আবদুল আউয়াল ঠাকুর : অচিরেই নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা সেটা বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। সরকার প্রধান হিসেবে তারই ঠিক করার কথা তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বানে সাড়া দেবেন কি দেবেন না। সস্প্রতি যে আলোচনা উঠেছে তা নিয়ে তার দলের নানাজন নানাকথা বলছেন। এই আলোচনার মধ্যেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের অনুমতি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মামলার সমন বেগম জিয়ার বাসায় ইতোমধ্যে টাঙিয়ে দেয়াও হয়েছে। আলোচ্য এই মামলা নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় এক আইনবিদ মন্তব্য করেছেন, যে ধারায় এই মামলাটি হয়েছে সেটি ৯৯ বছর ধরে থাকলেও এর কার্যকারিতা খুব খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, যে ধারায় এই মামলা হয়েছে তা বেগম জিয়ার আলোচ্য ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যাই হোক না কেন, বিগত ১/১১-এর সরকার রাজনীতি নির্মূল করতে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে যে সব মামলা করেছিল বর্তমান আমলে সেগুলোর ধারাবাহিকতা বহাল রাখা হয়েছে। এই মামলাটি তার বাইরে। নতুন আয়োজন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বেগম জিয়াকে রাজনীতির বাইরে রাখতেই এ উদ্যোগ। আলোচ্য মামলা নিয়ে যখন কথা শুরু হয়েছে ঠিক তখনই মার্কিন রাষ্ট্রদূত বেগম জিয়ার সাথে দীর্ঘ বৈঠক কেেরছেন। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০১৫ সালে বেগম জিয়া যখন সরকারি বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তখনও মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ ১১টি দেশের প্রতিনিধিরা একত্রে বেগম জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এ ব্যাপারগুলো এমন এক সময়ে ঘটছে যখন প্রধান বিচারপতির অবসরে গিয়ে রায় লেখাকে অসাংবিধানিক আখ্যা দেয়ার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ও বোদ্ধা মহলে নানামুখী আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই যে, প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের সাথে রাজনীতির চলমান বিতর্কের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।
প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের পরপরই অ্যাটর্নি জেনারেল তার অফিসে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে তার নিজস্ব বক্তব্য বলে অভিমত দিয়েছেন। অন্যদিকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সাম্প্রতিক বক্তব্যের পর কোন আইনজীবী যদি রিভিউ পিটিশন দায়ের করেন তাহলে বিগত দিনগুলোতে অবসরে যাওয়ার পর যে রায় লেখা হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ ও সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি করবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী এবিএম নুরুল ইসলাম বলেছেন, অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থী বলে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সংবিধানসস্মত। তিনি আরো বলেছেন, যতক্ষণ না কোন রায়ে বিচারপতি স্বাক্ষর করবেন ততক্ষণ রায় হবে না। অবসরের পর বিচারপতিরা কোন অফিসিয়াল অফিসার নন। সংবিধান অনুযায়ী রায়ে স্বাক্ষর না করা পর্যন্ত তাকে রায় বলার যাবে না এবং একজন বিচারপতি অবসরে যাবার পর রায়ে স্বাক্ষর করতে পারবেন না, রায় লিখতেও পারবেন না। প্রবীণ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মোবায়েদুর রহমানও তার গত মঙ্গলবারের কলামে ভারত-পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন অবসরে যাবার পর রায় লেখা অসাংবিধানিক। যে প্রসঙ্গ নিয়ে এত কথা শুরু হয়েছে তার ভিত্তি পঞ্চদশ সংশোধনী। সেই সংশোধনীর সাথে যিনি যুক্ত অর্থাৎ যার রায়কে কেন্দ্র করে এই বিতর্কের সূত্রপাত তিনি মুখ খুলবেন, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্যে অটল রয়েছেন। তার বক্তব্যের ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়েই মৌলিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রায় যদি অসাংবিধানিক হয় তাহলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে একটি গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচনের পথ পরিষ্কার হবে। একথাও সঠিক যে, ২০১৪ সালে যে নির্বাচনে অধিকাংশ জনগণ ভোট দিতে পারেনি সে নির্বাচনও কার্যত আদালতের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই টিকে রয়েছে। রায় নিয়ে সরকারের ভেতরকার অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের কেউ কেউ আগাম রায় দিয়ে ফেলেছেন। বলেছেন, এ নিয়ে আদালতে গেলে তা খারিজ হয়ে যাবে। অথচ মাত্র সেদিনই প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আদালতকে ডিক্টেট করার দিন চলে গেছে।
প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে তা শেষতক সংসদে গিয়েও পৌঁছেছে। মূলত সেখানেই যাবার কথা। সংসদে আইন মন্ত্রণালয় সস্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্য উস্কানীমূলক। রাজনীতি যখন স্থিতিশীল হয়ে অসছে তখন তিনি এ ধরনের কথা বলছেন। তিনি মনে করেন যে রেওয়াজ চলে আসছে সেটা চলবে। আমাদের ঠিক জানা নেই প্রধান বিচারপতিকে এ ভাষায় কথা বলা যায় কিনা। বাস্তবত তার এই বক্তব্যের মধ্যদিয়ে অসহায়ত্বই ফুটে উঠেছে। যদি সরকারে সাথে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী কেউ প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করতো তাহলে তার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত হতো? এটা বোধহয় বলা যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এবং দেশের আইন অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে সংবিধানের ব্যাখ্যাকারী। সে বিবেচনায় প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক যে পদমর্যাদা তাকে তার বক্তব্যের জন্য উস্কানিদাতা হিসেবে উল্লেখ করলে গোটা পরিস্থিতি কি দাঁড়াতে পারে বোধকরি সে ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সম্প্রতি বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের যে কথা আন্তর্জাতিক মহল জোরেশোরে বলতে শুরু করেছে সেটাই বোধহয় আরো বেশি সত্যে প্রমাণিত হবে। অন্যদিকে একথাও অস্বীকার করা যাবে না প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে যদি এ বিবেচনায় মনে করা হয় তাহলে সংবিধানের ব্যাখ্যার জন্য কারও কাছে যেতে হবে না। দ্বিতীয়ত, সংসদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে রেওয়াজের কথা বলেছেন, চলমান প্রেক্ষিতে তা খতিয়ে দেখা দরকার। রেওয়াজ বা প্রথা মান্য করার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটেন। দেশটিতে কোন লিখিত সংবিধান নেই। অথচ একারণে কোন সমস্যা হচ্ছে- তার কোন উদাহরণ নেই। তারা রেওয়াজ বা রীতিনীতিকে গ্রহণ করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সাম্প্রতিকম সময়ে দুনিয়াজুড়ে জঙ্গিবাদ নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছে সে আলোকে ব্রিটেনকে বিশ্লেষণ করলে প্রকৃতই বলতে হবে তারা বিদ্বেষ ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থাতেই রয়েছে। অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে ভুল গ্রেফতারের জন্য সংশ্লিষ্টদের বড় ধরনের জরিমানা দিতে হয়েছে। দেশটি আটক-কারাবাস এসব নিয়েও মানবাধিকারের প্রতি যথেষ্ট যতœবান। আর আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরে যা চলছে তাতে তো মানবাধিকার দূরে থাক মানুষ হিসেবেই কোন স্বীকৃতি নেই। একটি গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণ ভিত্তিক নির্বাচনের দাবিকে তথাকথিত জঙ্গি আখ্যা দিয়ে দেখামাত্র গুলির এখতিয়ার দেয়া হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। ঔপনিবেশিক আমলের কালো আইনকে আরো কালো বানিয়ে রাষ্ট্রশাসন প্রক্রিয়াকে যদি রেওয়াজ হিসেবে মনে করা হয় তাহলে বোধকরি সে রেওয়াজ সভ্য মানুষের হবার নয়। রেওয়াজই যদি বিবেচ্য হবে তাহলে গণতান্ত্রিক যাত্রা নিরঙ্কুশ করতে সকল দলের মতৈক্যে যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাজনীতিবিদদের সাধারণ ইচ্ছায় পরিণত হয়েছিল এবং যে ব্যবস্থা সে সময়ের প্রধান বিচারপতি মেনে নিয়েছিলেনই শুধু নয় তিনি এ ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন সে ব্যবস্থা কেন ভেঙ্গে দেয়া হলো? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অপরের মতের প্রতি সহনশীল হওয়াই তো রেওয়াজ। এখন বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশেরই কার্যত কোন সুযোগ নেই। দায়িত্বশীলদের আচরণে ভদ্রতা-সহনশীলতাই তো রেওয়াজ। সে বিবেচনায় সরকার রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি যা করছে এবং প্রধান বিচারপতির মন্তব্য প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যা বলেছেন তাকে কি কোন বিবেচনাতেই শালিনতার অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা যাবে? আর এটাকেই যদি রেওয়াজ বলে মনে করা হয় তাহলে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে আমরা কোন দেশে আছি?
দেশে মানবাধিকার লংঘনের দায়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত কয়েকদিনে দুইজন সরকারি কর্মকর্তাকে পুলিশের নাজেহাল করার বাস্তবতায় নানা মহলে যখন ক্ষোভ বিরাজ করছে তখন পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে জনগণের সেবক হতে বলেছেন। প্রতিটি পুলিশ সদস্যকে তিনি অসহায় বিপন্ন মানুষের পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়াতে বলেছেন। পুলিশকে মানুষ ভরসা করতে পারে এমন অবস্থা তৈরির জন্যও তিনি পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সময়ের বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানের যৌক্তিকতা অবশ্যই বিবেচ্য। মানুষ ও পুলিশে যে বিভাজনের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তার কারণ অনুসন্ধানও জরুরি। সধারণভাবে পুলিশই জনগণের বন্ধু বলে পরিচিত। সে অবস্থা এখন আর নেই। সাধারণ মানুষ পুলিশকে বিশ্বাস করছে না। পুলিশের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থাও যে নেই সে কথাই বেরিয়ে এসেছে বিবিসির প্রাসঙ্গিক আলোচনায়। সেখানে আক্রান্তরা বর্ণনা দিয়েছেন কিভাবে ঘুষের টাকা না দেয়ায় পায়ে গুলি করেছে কোন কোন পুলিশ। এরকম হাজারো চিত্র এখন বাংলাদেশে রয়েছে। এর মূল কারণের সাথে সম্পর্ক রয়েছে নীতি প্রণয়নের। দেশের সচেতন মহল বার বার বলে আসছে পুলিশকে অতিমাত্রায় রাজনৈতিক ব্যবহারের ফলে দেশে কার্যত সৃষ্টি হয়েছে অভাবিত নৈরাজ্য। মারাত্মক ক্ষমতায় ক্ষমতায়িত করার নেতিবাচকতাতেই পুলিশ নিজেকে রাজা দাবি করার সাহস পেয়েছে। তা সত্ত্বেও এ কথাই ঠিক যে, দেশের সচেতন মহল এবং আন্তর্জাতিক মহল যা বলছে তার ছোঁয়া পুলিশেও পড়েছে। পুলিশ সপ্তাহেই খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনেই পুলিশের কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, নেতা দলবল নিয়ে এসে থানায় হামলা করল, পুলিশকে মারধর করল কিন্তু তার কোন বিচার হলো না। প্রকাশিত খবর অনুযায়ি মন্ত্রী সচিব ও আইজিপির সামনেই পুলিশ কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে বলা হয়েছে আমরা সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করি। পান থেকে চুন খসলে কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের তদবির না শুনলে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করা হচ্ছে। আমাদের নাজেহাল করতে ঘন ঘন বদলি করা হয়। এটা বোধহয় সহজেই বোধগম্য যে, পুলিশ সদস্যরা যে শ্রেণীর রাজনীতিকদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা কোন বিবেচনাতেই সরকারের সাথে ভিন্নমতাবলম্বী নন। তারা সরকারি দলের। কারণ রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীরা তো ঘরেই থাকতে পারছে না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও শপথ নিতে পারছে না। অতএব তাদের পক্ষে পুলিশের ধারে-কাছে যাওয়াও সম্ভব নয়। বিরোধীদের ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষকরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে নির্যাতন নিগ্রহ সেটাই আন্তর্জাতিক মহলে মানবাধিকার লংঘনের গুরুতর অভিযোগ। মানবাধিকার লংঘনের গুরুতর অভিযোগ যে বাহিনীকে ঘিরে তার সদস্যরাই বেতন ভাতা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনেই। পুলিশও কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবহারের বিপক্ষে দাঁড়াতে চাচ্ছে। অন্তত গত পুলিশ সপ্তাহের নানা প্রসঙ্গ সে কথাই বলছে। পুলিশ ও জনগণের মধ্যে যে বিরূপ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা ভাঙতে প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন। বোধকরি সে ক্ষেত্রে সরকারে ভূমিকাই প্রধান। পুলিশকে পুলিশের মতো থাকতে দিলে হয়তো অনেক অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো। অবশ্যই পুলিশকে মানুষের বন্ধু হতে হবে। তাকে মানবাধিকার সংরক্ষণে যতœবান হতে হবে। এ প্রসঙ্গে উচ্চতর আদালতের একটি রায়ের বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার এবং পুলিশ রিমান্ডের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা একযুগেও বাস্তবায়িত হয়নি। পাঁচ বছর আগে ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে ছয় মাসের সময় নিয়েছিল। সম্প্রতি পুনরায় মামলাটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসলে সরকার পুনরায় সময়ের আবেদন করেছে। আপিল বিভাগ সরকারের আবেদন মঞ্জুর করে নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জানাতে বলেছেন। ১৯৯৮ সালে ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র রুবেল ডিবি পুলিশের হেফাজতে মারা গেলে একাধিক মানবাধিকার সংস্থা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার অপব্যবহারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঐ সালে আদালতে রিট করলে আদালত এক রায়ে এ দুটি ধারার বিষয়ে প্রচলিত আইন সংশোধনের নির্দেশ দেন। আইন সংশোধনের পূর্বে হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যে ১২টি নির্দেশনা উচ্চতর আদালত দিয়েছেন তা মেনে চললে কার্যতই চলমান বিতর্ক ওঠার কোন সুযোগ নেই। এখনকার সময়ে এটা পরিষ্কার যে, সে সময়ের রুবেল এবং বর্তমান সময়ের ইলিয়াস আলীসহ যারা হত্যা নির্যাতনে নিঁেখাজ হয়েছেন বা রয়েছেন তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। পুলিশের সদাচার নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, উচ্চতর আদালত যখন কুকুর হত্যায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে কোন সময় নেয়া না হলেও নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্ন যখন এসেছে তখন চলছে টালবাহানা। এই দৃষ্টিভঙ্গি কোন বিবেচনাতেই মানবাধিকাররপন্থী নয়। শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়। উচ্চতর আদালত যখন গ্যাস ও বিদ্যুতের অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধির কারণদর্শাতে বলেছেন তখন দেখা যাচ্ছে, সরকার বাসাবাড়িতে গ্যাসের সরবরাহই বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় এখন তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। গ্যাস নিয়ে কোটি কোটি মানুষ এখন ভোগান্তির শিকার। এতোদিন চুলা টিমটিম করে জ্বললেও এখন আর জ্বলছেই না। বেশিরভাগ এলাকাতেই দিনের বেলা একেবারেই গ্যাস থাকছে না। কোন কোন এলাকায় রাত ১০টার আগে চুলা জ্বলছে না। গ্যাস সংকটের কারণে রাজধানীর বেশ কয়েকটি সিএনজি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকার কারণে গত কয়েক বছর ধরেই এটা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল যে শীতের তীব্রতা বৃদ্বি পেলে গ্যাসের সরবরাহ কমতে থাকে। এবারেও হয়ত তেমনটাই হয়েছে বলে মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, শীতের সময়ে সকালের দিকে গ্যাস চলে গেলেও বিকেল বা সন্ধ্যা নাগাদ তা ফিরে আসত। গত দুএক বছরে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। গত শীতেও দেখা গেছে শীত যাই থাক গ্যাস সংকট ঠিকই রয়েছে। এবারে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। দিন রাত কখনোই চুলায় গ্যাস থাকছে না। এ ব্যাপারটি বাস্তবতার সাথে মেলে না। কারণ দিনের বেলায় বাণিজ্যিক সরবরাহ তথা সব কিছু চালু থাকার করণে বাসাবাড়ির রাইজার অবাণিজ্যিক হবার কারণে তারা বঞ্চিত হতো। স্বাভাবিকভাবেই সরবরাহ কম হতো। অর্থাৎ রাতে স্বাভাবিকভাবেই সরবরাহ বেড়ে যেত। এটাই হবার কথা। এবারে তা হচ্ছে না। দিন রাত সবসময়েই চুলা প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছে না। বিষয়টিকে অস্বাভাবিক বা কৃত্রিম মনে করার সংগত কারণ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রও সে রকমই মনে করছে। আদালত থেকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে কারণ দর্শানোর জন্য বলার পর সংশ্লিষ্টরা নাকি নতুনতর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- যার আওতায় এমন বাস্তবতা তৈরি করা হয়েছে যাতে গ্রাহকরা আপনাতেই গ্যাসের সংযোগ নিতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা মনে করছেন, সরকার ইতোপূর্বেও আবাসিক সংযোগ বন্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পর্যায়ক্রমে সেটাই বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছে। বাসাবাড়িতে সংকট মেটাবার জন্য নয় বরং বাসাবাড়িতে সংযোগ বন্ধ করার প্রয়াস থেকেই রেশনিং করা শুরু হয়েছে। এটাই সংকটের মূল কারণ। অনেকটা গোপন এই সিদ্ধান্তে পোয়াবারো এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজের। দুর্নীতিবাজদের আলোচনা শুধু এক্ষেত্রেই নয় বরং বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়েও লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। এসব প্রসঙ্গ এখন ওপেনসিক্রেট। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় সকলেই প্রায় একমত পোষণ করেন যে, নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার ফলে কার্যত সমাজ থেকে সর্বশেষ জবাবদিহিতাও উঠে গেছে।
উচ্চতর আদালত থেকে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়কে আইনে পরিণত করতে তৎপরতার অভাব ছিল না। ঐ প্রধান বিচারপতির কাছে দুস্থ ফান্ডের টাকা একজন এমপি পৌঁছে দিয়েছিলেন বলে খবর রেরিয়েছিল। নজিরবিহীন ধারায় মামলা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। প্রধান বিচারপতির কথায় কাঁপন শুরু হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে বলা হচ্ছে উস্কানিদাতা। দেশের ৬৮ভাগ মানুষ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এবং নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে তখন টালবাহানার কোন সুযোগ নেই। পরিস্থিতি যে গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে, তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। সে কারণেই অধিকার হরণ নয় বরং জনগণের অধিকার বিশেষ করে ভোটাধিকার ফেরত দিতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়াই সময়ের দাবি।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন