শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ধারণার জয়

অযোধ্যা রায়ে আইনের পরাজয়

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

গত ৯ নভেম্বর বহুল প্রতীক্ষিত অযোধ্য মামলার রায়ের আগে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলো যে ‘ভারতীয় রাজনৈতিকব্যবস্থার সেক্যুলার বৈশিষ্ট্যের’ কথা উল্লেখ করে জানান যে এগুলো হলো ‘সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।’
রায়ে এ ধরনের উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন বক্তব্যে ভারতের সেক্যুলার ম‚ল্যবোধ ও আইনের শাসনের কথা বলা হয়েছে। রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ম‚লে রয়েছে সাম্য প্রতিষ্ঠা সমুন্নত রাখা ও আইনের শাসন প্রয়োগ করা। আমাদের সংবিধানের আওতায় সব বিশ্বাস, ধর্ম আইনের আওতায় ও আইনের কাছে সমান।

আদালত আরো জানায়, আদালত বিশ্বাস বা ধারণার ভিত্তিতে রায় দিতে পারে না, রায় দিতে হবে প্রমাণের আলোকে। এখানেই শেষ না করে আদালত যে দুটি কাজের রেশ ধরে বর্তমান মামলাটি আদালতে উত্থাপিত হয়েছে, তার তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদে জোর করে মূর্তি স্থাপন করা হয়। এই কাজকে ‘অবমাননাকর’ হিসেবে অভিহিত করে আদালত তার রায়ে জানায়, ওই ঘটনায় মুসলিমদেরকে কোনো আইনসঙ্গত কর্তৃপক্ষ হটায়নি, বরং তাদেরকে প্রার্থনা করা থেকে বঞ্চিত করার জন্যই তা করা হয়েছিল। আদালত আরো জানায়, ১৯৯২ সালে মসজিদটির ধ্বংস ও ইসলামি কাঠামোটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়াটা ছিল আইনের শাসনের চরম লঙ্ঘন।
কিন্তু যেখানে বাবরি মসজিদটি দাঁড়িয়েছিল, সেই স্থানটির মালিকানা নির্ধারণ করার রায় প্রদান করার সময় আদালত এসব উচ্চ নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ধর্মীয় ক‚পমÐুকতারই আশ্রয় নেয়। সেক্যুলারবাদ, আইনের শাসন, মসজিদ ভাঙ্গার অপরাধ নিয়ে নিজেদের আলোচনাই অগ্রাহ্য করে আদালত বাবরি মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মাণের সুযোগ দিয়ে কঠোর সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদমূলক অবস্থানই গ্রহণ করেছে।

আদালত একটি পক্ষপাতমূলক অবস্থান গ্রহণ করে মসজিদটি নিয়ে প্রমাণ পেশ করার দায়িত্ব দিয়েছে মুসলিমদের কাঁধে আর হিন্দুদের ওই প্রমাণ পেশ করার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে।
আদালতের আরো কিছু পর্যবেক্ষণ প্রহসনের মতো শোনা গেছে। বলা হচ্ছে, ১৬তম শতক থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত মসজিদটি কেবল মসজিদ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ পেশ করা হয়নি। কিন্তু সেখানে পূজা হতো, এমন কোনো প্রমাণ পেশ করতে হিন্দুদের বলা হয়নি।

অধিকন্তু আদালত আসলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদেরকে পুরস্কৃত করেছে। হিন্দুদের অব্যাহতভাবে আঙিনার ভেতরে প্রবেশ করে মুসলিমদের নামাজে বিঘ্ন সৃষ্টির ঘটনাকে বলা হলো যে মসজিদটির ওপর মুসলিমদের মালিকানা নিরঙ্কুশ নয়। অথচ বাস্তবতা হলো, মুসলিমদের মসজিদের বাইরের প্রাঙ্গনে থাকা হিন্দুদের উপাসনায় কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না করাকে হিন্দুদের মালিকানা নিরঙ্কুশ থাকার প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হলো।
আদালত আরেকটি অদ্ভ‚ত যুক্তি উত্থাপন করে এ কথা উল্লেখ করে যে, ইতিহাসজুড়ে ভ‚মিটিকে বিরোধপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, হিন্দুরা বাইরের প্রাঙ্গনের মালিকানা নিরঙ্কুশভাবে ভোগ করলেও ভেতরের এলাকাটির মালিকানা মুসলিমরা নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। ভেতরের অংশটুকু বিরোধপূর্ণ হওয়া সত্তে¡ও আদালত রায় দেয় যে পুরো এলাকার মালিকানা নির্ধারিত হতে হবে অখÐ এলাকা হিসেবে। অথচ ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাই কোর্ট ভ‚মিটি ভাগ করার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এই অস্বাভাবিক, অনড় সিদ্ধান্তই পুরো এলাকাটি মন্দিরের জন্য বরাদ্দ করার কাজে ভ‚মিকা রেখেছে।

আবার তেলে মাথায় তেল দেয়ার মতো করে আদালত মন্দিরের জন্য পুরো প্লটটি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, ধর্মীয় কাঠামোটি নির্মাণের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠনের জন্যও বলেছে মোদি সরকারকে। এটি কেবল ভারতের সেক্যুলার চরিত্রেরই লঙ্ঘন নয়, এই বিরোধের কোনো পক্ষ না হওয়া সত্তে¡ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এখানে হাজির করা হলো এর মাধ্যমে। এখন ভয় সৃষ্টি হয়েছে যে সহিংস রামজন্মভ‚মি আন্দোলনকারী দলটিই এখন ক্ষমতায় থাকায় তারা মন্দির নির্মাণের বিষয়টিকে রাজনীতিকরণ করবে।

১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার লক্ষ্য ছিল সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করা। আদালতের জটিল যুক্তি ওই লক্ষ্যই বাস্তবায়নের পথ করে দিয়েছে। বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দাঙ্গাবাজদের সহিংসতার পক্ষেই রায় গেছে।
বিচার বিভাগের দায়িত্ব হলো আইন ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করা। অবশ্য, আদালত এসব দায়দায়িত্ব রক্ষা করতে বারবারই ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট ইন্দিরা গান্ধী সরকারের কাছে নতজানু হয়ে জরুরি অবস্থার প্রতি সায় দিয়েছিল। এই আদালত কাশ্মীরীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মোদি সরকারের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছে। আর এখন অযোধ্যাতে আদালত স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সবচেয়ে ভীতিকর সময়ে আইনের শাসনের বদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তিকেই গ্রহণ করেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন