শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

গুলশান লেক মশার কারখানা

ময়লা আবর্জনা ও দুর্গন্ধে অভিজাত এলাকাবাসী নাকাল

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

লেকের পচা পানির দুর্গন্ধ আর মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী ও বারিধারার বাসিন্দারা। গুলশান লেকের পচা পানির দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারিদিকে। লেকটির বিভিন্ন অংশে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া ও যততত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে এ লেকের পানি শুধু পচেই যায়নি বিষাক্তও হয়ে গেছে। লেকের পচা পানি ও ময়লা-আবর্জনায় জন্মাচ্ছে মশা। বলা যায়- গুলশান লেক এখন মশার এক প্রজনন কেন্দ্র। একদিকে মশার যন্ত্রণা অন্যদিকে লেকের পচা পানির দুর্গন্ধে নাকাল অভিজাত এলাকার বাসিন্দারা।
গতকাল লেকের পাড় ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে সুয়ারেজ লাইনের মলমূত্র এবং অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা গড়িয়ে পড়ছে লেকের পানিতে। বিভিন্ন এলাকা থেকে ম্যানহোল হয়ে পয়োবর্জ্য পড়ছে লেকের পানিতে। মলমূত্র আর ময়লা-আবর্জনার স্তূপে কোথাও কোথাও চর জেগে উঠছে। পানির ওপর ভাসা মল ও ময়লা-আবর্জনার স্তর দিন দিন ভারি হচ্ছে। লেকের কোনো কোনো অংশে পানিতে ভাসা মল আর আবর্জনার স্তরের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

লেকের পানি পচে বিবর্ণ হয়ে কুচকুচে কালো, আবার কোথাও সবুজ রং ধারণ করেছে। পানি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। গুলশান, বনানী, বারিধারা ও বাড্ডা লেকের বিভিন্ন অংশে ঘুরে দেখা গেছে, লেকের প্রায় সব অংশ থেকেই পচা পানির দুর্গন্ধ ভাসছে বাতাসে। লেকের পাড়ে লাউ মাচায় কাজ করা শ্রমিক ইদ্রিস মিয়া বলেন, আমরা ছোট বেলায় যে পানিতে গোসল করতাম। সে পানির দুর্গন্ধে এখন লেকের পাশে সুস্থভাবে আধাঘণ্টা বসা যায় না।

লেকে পাড়ে ঘুরতে আসা হাবিবুর রহমান নামের এক তরুণ বলেন, গ্রাম থেকে আসা ছোট ভাইকে হাতিরঝিল ও গুলশান লেক দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছি। ইচ্ছা ছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব। কিন্তু পানি থেকে আসা দুর্গন্ধের কারণে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। তিনি বলেন, গুলশান লেকের পানি এতোটাই পচে গেছে যে এখানে কোনো সুস্থ মানুষ আধাঘণ্টা থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা আর পানির গন্ধও দিন দিন তীব্র হচ্ছে।

গুলশান চেয়ারম্যান বাড়ির পাশের লেকের পানি থেকে গত কিছুদিন আগে ময়লা-আবর্জনা তোলা হয়েছে বলে ওই এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ময়লা-আবর্জনা তুলে লেকের এক কোনে স্ত‚প করে রাখা হয়েছে। ময়লা-আবর্জনা তোলার পর লেকের পচা পানি এতোটাই কালো দেখাচ্ছে, দূর থেকে দেখলে পোড়া মোবিল বলে কেউ ভুল করতে পারে। আর পচা পানির প্রকট দুর্গন্ধে বেশিক্ষণ সময় লেকপাড়ে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। পুরো লেকটি নিয়মিত পরিস্কার না করায় এটি এখন আবর্জনার ভাগাড়। আর এ নোংরা-আবর্জনায় জন্মাচ্ছে মশা। এসব জলাশয় এবং নিষ্কাশন নালাগুলোকে মশার আদর্শ প্রজননকেন্দ্র বলছেন কীটতত্ত¡বিদরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, লেকে নিয়মিত মশা মারার ওষুধ দেয়া হচ্ছে। পরিচ্ছন্ন করে লাগানো হয়েছে নানা জাতের ফুলগাছ। আরাম করে বসা যায় এমন একাধিক বেঞ্চ বসানো হয়েছে লেকেরপাড় ঘেঁষে। ভাঙ্গাচোরা ইট, সিমেন্ট, টাইলস ও সিরামিকের বিভিন্ন জিনিস পরিস্কার করে ঝোপঝাঁড় কেটে ফেলা হয়েছে। বীজ ছিটিয়ে দেয়ার পর সেখানে গজাচ্ছে হালকা সবুজ ঘাস। তিনি বলেন, লেক মশা উৎপাদনের উৎপত্তিস্থল কথাটি ঠিক নয়।
নিকেতন এলাকার বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বলেন, ডোবা-নালা পরিষ্কার না করায় মশার উপদ্রব বেড়েছে, এগুলো কোনোদিন পরিষ্কার করা হয় না। মশার ওষুধও ছিটানো হয় না। তিনি বলেন, ডিএনসিসি’র মেয়রের কথা মতো দিনে দুইবার মশার ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও আমি কখনও ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। তবে বেশ কিছুদিন আগে ডেঙ্গুর মহামারির সময় মাঝে মধ্যে বিকাল বেলায় ধোঁয়া দিয়ে যেতে দেখেছি। এতে তেমন একটা লাভও হয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ ধোঁয়া দিয়ে চলে যাওয়ার পরপরই মশার উৎপাত শুরু হয়ে যেতো। তিনি বলেন, এখন তো মশার যন্ত্রণায় কোথায়ও দু’দÐ দাঁড়ানোই যায় না।

এছাড়ও রাজধানীর খিলক্ষেত, কুড়িল, জোয়ার সাহারা এলাকার ডোবাগুলোও অপরিষ্কার। বদ্ধ পানিতে জন্মাচ্ছে মশা। এলাকায় বহুদিন মশার ওষুধ ছিটানো হয় না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। বনানী এলাকার ১১ নম্বর রোড়ের হাসমত আলী বলেন, মাঝে মাঝে দেখি ধোঁয়া দিয়ে যায়। কিন্তু এইসব ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে না। আমি কোনো সময় দেখি নাই। লেক ডোবা-নালায় পরিণত হয়েছে।
গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন, রামপুরাবাসীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে, রাউজক, গণপূর্ত অধিদফতর, সিভিল অ্যাভিয়েশন, রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান জলাশয়গুলোর মালিক, কিছু আছে ব্যক্তিগত। তাদের ভাষ্য, এসব জলাশয় পরিষ্কারের জন্য কর্পোরেশনের আলাদা বাজেট নেই, তাছাড়া এগুলো পরিষ্কারের দায়িত্বও তাদের নয়।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাতিরঝিল ও গুলশান লেকেরপাড়ে প্রতিদিন বহু মানুষ ঘুরতে আসে। অথচ দুর্গন্ধে লেকের পাশ দিয়ে হাঁটা দুষ্কর। লেকের দুইপাড়ে ময়লার স্তূপ ছাড়াও নালা বা পাইপের মাধ্যমে পানিতে এসে পড়ছে আশপাশের ময়লা ও দূষিত পানি। পানি দূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে গেছে যে ওই লেকে মাঝে মধ্যেই মরা মাছ ভাসতে দেখা যায়। জানা গেছে, বনানী কবরস্থান, বনানী চেয়ারম্যান বাড়ী ও গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকা দিয়ে লেকে ওয়াসার ময়লা পানি ফেলা হচ্ছে, যা পানিদূষণের অন্যতম কারণ।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, বাড্ডা এলাকার গুদারাঘাট সংলগ্ন লেকের পাড়ে অবৈধভাবে দোকানপাট আর বাজার বসানো হয়েছে। প্রায়ই মাছের বাজারও বসানো হয়। পেঁয়াজের খোসা, মাছের বর্জ্য, পচা সবজির স্তূপ, নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ফেলে ভরাট করা হচ্ছে লেকেরপাড়। এতে নষ্ট হচ্ছে লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মাঝেমধ্যে লেকের পানিতে কুকুর-বিড়ালের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়। মৌসুমি ব্যবসায়ী গুদারাঘাট সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা জাহিদ ব্যাপারী বলেন, ‘এই পানি বিষাক্ত হয়ে গেছেগা। এখানে মাছ ছাড়লেও মাছ মইরা যাইব।’ গন্ধে এর আশপাশে হাঁটা যায় না।

ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা আব্দুল জব্বার বলেন, লেকের পানি পরিষ্কারের কাজ করতে কখনোই দেখি নাই। সরকার তো ঠিকই টাকা খরচ করছে, কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। (লেকের পানি পরিষ্কারে) যাদের দায়িত্ব তারাই যদি বাসায় বসে বসে ঘুমায় তাহলে তো কিছু করার নাই। সরকারের উদ্যোগ কাজে লাগতেছে কি-না সেটা তদারকি করা উচিত।

গুদারাঘাট বাজারের চায়ের দোকানদার রমজান আলী জানান, আগে লেকের পারের এই জায়গাটি ফাঁকা পড়ে থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরে সেখানে অস্থায়ী ভিত্তিতে দোকানপাট বসানো হচ্ছে। মূলত রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবানদের ছত্রচ্ছায়ায় এটি করা হয় বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, এর আগেও একাধিকবার বিশেষজ্ঞরা পানি পরীক্ষা করে মাত্রাতিরিক্ত দূষণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু দূষণ রোধে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের লেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আমিনুর রহমান সুমন বলেন, সত্যি বলতে কী তিনটি মেজর পয়েন্ট দিয়ে ওয়াসার ময়লা পানি ফেলা হচ্ছে গুলশান লেকে। যে কারণে আমাদের অনিচ্ছা সত্তে¡ও লেকের পানি দূষিত হচ্ছে। তবে ওয়াসার ওই ময়লা পানি লেকে না ফেলে কিভাবে অন্য কোথাও নিয়ে ফেলা যায় সেটি নিয়ে কাজ করছি।
এদিকে অবৈধভাবে ভরাট করে দখল ও দূষণে জর্জরিত গুলশান লেক বাঁচাতে ২০০১ সালে লেকটিকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এত কিছুর পরও লেকের দখল দূষণ না কমে আরো বেড়েছে।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. মু. সোহরাব আলি বলেন, এটি হঠাৎ কোনো উদ্যোগ নয়। অনেক আগে থেকেই আমরা গুলশান লেকের দূষণ রোধে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি।
গুলশান-বারিধারা লেককে অবৈধ দখল-দূষণ থেকে রক্ষা করতে ২০১০ সালে সরকার ৪১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের আওতায় ৮৭ একর জমি অধিগ্রহণের কথা রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। জমি অধিগ্রহণ করতে না পারায় প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়নি। ফলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় এর ব্যয় বেড়ে গেছে নির্ধারিত বাজেটের কয়েকগুণ বেশি। বর্তমানে প্রকল্পটির প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। বাকি দুই হাজার ৮৮৬ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
** মজলুম জনতা ** ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৯:০৬ এএম says : 0
ঢাকা রাজধানি,তাই মানুষ ঢাকা মুখী হতে হয়।কিন্তু ঢাকার র্দুগন্ধ মানুষ কোন ভাবেই সহ্য করতে পারেনা।এ বিষয় ভাবা উচিৎ।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন