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে টানাটানি করে বঙ্গবন্ধুকে অতি সাধারন স্তরে নামানোই তাদের লক্ষ্য। এসব দেখার কি কেউ নেই? সদ্য ক্যাসিনো কেলেঙ্কারীতে যে সব দুর্বৃত্ত ধরা পড়ছে, তাদের মুরুব্বিরা শিষ্যদের পূর্ব কীর্তিকলাপ সামনে আসা মাত্রই আকাশ থেকে পড়ছেন। এ সব মুরুব্বি কোন যোগ্যতায় বড় চেয়ারটাতে বসার সুযোগ পেয়েছেন? শোনা যায় - কোন এক সহযোগীদের প্রধান ব্যক্তি রীতিমতো হিযয়ত করে বঙ্গবন্ধু প্রেমী হয়েছেন। শুধুমাত্র মূল দলের কোন এক প্রভাবশালী নেতার সাথে আত্মীয়তার কারণে তিনি বৃদ্ধ বয়সে যুবা সেজেছেন। পুরো বিষয়টা একবার ভাবুন, নেত্রীকে বেকায়দায় ফেলতে এটা কি ৭৫ এর মতোই পাতানো জাল নয়?
সর্বত্রই আলোচিত কাউন্সিলে দলকে ঢেলে সাজানো হবে। এ কাজটি নির্ভেজাল নির্লিপ্ততায় করতে না পারলে সামনে অশনি সংকেত। যারা নেতৃত্বে আসবেন, তাদের সততা ও আনুগত্য যদি প্রশ্নাতীত না হয়, তাহলে আবার ছিদ্র পথে ঢুকে যাবে চাটার দল। তখন ‘জিরো টলারেন্স’ হয়ে যাবে মুখের কথা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একবার নিজেই বলছিলেন- ’আওয়ামী লীগে আমাকে ছাড়া বাকী সবাইকেই টাকা দিয়ে কেনা যায়।’ - কথাটা অত্যন্ত দুঃখ থেকে উচ্চারিত হলেও, বাস্তবতা থেকে কিন্তু খুব বেশী দূরে নয়।
দু-চার দশজন যে নিবেদিত নেতা নাই তা নয়, আছে। তবে ধান্দাবাজদের দৌরাত্মে তারা কোণঠাসা। আর মধ্যম সারির নিবেদিত প্রাণ নেতারা, হাইব্রিডদের দাপটে সামনে আসতে পারছে কই? চাঁদাবাজির সম্রাটকে ধরতে শেষ পর্যন্ত শেখ ফজলে নূর তাপসকে কথা বলতে হয়। এতেই বুঝা যায় দুর্নীতিবাজদের হাত কতটা লম্বা। তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও ঝুলিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখেন। এমতাবস্থায় নেত্রীকে সামনের পথে সতর্কাবস্থায় একক সিদ্ধান্তেই হাটতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাকে নজর দিতে হবে ১৯৭৫ এর পর তাঁর পাশে বিশ্বস্ততার সাথে কারা ছিলেন? তাদের মাঝ থেকে যারা মারা গেছেন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে তুলে আনতে হবে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর প্রতি যারা বিশ্বস্ত ছিলেন, তাঁদের রক্ত কখনও নেত্রীর প্রতি অবিশ্বস্ত হতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ নেত্রী ১/১১ তে আরো একবার দলীয় নেতাদের চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় পেয়েছেন। বিপদে পলায়নপর অথবা আপোষকামী মানুষগুলো কখনও সু-সময়ের বন্ধু হতে পারে না। তৃতীয়তঃ এ ঘাট ও ঘাট করা মানুষগুলো সব সময়ই অবিশ্বস্ত। তাদের ঝেড়ে ফেলাই বাঞ্ছনীয়। অতীতে দেখা গেছে - দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া অথবা অন্য দল থেকে আসি-আসি করা লোকদের ভোটের রাজনীতির কারণে দলে টেনে, আদতে দলের ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় নাই। চতুর্থতঃ মাঠ পর্যায়ে দল ও সহযোগী সংগঠনে জামায়াত, বিএনপি সহ আওয়ামী বিরোধীদের দলে টানতে যে সব নেতারা সক্রিয় ছিলেন বা আছেন, তাঁদের চিহ্নিত ও শাস্তির (অর্থাৎ বহিস্কার) ব্যবস্থা করতে হবে। পঞ্চমতঃ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ ভোগকারি সকলকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা, মর্যাদা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ দুর্নীতি করার চিন্তা না করে।
নেত্রীকে মাঠ পর্যায়ে নজর দিতে হবে। কারণ কেন্দ্রে বসে ক্ষমতার জোরে নিজ এলাকায় একটা পাওয়ার গ্রুপ গড়ে তোলা যায়। এই গ্রুপ গুলোই যত নষ্টের গোড়া। এলাকা এবং দলের ভিতর যত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এদের দিয়েই সংগঠিত হয়। এদের কারণে ত্যাগী এবং সৎ নেতৃত্ব উঠে আসতে পারে না। আওয়ামী নেত্রীর সবচেয়ে বড় গুন, তিনি মাঠ পর্যায়ের সব খবরাখবর রাখেন। সুতরাং, তাঁর পছন্দের বাইরে যেন মাঠ পর্যায়ের কোন কমিটি না হয়, এটা তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে। মূল দলের নেতৃত্বে ত্যাগীরা সুযোগ পেলে, সহযোগী সংগঠনেও তার হাওয়া লাগবে। আর মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব ঠিক হয়ে গেলে, কেন্দ্র ঠিক করতে নেত্রীর তেমন বেগ পেতে হবে বলে মনে হয় না। পরিশেষে একটা প্রসঙ্গে বলতে চাই - বঙ্গবন্ধুর বড় দুর্বলতা ছিল আবেগ। অজস্র কুকর্ম করে তাঁর কাছে এসে ক্ষমা চাইলে মুখ ফেরাতে পারতেন না। শেষ পর্যন্ত এই মহত গুণটাই তার শত্রুরা কাজে লাগিয়েছিল। বাবার বহমান রক্তের কারণেই জননেত্রী মাঝে মাঝে আবেগপ্রবণ হয়ে যান, কিন্তু কোন আবেগকেই প্রশ্রয় দেয়া উচিত হবে না। মনে রাখতে হবে - যেখানটায় তিনি বসে আছেন তার নিচে বিষাক্ত সাপেরা কিলবিল করছে। তারা সুযোগের অপেক্ষায়। নেত্রী হয়তো তাঁর জীবনের পরোয়া করেন না কিন্তু অভাগা জাতির জন্য তাঁর বেঁচে থাকাটা যে বড্ড জরুরী। আপনি অন্ততঃ আমাদের কথাটা ভাববেন।
লেখক: ড. ওমর বিন আজিজ তামিম
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ
কাউন্সিলর (২৭ নং ওয়ার্ড), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন