বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পরিবহন ধর্মঘটে জনগণের জিম্মিদশা

| প্রকাশের সময় : ২২ নভেম্বর, ২০১৯, ৫:২৭ এএম

বাস-ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক শ্রমিকদের ডাকা আকষ্মিক ও অঘোষিত ধর্মঘটে বুধবার সারাদেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। রাজধানীর প্রবেশপথে অ্যাম্বুলেন্স আটকে দিয়ে মুমুর্ষ রোগী এবং নবজাতক শিশুকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়ার সংবাদও গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এমনিতে সারাবছরই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকে সাধারণ যাত্রীরা। তারা যথেচ্ছ গাড়ী চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে প্রতিদিন মানুষ হতাহত করছে। লাইসেন্সবিহীন, রেজিস্টেশনবিহীন, রুট পারমিশন ও ফিটনেসবিহীন গাড়ীর অবৈধ চালকরা যখন তখন রুট পরিবর্তন করে, যথেচ্ছা ভাড়া বাড়িয়ে মানুষকে জম্মি করছে। কখনো একই রুটের অন্য গাড়ীর সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে পথচারিদের চাকার নিচে পিষে মারছে, কখনো পরিবহন শ্রমিকদের বেপরোয়া আচরণের প্রতিবাদ করলে গাড়ীতে যাত্রীদের নাজেহাল করছে, এমনকি চলন্ত গাড়ী থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে যাত্রী হত্যার ঘটনাও ঘটাচ্ছে। এহেন বাস্তবতার পরিবর্তন চায় দেশের মানুষ। রাজধানীতে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় দুই শিক্ষার্থীর উপর গাড়ী তুলে দিয়ে হত্যার প্রতিবাদে গত বছর সারাদেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাজপথে নেমে এলে নিরাপদ সড়কের দাবী গণদাবীতে পরিনত হয়। এমনকি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও শিক্ষার্থীদের দাবীর প্রতি সমর্থন ও একাত্মতা প্রকাশ করেন। এরই প্রেক্ষিতে নতুন সড়ক পরিবহণ আইনের দাবী জোরালো হয়ে ওঠে। নতুন সড়ক পরিবহণ আইন নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই সরকার ও সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্টরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। তবে সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের প্রভাবের কারনে যুগোপযোগী আইনের বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর নতুন সড়ক পরিবহন আইন চুড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন যখন সময়ের দাবীতে পরিনত হয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন গণপরিবহণের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অবৈধ চালক ও ফিটনেস বিহিন গাড়ীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়, ঠিক তখনি সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা কর্মবিরতির নামে সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ করে সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে। দাবী আদায়ে রাজনৈতিক দলের হরতাল পালন বা শ্রমিক সংগঠনের কর্মবিরতি কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের জন্য হরতাল পালন, সড়ক অবরোধ বা সভাসমাবেশের সুযোগ বিরল হলেও কর্মবিরতির নামে গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বেপরোয়া নৈরাজ্যে সাধারণ মানুষের জিম্মিদশা অমানবিক রূপ লাভ করেছে। রাজনৈতিক দলের হরতাল অবরোধে অ্যাম্বুলেন্স, গণমাধ্যমের গাড়ী, জরুরী সেবা সম্পর্কিত পরিবহন বিশেষ ছাড় পেলেও মালিক-শ্রমিকদের কর্মবিরতি বা ধর্মঘটে সবকিছুই অচল করে দেয়ার মহড়া দেখা গেছে বার বার। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান বন্ধ থাকায় বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দরিদ্র মানুষের জন্য বাড়তি দুর্ভোগ হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘদিনের যাচাই-বাছাই ও সব পক্ষের মতামত ও পর্যালোচনার পর সংসদে ও মন্ত্রীসভায় পাস হওয়া আইনের বাস্তবায়ন কারো মুখাপেক্ষি হওয়ার কথা নয়। আমাদের দেশের প্রত্যাশিত সড়ক পরিবহন আইন সংশ্লিষ্ট মালিক-চালকদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে বার বার থমকে যেতে দেখা যাচ্ছে। সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অন্যায্য দাবীর বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রশ্রয় ও নমনীয়তা বিষ্ময়কর। মালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘটে অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরী সেবা সম্পর্কিত গাড়ী চলাচল নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। সেই সাথে সড়ক পরিবহন ব্যাহত হওয়ার কারণে জনভোগান্তি লাঘবে এবং পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে নৌপরিবহন ও রেলওয়েতে বাড়তি ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে জনজীবন অচল হওয়ার দুর্ভোগ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। পরিবহণ ধর্মঘটের সুযোগে ঢাকায় নতুন করে আরো হাজার হাজার রিকশার আগমন ঘটেছে। রাজধানীর যানজট নিরসনের অন্যতম অন্তরায় রিকশার এই অবাধ দৌরাত্ম্য রোধেও সরকারী দলের একশ্রেণীর নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি ও পারমিট বাণিজ্যের যোগসুত্র খুঁেজ পাওয়া যায়।

পরিবহণ ধর্মঘটে জনজীবন অচল হয়ে পড়ার পর জনগণকে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অন্যায্য দাবীর সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। ধর্মঘট পালন অব্যাহত রেখেই তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে মিলিত হয়ে নতুন আইন ঠেকাতে দাবী-দাওয়া তুলে ধরেন। অবশেষে দাবী আংশিক মেনে নেয়ার পর তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে। হঠাৎ করেই সরকার নতুন সড়ক পরিবহন আইন করেনি। দীর্ঘদিনের গণদাবী ও ব্যাপক পর্যালোচনা ও নিরীক্ষার পরই আইনটি চুড়ান্ত পরিনতি লাভ করেছে। আইনের বাস্তবায়নে ট্রাফিক বিভাগের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে নতুন কিছু প্রস্তাব ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের বুকে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মত প্রস্তাবও বিবেচনা করা হচ্ছে। সেই সাথে সড়কের সংস্কার, পথচারিদের সচেতনতা ও শৃঙ্খলার উপরও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নতুন আইনে রাস্তা পারাপার, ফুটপাথ ও ফুটওভারব্রীজ ব্যবহারসহ রাজপথে নাগরিক শৃঙ্খলা রক্ষায় জেল-জরিমানাসহ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক কঠোর আইনের প্রতিবাদে নাগরিক সমাজের কোনো প্রতিনিধিকে আইন সংশোধনের দাবী জানাতে দেখা না গেলেও ফিটনেসবিহীন অবৈধ গাড়ীর মালিক ও শ্রমিকরা ভূয়া লাইসেন্সধারী বেপরোয়া চালকদের বাঁচাতে একাট্টা হয়ে লড়ছে। এভাবে আবারো ৬ মাসের জন্য স্থগিত হয়ে গেল নতুন সড়ক পরিবহন আইনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা। যাত্রী ও জনসাধারণকে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে সরকারের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। চাপের কাছে নতি স্বীকার কাম্য নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন