বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

তীব্র খাদ্য সঙ্কটে বিপন্নের পথে হাতি

শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার থেকে | প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

প্রবাদ আছে ‘এক সময় কক্সবাজার অঞ্চলে সূর্য দেখা যেতনা’। তার মানে বনাঞ্চলে এত বেশী গাছ গাছালী ছিল যার কারণে সূর্যের আলো মাটিতে পড়তনা। এই বনাঞ্চল ছিল বাঘ-ভাল্লুক, হরিণ-হাতিসহ বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। এখন অব্যাহত পাহাড় কাটা, বন উজাড় হওয়ায় খাদ্য সঙ্কট ও চলাচলের বন্ধ হওয়ায় মহাসঙ্কটে পড়েছে হাতিসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এতে করে বিপন্ন হয়ে পড়েছে হাতির জীবন।
আগে প্রবীণদের মুখে গল্প শুনা যেত হাতির জন্য কক্সবাজারে রাস্তা পারাপার ছিল দুস্কর। এমনকি অতীত নিকটে টেকনাফে ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পানেরছড়া এলাকায় এই প্রতিবেদকেরও ঝাঁকে ঝাঁকে হাতি দেখার সুযোগ হয়েছে।
কক্সবাজারের বনাঞ্চলে এত বেশী হাতির অস্থিত্ব ছিল যে, কোন কোন সময় রাস্তায় হাতি চলাচলের কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যেত। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের রামুর পানেরছড়া বনাঞ্চল এলাকায়, টেকনাফের নাফথং এলাকায় এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকায় ও চকরিয়ার খুটাখালী এলাকায় হাতি চলাচলের কারণে রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যেত অনেকক্ষণ ধরে। তখন কিন্তু লোকালয়ে হাতির উপদ্রব আজকের মত ছিল না।
কালক্রমে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় বন্যহাতির পাল বনাঞ্চল ছেড়ে লোকালয়ে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। হাতির খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ায় লোকালয়ে গাছপালা এবং ক্ষেতে হাতির আক্রমণ বেড়েছে বলে জানা গেছে।
পাহাড় কাটা ও বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় একদিকে হাতির খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে, অপরদিকে বন্ধ হয়ে গেছে হাতি চলাচলের বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং তিব্বতের পাহাড়গুলোর সাথে হাতি চলাচলের পথ। সা¤প্রতিক সময়ে হাতি চলাচলের পথে তৈরি হয়েছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, সরকারি দালানকোঠা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর কারণে হাতি চলাচলেও তাদের খাবারে দেখা দিয়েছে দারুণ সঙ্কট।
খবর নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভাগের বিভিন্ন এলাকায় অবাধে চলছে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটা। এতে বন দস্যুদের পাশাপাশি রেঞ্জ কর্তৃক দায়িত্ব পালনে অবহেলাও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বনাঞ্চল নিধনের কারণে বিপন্ন হচ্ছে বণ্যপ্রাণির আবাসস্থল পাহাড়। বন্যহাতির পছন্দের খাবার পাহাড়ের কলাগাছসহ বিভিন্ন রকমের পাহাড়ি গাছগাছালি নিধনের ফলে একদিকে বন হারাচ্ছে সৌন্দর্য্য, অন্যদিকে বন্যপ্রাণিরা আহারের খুঁজে ছুটে যাচ্ছে লোকালয় এবং জনবসতি এলাকায়। এতে হতাহত হচ্ছে লোকালয়ের মানুষ। আবার অনেক ক্ষেত্রে মানুষের আক্রমনেও মারা পড়ছে।
স¤প্রতি ফুলছড়ি রেঞ্জের আওতাধিন খুটাখালী, মেদাকচ্ছপিয়, কোনাপাড়া, পার্ক অফিস, সেগুনবাগিচা, গোলডেবা, নতুন অফিস জুমনগর লোকালয়ে বন্যহাতির বিচরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। একইভাবে রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও চকরিয়ার বিভিন্ন এলাকার লোকালয়ে বন্য হাতির বিচরণ ও আক্রমণ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। এভাবে গত ১০ বছরে কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় হাতির আক্রমণে হতাহত হয়েছে নারী শিশুসহ অর্ধশতাধিক আদম সন্তান। আর হাতি মারা পড়েছে প্রায় ডজন খানেক।
হাতি চলাচলের কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের বালুখালি এবং কুতুপালং এলাকায় গড়ে উঠেছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিশাল শিবির। এছাড়াও হাতি চলাচলের রাস্তাগুলোতে গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। এতে করে একদিকে খাদ্য সঙ্কট ও অনয় দিকে চলাচলের পথ বন্ধ হওয়ায় মহাবিপদে পড়েছে বন্য হাতি।
প্রতি বছর এভাবে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য বসত ঘর, কাঁচা-পাকা ফসল ও মূল্যবান গাছ পালা। এতে করে কেউ হারাচ্ছে পরিবারের কর্তাকে। আবার কেউ হারাচ্ছে প্রজন্মকে। আবার কেউ হারাচ্ছে কষ্টার্জিত শস্য ফসল বা বাগানের গাছপালা।
সচেতন মহল মনে করেন, হয়তো প্রকৃত দায়িত্ব পালন না করায় বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে বন দস্যুদের হাতে। আবার ক্ষেত্র বিশেষে বনাঞ্চল উজাড়ে প্রকৃত আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না এমন অভিযোগও রয়েছে ভুক্তভোগিদের।
ব্যাপক হারে বনাঞ্চল উজাড়ের ফলে একদিকে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বন্য জীব জন্তুও হারিয়ে যাচ্ছে। বাঘ-ভাল্লুক-হরিণ-বানর তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে কক্সবাজারের বনাঞ্চল থেকে।
এদিকে বন্য হাতির আক্রমনে যারা ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছেন তাদের মৃত ব্যক্তির পরিবারকে বন বিভাগ থেকে ১ লাখ টাকা, আহতদের ৫০ হাজার ও ফসল ক্ষতিগ্রস্থদের ২০/২৫ হাজার টাকা দেয়ার কথা থাকলেও এই ক্ষতিপূরণও ভুক্তভোগীরা ঠিকভাবে পায়না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন