মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য

নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা

প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শিশু আরাফাতের বয়স ১৩ দিন। মায়ের গর্ভ থেকে ৩২ সপ্তাহ পূর্ণ না হতেই তার জন্ম হয়। জন্মের পর সে কান্নাকাটি করছিল না। শ্বাস-প্রশ্বাসেও সমস্যা ছিল। ওজন কম ছিল। চাঁদপুর জেলা শহরের রহমতপুর আবাসিক এলাকার ভূইয়া বাড়ির জয়নাল ভূইয়ার ছেলে আরাফাত। জয়নাল ভূইয়া জানান, আরাফাতের মার ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয়, আর সতের বছরে সে মা হয়। তার স্ত্রী সবসময় অপুষ্টিতে ভুগতো। এ জন্য তার ছেলেটাও সমস্যা নিয়ে জন্ম হলো।
শুধু আরাফাতের মা একা নয়। প্রায় সকল নতুন মায়েরা সন্তান জন্মের আগে ও পরে বিভিন্ন রকম দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকেন। ভয় পেতে থাকেন বিভিন্নভাবে। সঠিক পদ্ধতি না জানার ফলে নবজাতককে লালন পালন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন।
নবজাতকের যতœ, পরিচর্যা ও কিছু স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কথা হয় শিশু চিকিৎসক ডা. জহুরুল হক সাগরের সাথে। ডা. সাগর বলেন, সাধারণত জন্মের পর থেকে ৪ সপ্তাহ বয়সী বাচ্চাকে আমরা নবজাতক বলে থাকি। জন্মের সময় মায়ের গর্ভে বাচ্চা যদি পুরোপুরি ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক থাকে, কান্না করেও যদি কোনো জন্মগত ত্রুটি না থাকে তাহলে নবজাতককে সুস্থ বাচ্চা বলি। আর যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তালে বুঝবো নবজাতক অসুস্থ।
নবজাতকের সঠিক যতœ ও পরিচর্যা প্রসঙ্গে ডা. জহুরুল হক সাগর আরো বলেন, নবজাতকের পরিচর্যা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে হওয়া উচিত। তবে এর আগে থেকেই বিষয়টি অনেকটা শুরু হয়ে যায়। শিশু মায়ের গর্ভে থাকতেই মাকে অ্যান্টিনেটাল পরামর্শ দিতে হবে, চেকআপে থাকতে হবে। তখন থেকেই মূলত বাচ্চার যতœ শুরু হয়। মাকে জানতে হবে বাচ্চার জন্মের পর পর তার শিশুকে কী খাওয়াবেন। মা বাচ্চার জন্য কী করতে পারেন। প্রথম থেকে শিশুর পরিচর্যার জন্য দরকার পুষ্টি, আর তা হলো মায়ের বুকের দুধ। দুধটা যেন বাইরের না হয়। বাচ্চা হওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা দুধ খাওয়াতে বলি। মায়ের যে শালদুধ বের হয়, সেটি কোনোভাবেই ফেলে দেয়া উচিত না। শালদুধ বাচ্চার জন্য প্রথম টিকা। যেহেতু ওখানে প্রোটিন বেশি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য যে বিষয়গুলো দরকার সেটিও বেশি।
নবজাতকের রোগ ব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা বিষয়ে ডা. সাগর বলেন, নবজাতকের নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। জন্মের পরপরই নবজাতকের বেশকিছু অসুখ বেশি হয়। ছোট শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে বলে কিছু অসুখে তারা বেশি আক্রান্ত হয়। এধরনের অনেক অসুখ অল্প যতেœ ভালো হয়ে যায়।
জন্মের পর অনেক শিশুর জন্ডিস দেখা দিতে পারে। এটা খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণত নবজাতকের জন্মের দুই দিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে এই জন্ডিস দেখা দিতে পারে এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে তা সেরে যায়। এই সময় মায়ের দুধ শিশুকে বেশি করে খাওয়াতে হয় এবং সেই সঙ্গে সকালের হালকা রোদে শিশুকে খালি গায়ে কিছুক্ষণ রাখতে হয়। তাহলে শিশু দ্রুত জন্ডিসমুক্ত হয়। তবে মনে রাখতে হবেÑ শিশুর মাথায় যেন সূর্যের আলো সরাসরি না পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুর জন্ডিসের আলাদা কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যদি জন্ডিস দেখা দেয় অথবা সাত দিন বয়সের পর জন্ডিস দেখা দেয় বা জন্ডিসের কারণে গায়ের হলদেটে ভাব যদি দিন দিন গাঢ় হতে থাকে, তবে ডাক্তার দেখাতে হবে।
কোনো কোনো নবজাতকের চোখ দিয়ে পরিষ্কার পানি বা অশ্রু ঝরতে পারে। তার জন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে শিশুর নাকের গোড়ায় চোখের কোনা বরাবর আঙুল দিয়ে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ বা মালিশ করলে চোখ দিয়ে পানি পড়া সেরে যায়। চোখের পানি যদি পুঁজ মেশানো হয় বা পুঁজের মতো হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।
জন্মের পর অনেক শিশুর (ছেলে বা মেয়ে) স্তন ফুলে যায় এবং অনেক সময় নবজাতক মেয়েদের যোনিপথে রক্তক্ষরণ হতে পারে। সাধারণত চার দিন থেকে ১০ দিনের মাথায় রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং তা মায়েদের হরমোনের প্রভাবে হয়। রক্তক্ষরণের অন্যান্য কারণ যদি না থাকে, এই রক্তক্ষরণ নিজেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। এধরনের রক্তপাতে সাধারণত ভয়ের কিছু নেই। শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি। প্রয়োজন মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।
অনেকেই শিশুকে জন্মের পর গরম কাপড়, ভারী তোয়ালে ইত্যাদি দিয়ে পেঁচিয়ে রাখেন। অতিরিক্ত কাপড় পরানোর ফলে গরমে শিশুর গায়ে লাল দানা বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এ রকম হলে শিশুকে ঘন ঘন কুসুম গরম পানি দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। গায়ে বেবি পাউডারও মাখা যেতে পারে। শিশুকে অতিরিক্ত কাপড় বাদ দিয়ে হালকা পাতলা আরামদায়ক সুতি কাপড় পরাতে হবে।
কোনো কোনো শিশুর নাভি শুকিয়ে যাওয়ার পর নাভিমুখের নিচের মাংসপেশিতে ফাঁকের সৃষ্টি হয় এবং শিশু কাঁদলে বা কোঁত দিলে নাভি বেলুনের মতো ফুলে ওঠে। প্রথম কয়েক মাসে ফোলা বৃদ্ধি পেতে পারে, তবে পরে ফোলা সংকুচিত হতে হতে স্বাভাবিক হয়ে যায়। নাভিস্ফীতি কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না। তবে নাভিস্ফীতি খুব অস্বাভাবিক মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
শিশুদের চোখের সাদা অংশ বা কনজাংটিভায় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। এ রোগে শিশুর চোখে পিঁচুটি বা পুঁজ দেখা যায় এবং চোখ লাল হয়ে যেতে পারে। কনজাংটিভাইটিস হলে চোখ বারবার পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হয় অথবা নরম কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। অনেক সময় এই প্রদাহ শিশুর অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
মনে রাখতে হবে নবজাতককে ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কোনো দুধ খাওয়ানো একদমই ঠিক না। শুধু মায়ের দুধই খাওয়াতে হবে। আর ছয় মাস পর মায়ের দুধের পাশাপাশি নরম খাবার খাওয়ানো যেতে পারে। যেমন : ফলের জুস, কমলার রস, কলা, আধা সেদ্ধ ডিম। প্রথমে ডিমের কুসুম, তারপর ধীরে ধীরে সাদা অংশ খাওয়া শুরু করবে। যেহেতু প্রোটিন তাই অ্যালার্জি হতে পারে। একসাথেই সবকিছু খাওয়ানো যাবে না। ধীরে ধীরে একটার পর একটা খাওয়ানো যাবে। এরপর চাল, ডাল, তেল মিলে খিচুড়ি খেতে দিতে হবে। এছাড়া শিশু হজম করতে পারে এমন পুষ্টিসম্পন্ন ঘরে তৈরি খাবার দিতে হবে।
নবজাতকের মায়েদের প্রতি কিছু পরামর্শ : জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মায়ের বুকে নবজাতকের মুখ ধরা উচিৎ। দুধ খাওয়ানোর পদ্ধতি একজন ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। বাচ্চাকে প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত একবার, ৭ দিন পর ও ৬ সপ্তাহ বয়সে ডাক্তারের পরামর্শ ও শিশুর শারীরিক স্বাভাবিক পরীক্ষা করাবেন। প্রথম সপ্তাহে গোসল দেয়ার দরকার নেই। তারপর থেকে গোসল দেয়ার জন্য স্বাভাবিক কিছু নিয়ম মেনে চললেই হবে। গোসলের আগে টাওয়েল রেডি করুন, দরজা-জানালা বন্ধ করুন, ফ্যান অফ করুন, কুসুম গরম পানিতে বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি করে গোসল করিয়ে দ্রুত গা হাত পা মাথা মুছিয়ে দিন। ঠা-া যেন না লাগে সেদিকে নজর রাখবেন, আবার গরমও যেন না লাগে সেটা খেয়াল রাখবেন। মনে রাখবেন নবজাতক শিশুরা তার সমস্যা বলতে পারে না। তার একটাই ভাষা তা হলো কান্না। তাই মাকেই বুঝার চেষ্টা করতে হবে, নবজাতকের কী সমস্যা বা সে কী চাচ্ছে। তার কান্নার শব্দ শুনেই আপনাকে বুঝতে হবে বাচ্চার কীসের প্রয়োজন। আর আপনি বুঝতে না পারলে ও কোনো সমস্যা মনে হলে অতি দ্রুত বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
ষ আলম শামস
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন