শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে প্রধানমন্ত্রী মহাদুর্নীতি ও স্বার্থবিরোধী চুক্তি আড়াল করতে চান -রিজভী

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৫:২০ পিএম

আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসা রটনা করে প্রধামন্ত্রী নিজেদের অবৈধ সত্ত্বা এবং মহাসমারোহে দুর্নীতি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিকে আড়াল করতে চান বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী একই মিথ্যা ও কল্পিত কাহিনী বারবার প্রচার করে সত্য রূপে প্রতিষ্ঠা করতে চান। কারণ শেখ হাসিনার গুরু হচ্ছেন গোয়েবলস্সহ নাৎসীরা, কোন মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়ক বা চিন্তানায়করা নন। সোমবার (২ ডিসেম্বর) বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

রুহুল কবির রিজভী বলেন, নেদারল্যান্ডসের টিউলিপ কোম্পানির সঙ্গে কম্পিউটার আমদানির চুক্তি বাতিল সম্পর্কে শেখ হাসিনা আবারো মিথ্যে গালগল্প ফেঁদেছেন। কয়েকদিন আগে গণভবন এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “খালেদা জিয়ার প্রতিহিংসার কারণেই দেড় যুগ আগে চুক্তি করেও নেদারল্যান্ডসের ‘টিউলিপ’ কোম্পানির কম্পিউটার না নেওয়ায় সরকারকে ৩২ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়েছিল। খালেদা জিয়াকে বোঝানো হল যে, শেখ রেহানার মেয়ের নাম টিউলিপ। এই কোম্পানির নাম টিউলিপ ওদের কম্পিউটার নেওয়া যাবে না। নেদারল্যান্ডসের টিউলিপ কোম্পানি বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করলে বাংলাদেশ হেরে যায় এবং ক্ষতিপূরণও দিতে হয়।” রিজভী বলেন, শেখ রেহেনার কন্যা টিউলিপের নামের সঙ্গে কোম্পানির নামের মিল থাকার কারণেই বেগম খালেদা জিয়া চুক্তি বাতিল করেছিলেন-প্রধানমন্ত্রীর এই গাল গল্পের সূত্র কী?

তিনি বলেন, এখন চারদিকে চলছে মিথ্যার বেসাতি, রাজনৈতিক পাপাচার আর বাচালতা। প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিন নিত্যনতুন আজগুবি গল্প ফাঁদেন। তার কথা বরাবরই অতিকথনে দুষ্ট। বেগম খালেদা জিয়া যদি প্রতিহিংসাপরায়ণ হতেন তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কারাগারে থাকতেন। কিন্তু সেই ধরণের প্রতিহিংসাপরায়ণ দৃষ্টান্ত বেগম খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপি’র নেই। তবে বাংলাদেশের জনগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগের প্রকল্প মানেই দুর্নীতির মহাধুমধাম। তারা ২০১২ সালে একবার ‘দোয়েল কম্পিউটার’ নামে একটি প্রকল্প উদ্বোধন করেছিল। সেই ‘দোয়েল’ কোথায় উড়ে গেছে তা জনগণ কিছুই জানেনা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, গত এক দশকে দেশ থেকে নয় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেলো, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে গেলো আটশো দশ কোটি টাকা। বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এভাবে রাষ্ট্রীয় মদদে নানা উপায়ে চলছে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠন। অথচ, ¯্রফে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বেগম জিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় আদালতের দোহাই দিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাকে যথোপোযুক্ত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছেনা, জামিনও দেয়া হচ্ছেনা। জামিন নিয়ে মাসের পর মাস ধরে গড়িমসি করা হচ্ছে। কেন এই গড়িমসি, কেন এতো অজুহাত? জনগণের বুঝতে কিছুই বাকি নেই।

রিজভী বলেন, কিছুদিন আগে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নামে লোক দেখানো অভিযানে চুনোপুঁটিদের ধরার পর গণমাধ্যমে যেই রাঘব বোয়ালদের নাম বের হয়ে আসতে লাগল তখনই অভিযান বন্ধ করে দেয়া হলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেসনোট দিয়ে গণমাধ্যমে দুর্নীতির খবর প্রকাশে বিধি নিষেধ আরোপ করা হলো। অথচ প্রধানমন্ত্রী এখনও অভিযান নিয়ে মিথ্যা বলেই যাচ্ছেন। গতকালও বিদেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দুর্নীতি বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী, শেয়ারবাজার লুটপাটকারী, উন্নয়নের নামে সারাদেশে যে হরিলুট এই ১১ বছরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে না কেন? ভোটের আগের রাতে ভোট ডাকাতি করে জনগণের ভোটের অধিকার ক্ষুন্নকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান যে চলবে না তা জনগণ জানে। যদি সত্যিকার দুর্নীতি বিরোধী অভিযান করতে হয় তাহলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। সেই সৎ সাহস প্রধানমন্ত্রী রাখেন না। ভোগ-লালসায় অস্থির থাকায় যারা মানবিক বিবেচনাগুলো পদদলিত করছে তারা কখনোই ন্যায়সঙ্গত কাজ করতে পারে না।

বিএনপির এই নেতা বেগম জিয়ার মুক্তি দাবি করে বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলবেন না। জামিনে বাধা সৃষ্টি করবেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইন-আদালত কব্জায় নিয়ে সাজানো মিথ্যা মামলা দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নাজেহাল করা হচ্ছে জনগণ তা আর বেশি দিন মেনে নিবে না। জনগণ কাউকেই ক্ষমা করবেনা। অবিলম্বে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন। তাঁকে তাঁর পছন্দ অনুযায়ী বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা করার সুযোগ দিন।

টিউলিপ চুক্তি বাতিলের তিনটি কারণ উল্লেখ করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, আসলে টিউলিপ কোম্পানির সাথে করা চুক্তিটি ছিল দুর্নীতি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির একটি খারাপ নজির। বিএনপি সরকার এই চুক্তি বাতিল করেছিল তিনটি কারণ দেখিয়ে। এক. আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের তুলনায় দ্বিগুণ মূল্যে কম্পিউটার কেনার এই চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তি বাতিলের পর বিএনপি সরকার অন্যান্য দেশ থেকে টিউলিপের সাথে চুক্তির প্রায় অর্ধেক দামে কম্পিউটার আমদানি করেছিল। দুই. চুক্তির শর্তাবলীর সবই ছিল কোম্পানির পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে। তিন. চুক্তির শর্তানুযায়ী নেদারল্যান্ডস অনুদানের প্রায় ৫০ কোটি টাকা বাংলাদেশকে দেয়নি।

তিনি বলেন, ওই চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডসের আভ্যন্তরীণ আদালতের রায় অনুযায়ী বিএনপি সরকার এবং পরবর্তীতে জরুরী অবস্থার সরকার কেউ-ই ক্ষতিপূরণ দেয়নি। সিদ্ধান্ত ছিল আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আইনি লড়াই ছেড়ে দিয়ে টিউলিপ কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেয় রাষ্ট্রীয় অর্থে। অথচ বাংলাদেশ ডাচ সরকারের কাছ থেকে একটি টাকাও পায়নি, একটি কম্পিউটারও নয়। ২০১১ সালে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী সরকার ওই কোম্পানির লোকদের ২ মিলিয়ন ১৩০ হাজার ইউরো বা ২৩ কোটি টাকা পৌঁছে দেন কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে। জরিমানার নগদ টাকা ছাড়াও মামলা চালানোর খরচ ও এটর্নি জেনারেলসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার নেদারল্যান্ড সফরে সরকারি তহবিল থেকে আরও খরচ হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫ কোটি নগদ টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদনকারী শেখ হাসিনার সরকার এর দায়দায়িত্ব এড়াতে পারবেন কী?

বিএনপির এই নেতা চুক্তির তথ্য তুলে ধরে বলেন, শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের ইআরডি সচিব ও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান সেই সরকারের আমলের শেষের দিকে এক শুক্রবার ছুটির দিনে অত্যন্ত গোপনে মারাত্মক গলদপূর্ণ ওই চুক্তি করেছিলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামত উপেক্ষা করে। ওই চুক্তি অনুযায়ী টিউলিপ কোম্পানির কাছ থেকে ১০ হাজার ৩৮৮টি কম্পিউটার ও কিছু আনুষঙ্গিক সামগ্রী কেনার কথা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ওই প্রকল্পে প্রায় ৫০ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে নেদারল্যান্ড সরকারের আর বাকি ৫০ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডাচ সরকার অনুদানের সে টাকা দেয়নি।

রিজভী বলেন, ২০০৪ সালের ৭ জুন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির প্রধান হিসাবে বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সুষ্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন: ‘তারা আমাদেরকে টাকা দেয়নি, কম্পিউটারও দেয়নি। তবে আমরা কেন তাদের দেশের আদালতের রায় অনুযায়ী তাদেরকে ক্ষতিপূরণের টাকা দেবো? এমন একতরফা চুক্তির কথা আগে কখনও শুনিনি। কেবিনেটে সিদ্ধান্ত হয়েছিল আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কেন এত কঠিন শর্ত মেনে চুক্তিটি হয়েছিল তা খতিয়ে দেখতে কেবিনেট মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় এবং এমনতরো একতরফা চুক্তি সম্পাদনের জন্য মসিউরকে দায়ী করা হয়। তদানিন্তন কেবিনেট সচিব ড. সা’দত হোসাইনও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ বা ইআরডি’র এমন চুক্তি সম্পাদনের সমালোচনা করেন। এসব তথ্য তদানিন্তন সংবাদপত্রে বিশদ প্রকাশিত হয়।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ১৫ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয় আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্টের জন্য এটর্নি জেনারেলকে অনুরোধ জানানোর। ২০১০ সালের শেষের দিকে এটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে শিক্ষা, আইন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ১২ সদস্যের একটি দল নেদারল্যান্ড গিয়ে টিউলিপ প্রতিনিধিদের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া করেন। এরপর নেদারল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আলী সরকার ও টিউলিপের পক্ষে জে এল এম গ্রয়েনিউজেন ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে একটি চুক্তিতে সই করেন এবং তাদেরকে রাষ্ট্রীয় তহবিলের দুই মিলিয়নের বেশি ইউরো দেয়া হয়। একটি জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদন এবং তা রক্ষার জন্য আইনি লড়াই এড়িয়ে এতো বছর আদালতের বাইরে বোঝাপড়া করে বিদেশি কোম্পানিকে রাষ্ট্রীয় অর্থে ক্ষতিপূরণ দেয়ার পুরো প্রক্রিয়াটাও গোপনে ও অস্বচ্ছভাবে চালানো হয়েছে। মনে হয়েছে জাতীয় স্বার্থের বদলে ভিনদেশি একটি কোম্পানির স্বার্থ খাতেই যেন শেখ হাসিনার সরকার বেশি আগ্রহী।

এসময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবুল খায়ের ভূইয়া, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ প্রমূখ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন