বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চলতে হবে সত্য ও ন্যায়ের পথে তাতেই মুক্তি ও কল্যাণ

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

এই পৃথিবীতে আমরা সবাই ক্ষণিকের অতিথি। ছিলাম না, আজ আছি, কাল আবার থাকব না। লক্ষ কোটি বছর ধরে বহমান এই পৃথিবীর এটাই চিরন্তন নিয়ম। এই নিয়মের ব্যতিক্রম অতীতেও ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটবে না। আমরা যারা আজ এই পৃথিবী নামক গ্রহটির বাসিন্দা, তারাও সময়ের পরিক্রমায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে একদিন চিরতরে চলে যাব। মরণের মাঝ দিয়ে পৃথিবীর সবকিছুর সাথে একজন মানুষের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়। আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হয়। ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা কোনো কিছুই আমাদের সাথে যাবে না। যেই অর্থ-সম্পদ, আভিজাত্য এবং ক্ষমতার জন্য এত মারামারি, হানাহানি, সেই অর্থ-সম্পদ, আভিজাত্য এবং ক্ষমতা সবই অটোমেটিক্যালি পর হয়ে যায়। আবার এই মৃত্যু কার জীবনে কখন আসবে সেটাও কেউ জানে না। কে কত বছর বাঁচবে সেটাও জানার কোনো সুযোগ নেই। মানুষের জীবন যেখানে খুবই ক্ষণস্থায়ী এবং অনিশ্চয়তায় ভরা, সেখানে আমাদের সবারই উচিত এই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সুন্দর, সুখী এবং শান্তিময় করা। আমাদের উচিত ভালবাসায়, মমতায় এবং ভাতৃত্বের বন্ধনে জীবনকে গড়ে তোলা। তার জন্য আমাদের সবাইকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হবে।

পৃথিবীতে জীবনকে সুন্দর এবং সুখময় করতে হলে আমাদের সবাইকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হবে। জাতি-ধর্ম-বণ-গ্রোত্র নির্বিশেষে সবাই চায় মানুষ সত্য কথা বলুক, মিথ্যা বলা পরিহার করুক। কারণ সত্য কথা মানুষের মাঝে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং মিথ্যা কথা অসুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে। অথচ মানুষ এখন হরদম মিথ্যা কথা বলে। তাই সমাজে এত অশান্তি। আমার আপনার মত প্রতিটি মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক কিছু অধিকার আছে। সেগুলো হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার। সাথে রয়েছে মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকার। মানুষ মাত্রই ধর্মে বিশ্বাসী। ধর্মে বিশ্বাস করে না এমন মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম। অথচ আজকের পৃথিবীর বহু দেশে বহু সমাজে বহু মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারে না। সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষেরা সংখ্যা লঘিষ্ঠ মানুষদের ধর্ম পালনে বাধা দিচ্ছে। ফলে সংখ্যা লঘিষ্ঠ মানুষদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষোভ, ঘৃণা এবং বিদ্রোহ। ফলে সমাজ অস্থির হচ্ছে, সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ঠ হচ্ছে। ফলে একটি দেশে বসবাসকারী ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে, অশান্তির জন্ম নিচ্ছে, যা ক্রমান্বয়ে বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন। সুতরাং আসুন, আমরা সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালনের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করি, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অধিকারকে রক্ষা করি।

রাজনৈতিক অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার হলেও পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অনেক দেশেই এখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার এই যুগেও দেশে দেশে চলছে রাজতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র, যার কারণে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে এবং মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। তাই দেশে দেশে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারা কিন্তু চিরদিন ক্ষমতায় থাকবেন না। মৃত্যু অবশ্যই অবশ্যই আপনাদের গ্রাস করবে। ফেরআউন, হালাকু খান আর আলেকজেন্ডার দ্য গ্রেট এর মতো ক্ষমতাধর শাসকেরা আজ কেউ নেই। সময়ের পরিক্রমায় সবাই হারিয়ে গেছেন। তাদের সেই ক্ষমতাও নেই, সাম্রাজ্যও নেই, সম্পদও নেই। আজ তাদের কেউ স্মরণও করে না।

পারিবারিক সহিংসতা এবং নারী নির্যাতন আজ বিশ^জুড়েই একটি সামাজিক সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমরা যতই অগ্রসর হই না কেন, নারী নির্যাতন কিন্তু বাড়ছেই। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশে দেশে, যেখানে নারীরা ভোগ করছে অবাধ স্বাধীনতা, যেখানে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ ছাড়া যৌন সম্পর্ক একটি স্বাভাবিক এবং স্বীকৃত বিষয়, সেখানেও নারীরা আজ ব্যাপকহারে নির্যাতনের শিকার। সেখানেও নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে এবং এসব দেশে নারী নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি। এমনকি শিক্ষকের হাতে ছাত্রীরাও আজ নির্যাতিত হচ্ছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, নারী স্বাধীনতার অবাধ উপস্থিতি এবং যৌনতা এত সহজ হওয়া সত্তে¡ও পশ্চিমা বিশে^ নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে কেন? সুতরাং এত আধুনিকতার প্রয়োজন কি? মনে রাখতে হবে, সংসারেই সুখ। স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততি মিলে বসবাসেই জীবনের স্বার্থকতা এবং এতেই মানুষের জীবন সুখের এবং শান্তির হয়। ঘর-সংসার যদি না থাকে তাহলে এত আধুনিক হয়ে এবং ভালবাসার গান গেয়ে লাভ কি? মিডিয়া জগতে যারা প্রতিনিয়তই ভালবাসার অভিনয় করে আর ভালবাসার গান গায়, তাদের অনেকের জীবনেই কিন্তু ভালবাসা নেই, সংসার নেই। সত্য কথা বলতে কি এখনো যারা পারিবারিক মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে আছে, তারাই কিন্তু জীবনে সুখী। আর যারা এসব না করে লাগামহীন জীবনকে বেছে নিয়েছে তাদের জীবন থেকে সংসার, সুখ এবং শান্তি সবই হারিয়ে গেছে। সুতরাং লাগামহীন জীবন বাদ দিন, সংযমী হোন এবং পরিমিত জীবন গড়ে তুলুন। দেখবেন, নারীরা নির্যাতিত হবে না, কাউকে আত্মহত্যা করতে হবে না এবং সংসার ভাঙবে না।

মাদকের ভয়াবহতা সমাজকে আজ গ্রাস করেছে। হাত বাড়ালেই এখন মাদক পাওয়া যায়। ইয়াবা, ফেনসিডিল এবং হিরোইন এর উপস্থিতি সর্বত্র। মাদকের প্রভাবে তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এখন কিশোর গ্যাংয়ে পরিণত হয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত হচ্ছে। অথচ ওরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ, ওরাই তো দেশের কান্ডারী। সুতরাং পিতামাতাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারা সন্তানদের নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে নৈতিকতা শিক্ষা দিন। নৈতিক-মূল্যবোধে আপনার সন্তানকে গড়ে তুলুন। তাকে সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা শিক্ষা দিন। দুর্নীতিমুক্ত এবং মাদকমুক্ত জীবন গড়ার জন্য উপদেশ দিন। দেখবেন, আপনার সন্তান সময়ের পরিক্রমায় একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠবে এবং সে আপনার সম্মান বৃদ্ধি করবে। আর যদি নৈতিকতা শিক্ষা না দেন, তাহলে আপনার সন্তান হবে মাদকসেবক, সন্ত্রাসী, চাদাঁবাজ এবং দুর্নীতিবাজ। আর এটা কখনো পিতামাতার কাম্য নয়।

ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারা নৈতিকতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করুন। মানুষকে সঠিক মূল্যে পণ্য দিন। কেমিক্যাল এবং ভেজালমুক্ত পণ্য বিক্রি করুন। ওজনে কম দেবেন না, অত্যাধিক মুনাফা করবেন না। সততা এবং নৈতিকতার সাথে ব্যবসা করুন। এতে আপনার সুনাম বাড়বে, কাস্টমার বাড়বে। সময়ের সাথে সাথে আপনার ব্যবসার পরিধিও বাড়বে, আপনার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও বাড়বে। তাড়াতাড়ি ধনী হবার চেষ্টা করবেন না। কারণ সেই উন্নয়ন টেকসই হয় না। শিল্পপতিদের উদ্দেশ্যে বলব, আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের প্রতি সুবিচার করুন। তাদের সমস্যার কথা ভাবুন এবং তা দূর করার জন্য কাজ করুন। তাহলে তারা আপনার প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য মনে প্রাণে কাজ করবে। তখন আপনার প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হবেই। একই সাথে রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে বলছি, অনুগ্রহ করে জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না। জনগণকে ভালবাসুন, জনগণের সেবা করুন এবং জনগণকে তার ন্যায্য অধিকার দিন। মনে রাখবেন, আপনারা হলেন জনগণের সেবক এবং শাসক, কিন্তু শোষক নয়। জনগণকে ভালবাসলে জনগণও আপনাদেরকে ভালবাসবে। আর এটাই সত্যিকারের পাওয়া। তখনই আপনি হবেন স্মরণীয় এবং বরণীয়। তা না হলে দু’দিন পরে আপনার অবস্থান হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, যা কারো কাম্য নয়।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন