শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর জায়নবাদের প্রভাব এবং ইসরাইল-আমেরিকার সাম্প্রতিক বাস্তবতা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের কৌশলগত সম্পর্ক এবং ভূরাজনৈতিক গাঁটছড়া বিশ্বশান্তির জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও ইসলামি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়া এজেন্ডার প্রধান টার্গেটই হচ্ছে মুসলিম বিশ্বকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করা। জায়নবাদি ইহুদিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত লবি, কর্পোরেট অর্থনৈতিক গ্রুপ, মিডিয়া, থিঙ্কট্যাঙ্ক, রাজনৈতিক দল, গবেষণামূলক ও অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক সময় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের মধ্যে ভয় ও ঘৃনার সংস্কৃতি জিইয়ে রাখতে কাজ করতো। এর মধ্য দিয়ে তারা সমরশক্তি বৃদ্ধি ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার চেষ্টা করত, যাতে মার্কিন জনগণের ট্যাক্সের শত শত বিলিয়ন ডলার অপ্রয়োজনীয় অস্ত্র ভান্ডার গড়ে তোলার পেছনে ব্যয় করতে কোনো জবাবদিহিতা করতে না হয়। বলাবাহুল্য মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সে (এমআইসি) লগ্নিকারি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই জায়নবাদি ইহুদি ব্যাংকারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমেরিকা-ইউরোপ বা অন্য কোনো বহি:শক্তির আক্রমন বা আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাত ছাড়াই আকষ্মিকভাবে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অর্থনৈতিক লুন্ঠন টিকিয়ে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সামনে একটি নতুন জুজু হাজির করা খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল। সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই ইসলামিক টেররিজম এবং ইসলামোফোবিয়া এজেন্ডার সৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে তারা সোভিয়েত বাহিনীকে হটিয়ে দেয়া তালেবানদেরকেই প্রথম টার্গেটে পরিনত করে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্ব কায়েম হওয়ার পর আফগান তালেবানরা যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য সর্বাত্মক সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মূলত মার্কিন অর্থ, অস্ত্র, ট্রেনিং এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়েই পরাশক্তি সোভিয়েত বাহিনীকে হটিয়ে তালেবানরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর পরাজয় সোভিয়েতের ভাঙ্গন ত্বরান্বিত করেছিল। সমাজতান্ত্রিক বলয়ের এই ভাঙ্গন এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা সামলে উঠতে রাশিয়ার বেশ কয়েক বছর লেগেছিল। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে কোনঠাসা রাশিয়ার সেই স্থবিরতা ও নিরবতার সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পুরনো নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের এজেন্ডা সামনে রেখে একটি এককেন্দ্রিক(ইউনিপোলার) বিশ্বব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের উপর ভর করে গড়ে ওঠা কর্পোরেট অর্থনীতি এতদিন ধরে সোভিয়েত পারমানবিক আইসিবিএম (মহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা) কে লক্ষ্য করে যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বিশাল খাত গড়ে তুলেছিল সোভিয়েতের পতনের মধ্য দিয়ে তা অনেকটা কমে আসার বদলে তা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেল। তথাকথিত ইসলামিক টেররিজম ও ইসলামোফোবিয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশ কিছু কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তা জিইয়ে রাখা ও এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি ও আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে নতুন বিশ্ববাস্তবতার জন্ম দেয়া হয়। আটবছর ব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধ, সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখলের অজুহাতে প্রথম গাল্ফ ওয়ার এবং নাইন-ইলেভেনের পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধ পরিকল্পনার মধ্যে বাস্তব প্রয়োজনের তুলনায় মার্কিনীদের নেপথ্য ইন্ধন এবং কনস্পিরেসি কাজ করেছে। ইরানের সাথে সীমান্তযুদ্ধকে ৮ বছর প্রলম্বিত করে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সাদ্দাম সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে ঋণগ্রস্ত করে তোলা অত:পর ১৯৯০ সালে কুয়েত দখল করে কুয়েতের তেলসম্পদ হস্তগত করে ঋণ পরিশোধের গোপন এজেন্ডার মধ্যে মার্কিনীদের ভ’মিকা ছিল। বিশেষত: ঋণভারে জর্জরিত ইরাককে কুয়েতের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করে দিয়ে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ সুগম করার সুযোগ থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সউদি আরব ও মিশন সে ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভ’মিকা রাখেনি। সে সময়ে বাগদাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এপ্রিল গ্লাসপি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ করলে সাদ্দাম কুয়েতের উপর ইরাকের ভৌগলিক দাবীর প্রসঙ্গসহ সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিলে গ্লাসপি সাদ্দাম হোসেনের সিদ্ধান্তকে আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে অভিহিত করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের ইঙ্গিত দেন। জুলাই মাসের শেষ দিকে সাদ্দাম হোসেনের সাথে গ্লাসপির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের এক সপ্তাহের মধ্যেই ইরাক কুয়েত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। তবে কুয়েত দখলের পর ন্যাটো বাহিনীকে নিয়ে ইরাকের উপর সামরিক আগ্রাসন চালাতে দুইদিনও সময় নেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও সামরিক কমান্ডাররা।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যবস্থায় শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একাধিপত্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক যুদ্ধবাদী হয়ে উঠে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর তারা বড় কোনো যুদ্ধে সরাসরি না জড়ালেও সোভিয়েতের পতনের পর সিনিয়র বুশের শাসনামলে প্রথম গাল্ফ ওয়ার এবং নাইন ইলেভেনের পর জর্জ ডাব্লিউ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্রুসেড তথা অন্তহীন যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, প্রায় দুই দশক পেরিয়ে এসে দেখা যাচ্ছে, একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুদ্ধ শুরু করা হলেও বিশ্ব এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনিরাপদ ও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। আসলে তারা বিদেশের মাটিতে কেন কোন স্বার্থে যুদ্ধ করছে মার্কিন সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য তা জানেই না। একটি মিথ্যাকে আড়াল করতে আরো দশটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়, সে সব মিথ্যাকে ঢাকতে প্রতিদিন অসংখ্য মিথ্যা প্রোপাগান্ডার জন্ম দিতে হয়। মিথ্যা প্রোপাগান্ডার ভিত্তিতে শুরু হওয়া যুদ্ধের প্রতি জনসমর্থন এবং হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করার বৈধতা প্রমাণ করতে আরো অসংখ্য প্রক্সি ওয়ারের জন্ম দেয়া হয়েছে। এভাবে গত দুই দশকে অনেকটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক উপস্থিতি ও হস্তক্ষেপ কায়েম করা হয়েছে। মার্কিন ও ন্যাটো আগ্রাসনে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেনের মত দেশ অকার্যকর ও অস্থিতিশীল মৃত্যুপুরিতে পরিনত করতে ২০০১ সাল থেকে মার্কিন জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে সাড়ে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে। যেখানে গত অর্থবছরে মার্কিন সামরিক বাজেট ছিল ৭০০ বিলিয়ন ডলার, সেখানে গত দুই দশক ধরে শুধু বৈদেশিক সামরিক আগ্রাসনে বছরে ব্যয় করা হয়েছে সাড়ে ৩শ বিলিয়ন ডলার। যুদ্ধের বিবদমান পক্ষগুলোর ব্যয় ধরা হলে এসব যুদ্ধের ব্যয় অন্তত ১০ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াতে পারে। আর এই বিশাল সামরিক বাজেটের টাকা চলে গেছে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স ও ওয়ার কন্ট্রাক্টরদের ফান্ডে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। আবাসন, ম্যানুফেকচারিং খাতের পাশাপাশি ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক খাতের বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ ও অর্থনৈতিক খাতের শৃঙ্খলা ও কর্মসংস্থান রক্ষা করার নামে জনগণের ফান্ড বা রিজার্ভ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলারের বেইল-আউট প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হলেও তা তেমন কোনো কাজে আসেনি। যুদ্ধের ব্যয় এবং বেইলআউট প্রকল্পের সমুদয় অর্থই এমআইসি ও কর্পোরেট এলিট সিন্ডিকেটের ফান্ডে চলে গেছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাথীয় অর্থনীতি কখনোই মার্কিন জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা চালিত হয়নি। ফেডারেল রিজার্ভ থেকে শুরু করে এমআইসি পর্যন্ত কতিপয় পাওয়ার এলিট পরিবার ও কর্পোরেট গোষ্ঠির দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক কোনো রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান নয়, ১৯৩৫ সালের ব্যাংকিং অ্যাক্ট অনুসারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের নিয়োগে মনোনয়ন দিলেও সরকারের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ নেই। এটি একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান যা, মূলত ইহুদিদের দ্বারা পরিচালিত হয়। গত বছরের শুরুতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেরোম পাওলকে মনোনয়ন দেয়ার পর থেকেই ট্রাম্পের সাথে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। পাওয়েলের আগের তিন ফেড চেয়ারম্যান জানেট ইয়েলেন, বেন বার্নানকে এবং এলান গ্রীনস্প্যানের ধর্মীয় পরিচয় ও পারিবারিক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তাদের প্রত্যেকেই ইহুদি বংশোদ্ভুত। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার আগে এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী বিভিন্ন ফোরামে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী ভূমিকায় দেখা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি-অর্থনীতি, মিডিয়াসহ সমাজে ও রাষ্ট্রের প্রভাবশালী সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করে কতিপয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। বিশেষত বেসরকারি ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংকের হাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিসহ সারাবিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পরিচালিত হওয়ায় বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাদের হাতের ক্রীড়নকে পরিনত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংকট, বর্হিবিশ্বে তার ইমেজ ও আস্থার সংকট, জনগনের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতাকে তারা পরোয়া করে না। বিপুল সম্পদ কুক্ষিগত করার মাধ্যমে বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখাই তাদের মূল লক্ষ্য। বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতির এক নম্বর শক্তি ও কেন্দ্রভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের সাথে বিশাল ও বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রায় দেড়শ কোটি মানুষের দেশ চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শত শত কোম্পানীতে বিনিয়োগ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক ঋণের সবচেয়ে বড় অংশ চীনের কাছে। আবার শতকোটি মানুষের দেশ ভারত বা সউদি পেট্টোলিয়ামের উপর মার্কিন অর্থনীতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। এতসব বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক-রাজনৈতিক ফোরামের নাম আইপ্যাক (এআইপিএসি) আমেরিকান ইসরাইলী পিপলস অ্যাফেয়ার্স কমিটি। মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত মাত্র কয়েক মিলিয়ন জনসংখ্যার ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এতটা গুরুত্ব ও প্রাধান্য পায় কেন, এমন প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান নিহিত আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লিবারেল রাজনৈতিক মহল মার্কিন-ইসরাইল সম্পর্ককে দুষ্টচক্র বলে অভিহিত করছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী বার্নি সেন্ডার্স ইসরাইল ও সউদি আরবের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অস্বচ্ছতা এবং মার্কিন জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে ইসরাইলকে বছরে বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভ’-খন্ডে ইহুদি সেটেলমেন্ট ও বসতি স্থাপনের তৎপরতা এবং সীমাহীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে মার্কিন জনগণের পক্ষ থেকেও ইসরাইলে সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধের দাবী উঠেছে। গত সত্তুর বছরের ইসরাইলী দখলদারিত্বে ফিলিস্তিনীদের উপর টার্গেট কিলিং আগ্রাসন এক সপ্তাহের জন্যও বন্ধ হয়নি। বছরে এক দুইবার বড় ধরনের বিমান হামলা করে ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘর ও টানেল গুঁড়িয়ে দেয়া যেন ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের রুটিনওয়ার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ যুদ্ধও একদিনের জন্যও থেমে যায়নি। বড় ধরনের সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে গত এক দশকে অন্তত দুইবার লেবানরের হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের হামাসের কাছে চরম মার খেয়ে পরাক্রমশালী ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্স পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। একই সময়ে ট্রিলিয়ন ডলারের সমরসজ্জা নিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক-রাজনৈতিক বিজয় অর্জন দূরের কথা প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে আফগান তালেবানদের সাথে চুক্তি অথবা রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ করতে ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মানচিত্রের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। এহেন বাস্তবতায় বিশ্বসম্প্রদায়ের অভিপ্রায় ও জাতিসংঘের কনভেনশন লঙ্ঘন করে ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের উপর ইসরাইলের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করতে কূটনৈতিক তৎপরতা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথমে টু স্টেট সলিউশনের পুরনো মার্কিন নীতি থেকে সরে গিয়ে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক কনভেনশনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন ট্রাম্প। ইসরাইলের দুর্নীতিবাজ রক্তপিপাসু নেতা নেতানিয়াহুর সাথে ট্রাম্পের আনহোলি ্এলায়েন্সের সর্বশেষ নজির হচ্ছে, অধিকৃত এলাকায় ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপনকে তিনি বৈধতা দিয়ে নতুন আইন পাস করেছেন।

পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী নীল নকশায় মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনী আরবদের ভূমি দখল করে অবৈধভাবে ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীরা নিজেদের আধিপত্য কায়েম রাখতে গত ৭২ বছর ধরে আরব-ইসরাইল শান্তি আলোচনার নাটত করে আসছে। অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিনীদের মধ্যস্থতাকারীর মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জায়নবাদিদের ঝান্ডা তুলে নিয়েছেন। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর প্রেসক্রিপশন অনুসারে প্রথমে টু স্টেট সলিউশনের নীতি থেকে সরে গিয়ে জেরুজালেমে দূতাবাস স্থাপন, অত:পর অধিকৃত এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপনকে নীতিগত বৈধতা দেয়ার মধ্য দিয়ে আরব-ইসরাইল সংকটে নিরপেক্ষতা বা মধ্যস্থতা করার সব রকম ন্যায্যতা হারিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও মর্যাদাকে বিশ্বের কাছে হেয় করেছে বলে মার্কিন উদারপন্থী রাজনীতিকরা মনে করেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনী আরবদের প্রতি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নৃশংস ভ’মিকা তাঁকে ইসরাইলীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসক হিসেবে কুখ্যাতি দিয়েছে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ববাস্তবতা পাশ কাটিয়ে ইসরাইলের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসম বন্ধুত্ব বিশ্বশান্তির জন্য অনেক বড় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। বর্তমানে তা ইতিহাসের সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থান করছে। ঠিক একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে গদিচ্যুত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছেন। দেশি-বিদেশি জরিপ ও মাঠের বাস্তবতার বাইরে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে রাশিয়ানদের ইন্টেলিজেন্স হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠে এসেছিল। সে অভিযোগে তদন্ত ও ইমপিচমেন্টের কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা না হলেও এবার আগামী ২০২০ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ট্রাম্পের সম্ভাব্য ডেমোক্রেট প্রতিদ্বন্দি জো বাইডেনের বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে ইউক্রেন সরকারের উপর চাপ ও প্রভাব সৃষ্টির অভিযোগে ট্রাম্প এখন হাউজে তদন্তের সম্মুখীন। হাউজ স্পীকার ন্যান্সি পেলোসির আহ্বানে গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ভোটাভুটি, তদন্ত ও শুনানির পর গত সোমবার হাউজ ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম স্কিফ জানিয়েছেন, ইন্টেলিজেন্স কমিটি তাদের প্রাপ্ত তথ্য প্রমানাদি হাউজ জুডিসিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান জেরি নেডলারের কাছে হস্তান্তরের পর ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট আর্টিকেলের ড্রাফ্ট চুড়ান্ত করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আড়াইশ বছরের ইতিহাসে কোনো সিটিং প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য তদন্ত এবং ইমপিচমেন্টের এমন আয়োজন সম্ভবত এটাই প্রথম। অন্যদিকে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর গদিও নড়বড়ে হয়ে ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে। ইসরাইলের সিনেট প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অনিয়মসহ দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার সুনির্দ্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের তদন্তকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘উইচ হান্ট’ বলে অভিহিত করেছিলেন, ঠিক একই সময়ে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ইনডিক্টমেন্টকে লিকুদ পার্টির পক্ষ থেকে ‘উইচহান্ট’বলে অভিহিত করা হয়েছিল। গত সপ্তাহে ইজরাইলের এটর্নি জেনারেল এভিচাই মান্ডেলব্লিত নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আলাদা তিনটি ক্রিমিনাল করাপশনের অভিযোগ চুড়ান্ত করার ঘোষণা দেয়ার পর ইজরাইলের মধ্য ও বামপন্থী রাজনৈতিক নেতারা আর একদিনও নেতানিয়াহুর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার কোনো অধিকার নেই বলে পদত্যাগের দাবী জানিয়েছেন। নেতানিয়াহুর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বুøু অ্যান্ড হ্য়োাইট পার্টির নেতা বেনি গাঞ্জ বলেন, গত ১১ বছরে নেতানিয়াহু ইহরাইলের জন্য অনেক কিছুই করেছেন, তবে এই মুহূর্তে ইজরাইল রাষ্ট্রের জন্য তার সবচেয়ে বড় করনীয় হচ্ছে পদত্যাগ করা। এহুদ ওলমার্টের পর নেতানিয়াহু হতে যাচ্ছেন ইসরাইলের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হতে যাচ্ছেন। তবে নিজের গদি ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নেতানিয়াহু ইরানের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবেশি বা প্রতিপক্ষের সাথে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে নিজের ব্যক্তিগত ও দলীয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার প্রয়াস সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতিতে বিরল নয়।
bari_zamal@yahoo.com

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
সোয়েব আহমেদ ২৭ নভেম্বর, ২০১৯, ১০:৫১ এএম says : 0
সুন্দর লেখাটির জন্য জামালউদ্দিন বারী সাহেবকে অসংখ্য মোবারকবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন