বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চীন-মার্কিন সমঝোতার কথা বললেন হেনরি কিসিঞ্জার

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

এক সময় যারা গোটা বিশ্বব্যবস্থার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নানা রকম ছবক দিতেন, হেনরি কিসিঞ্জার তাদের অন্যতম। সাবেক মার্কিন কূটনীতিক, ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও সেক্রেটারী অব দ্য স্টেট যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন, এক সময়ের কট্টর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী হেনরি কিসিঞ্জার এখন এক প্রাজ্ঞ নবতীপর সমাজচিন্তক। বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্ক ও ফোরামে তিনি ভারসাম্যপূর্ণ ও লিবারেল বক্তব্য দিয়ে প্রায়শ বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হচ্ছেন। একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত মার্কিন কূটনীতিক হয়েও তিনি সব সময়ই অন্ধ জায়নবাদী চিন্তা ও সিদ্ধান্ত এড়িয়ে চলতে সক্ষম হয়েছেন। সত্তরের দশকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার ওয়াশিংটন সফরের সময় হোয়াইট হাউজের বৈঠকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইহুদিদের ইসরাইলে পুনর্বাসনের একটি প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, সোভিয়েত ইহুদিদের ইসরাইলে পুনর্বাসনের চিন্তা একটি মানবিক বিষয় হলেও তা মার্র্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বা স্বার্থের বিষয় নয়। আর ওয়ার অন টেররিজমের চরম সময় ২০১২ সালে হেনরি কিসিঞ্জারের একটি মন্তব্যে তোলপাড় হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ইন টেন ইয়ার্স দেয়ার উইল বি নো মোর ইসরাইল’। অর্থাৎ ১০ বছরের মধ্যে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটির বিলুপ্তির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন কিসিঞ্জার। সে ১০ বছরের গন্ডি এখনো পার হয়নি। আড়াই দশক আগে ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় বিনা যুদ্ধে আকস্মিকভাবে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র ও অন্যতম প্রধান সামরিক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে যেতে আমরা দেখেছি। চলমান বিশ্ববাস্তবতায় ইসরাইলের ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা সে তুলনায় অনেক বেশি যৌক্তিক ও বাস্তব। ফিলিস্তিনীদের প্রতি ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান মানবাধিকা লঙ্ঘন ও নির্মম আচরণে বিশ্বসম্প্রদায় ক্রমশ ইসরাইলের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য ধর্মীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি উদার মনোভাবাপন্ন ইহুদিদেরকেও বিভিন্ন সময়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের এমন আচরণে ক্ষুব্ধতা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখা গেছে। ইসলাম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নির্দেশ দেয়। এ কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যেমন অন্য ধর্মের লোকদের উপর জবরদস্তি করে না, একইভাবে অর্থডক্স ইহুদিরাও অন্যের ভূমি দখল করে উচ্চাভিলাষি রাষ্ট্র গঠন এবং দমন পীড়নের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার জায়নবাদী কর্মকান্ডকে সমর্থন করেন না। জায়নবাদের সাথে জুদাইজমের পার্থক্য এখানেই। জায়নবাদী ইসরাইলের সাথে জুদাইজমের অনুসারীদের এই সূ² মতাদর্শিক পার্থক্য ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৮ সালে সাড়ম্বরে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ইউরোপ-আমেরিকা ও ইসরাইলের শতাধিক সেলিব্রেটি ইহুদি ও খ্রিস্টান আনুষ্ঠানিকভাবে সে অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেয়। তারা একটি খোলা চিঠি লিখে তাতে স্বাক্ষর দিয়ে নিজেদের যে মতামত তুলে ধরেছিল, তার মূল বক্তব্য ছিল, যে ইউরোপীয় এন্টি সেমিটিজমের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ইহুদি নিধন ও হলোকস্টের জন্ম দিয়েছিল, জায়নবাদী ইহুদিরা ফিলিস্তিনের আরব মুসলমানদের উপর ঠিক অনুরূপ নিধন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। হিটলারের ইহুদি গণহত্যাকে যেভাবে তারা হলোকস্ট হিসেবে স্মরণ করে ঠিক একইভাবে ফিলিস্তিনীরাও নিজেদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ ও জায়নবাদী গণহত্যাকে নাকবা হিসেবে স্মরণ করে আসছেন। প্রধানত: ইহুদি সেলিবেট্রিদের নেয়া ক্যাম্পেইন ও সেই যৌথ চিঠি লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে শুধুমাত্র ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসেই ৭০ হাজার ফিলিস্তিনীর ঘরবাড়ি দখল করা হয়। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় সাড়ে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিন বিতাড়িত করে তাদের ৪ শতাধিক গ্রাম, শহর ও জনপদ বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়ে ইসরাইলীকরণ করা হয়। মার্কিন দার্শনিক ও অ্যাকাডেমিসিয়ান এডওয়ার্ড সাইদ বুঝিয়েছেন, ইহুদিদের সাথে যে হলোকস্ট হয়েছিল, ইহুদিরা ইসরাইলিরা মুসলমান ফিলিস্তিনিদের সাথে একই প্রকারে নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছিল। ইসরাইলের ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আগে উদার, মানবিক ইহুদি সেলিব্রেটিরা তাদের আকাক্সক্ষা এভাবে প্রকাশ করেছিলেন, যে দিন আরব ও ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে শুরু করবে আমরা সেদিনকেই সেলিব্রেট করব। জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের তরফ থেকে সে ধরনের কোনো আকাক্সক্ষা কখনো প্রকাশিত হয়নি। বরং তাদের দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা ক্রমেই আরো রক্তপিপাসু রূপ ধারণ করেছে। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখেই হেনরি কিসিঞ্জার এক দশকের মধ্যে ইসরাইলের বিলুপ্তির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

স্নায়ুযুদ্ধের চারদশক ধরে বিশ্বে শক্তির এক প্রকার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি কোরীয় যুদ্ধ থেকে শুরু করে, কিউবা মিসাইল ক্রাইসিস, ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্ব পর্যন্ত প্রতিটি আঞ্চলিক সংঘাতে রুশ-মার্কিন অবস্থানে জনগণের সমর্থন ও প্রতিরোধ বিজয়ের নির্ধারক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়ার শ’ সামরিক জোট বিলুপ্তি, বার্লিন দেয়ালের পতন ও সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ইউরোপে পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটলেও দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রিকরণ, দক্ষিণ চীন সাগরের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিরসনের মত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হয়নি। এখানে অনুঘটক হিসেবে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। শতকোটি মানুষের বিশাল দেশ চীন হাজার বছরের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করছে। তারা তাদের প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জনে সর্বদা সচেস্ট থাকলেও মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থে কোরীয় উপদ্বীপের বিরোধ, চীন-জাপান বিরোধ এবং আরব উপদ্বীপের বিরোধ জিইয়ে রাখছে। এখন মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পড়ন্ত সময়ে চীনা ড্রাগনের সাথে পাল্লা দিয়ে জিতে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সাবেক মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট ও প্রবীণ ডিপ্লোম্যাট হেনরি কিসিঞ্জারের কণ্ঠে সেই সত্যই উচ্চারিত হল। স্ট্রাটেজিক কালচার ফাউন্ডেশন নামের একটি অনলাইন পোর্টালে গত ২৯ নভেম্বরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের সাম্প্রতিক চীন সফর এবং চীন-মার্কিন সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। কিসিঞ্জারের বেইজিং সফরের সময় সত্তরের দশকে চীন-মার্কিন সম্পর্কের চরম সংকটকালে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকার কথা স্মরণ করে তাঁকে ধন্যবাদ জানান চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বেইজিং সফরের মধ্য দিয়ে চীন-মার্কিন সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছিল এবং সেই ঘটনার নেপথ্য অনুঘটক ছিলেন তৎকালীন মার্কিন সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার হেনরি কিসিঞ্জার। সত্তরের দশকের পর ইউনিপোলার বিশ্বের বাস্তবতায় চীনের উত্থানের প্রেক্ষাপটে চীন-মার্কিন সম্পর্ক নতুন জটিলতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, যা ইতিমধ্যে অভূতপূর্ব বাণিজ্যযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের উপর শত শত বিলিয়ন ডলারের নতুন শুল্ক আরোপ করে চীনের বাণিজ্যিক আধিপত্য ও অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দেয়ার সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। তবে এসব করে চীনের অগ্রযাত্রা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না, উপরস্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বিনিয়োগ এবং স্বল্পমূল্যের চীনা পণ্যের উপর অতিরিক্ত কর আরোপের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্থান এবং মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পিত ও ঘোষিত ট্রেড ওয়ার শুরু হওয়ার আগেই চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এই যুদ্ধে কোনো পক্ষেরই বিজয় লাভের সম্ভাবনা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্রেড ওয়ারের সিদ্ধান্তের সাথে পুঁজিবাদের মৌল ভিত্তি ও মুক্তবাজার অর্থনীতি সাংঘর্ষিক হওয়ায় এর মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব দুর্বলতা ও নৈতিক পরাজয়ের লক্ষণ ফুটে উঠেছে। তবে চীনের অগ্রযাত্রা খর্ব করতে ট্রাম্প প্রশাসন শুধু ট্রেড ওয়ারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, একদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে বিপুল সামরিক উপস্থিতি ও রণসজ্জা অন্যদিকে চীনের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একচীন নীতির প্রতি অনাস্থার প্রমাণ দিতে শুরু করেছে। উল্লেখ্য হংকং, তাইওয়ানের মত চীনা সার্বভৌম ভূ-খন্ডগুলোর উপর প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক অবস্থানের উপর সম্পর্কের অবস্থান নির্ধারণ করে থাকে চীন। ট্রেড ওয়ার ও বিশ্বরাজনীতির এক জটিল সন্ধিক্ষণে গত তিনমাস ধরে হংকংয়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ ও আন্দোলন কর্মসূচি চলছে। এটি নিঃসন্দেহে চীনের আভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে সেখানে শক্তি প্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে কথা বলা বা প্রতিবাদ করার এখতিয়ার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিশ্চয়ই আছে। হংকং সংকট চীনের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যতম পরাশক্তি এবং প্রতিপক্ষ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিরবতা অথবা ইতিবাচক ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক লিগ্যাসি ও অবস্থানের প্রতি সুবিচার করতে পারত। তা না করে তারা হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভে সমর্থন জানিয়েছে। চীনের প্রবল আপত্তি ও হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে গত বুধবার এ বিষয়ক একটি বিলে সই করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভে মার্কিনীদের সমর্থনকে সরলাঙ্কিকভাবে দেখার সুযোগ খুব ক্ষীণ। চীনের দিক থেকে এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কিন কংগ্রেসে পাস হওয়া আইনে হংকংয়ের জন্য বিশেষ মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, এর একটি মানে হচ্ছে, চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করা নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক হংকংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আরেকভাবে এর মানে এই দাঁড়াচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একচীন নীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। ইতিপূর্বে হাইওয়ান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক বিতর্কিত উদ্যোগ নিলেও তারা কখনো একচীন নীতি থেকে সরে যায়নি। পিপল্স রিপাবলিক অব চায়নাকে রিকগনাইজ করার সময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একচীন নীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম মনোনীত সেক্রেটারি অব স্টেট রেক্স টিলারসনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, এক চীন নীতির কোনো পরিবর্তনের পরিকল্পনা ট্রাম্প প্রশাসনের আছে কিনা তা তার জানা নেই। তবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের চার বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো নীতি ও বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি কমিটমেন্টের অনেক কিছু থেকেই সরে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, ইরানের সাথে ৬ জাতির পরমাণু সমঝোতা চুক্তি, ফিলিস্তিনি শান্তি প্রক্রিয়া ও টু-স্টেট সলিউশন প্রক্রিয়া থেকে সরে যাওয়া ইত্যাদি। নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যাম্পেইনের শ্লোগান ছিল, ‘আমেরিকা ফার্স্ট, মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। তবে ট্রাম্পের বালখিল্যতায় একের পর এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিটমেন্ট থেকে সরে আসায় গত চার বছরে আমেরিকা তার অবস্থান থেকে আরো বিচ্যুত হয়ে নিচে নেমে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশার জায়গা থেকে সরে গিয়ে জায়নবাদী স্বার্থে বেশি মনোযোগী হওয়ায় আমেরিকা এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এখনো বিশ্বের শতকোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এখনো কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় রাত্রি যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কোটি কোটি শিশু ন্যূনতম শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা থেকে এখনো বঞ্চিত। জায়নবাদী পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের কারণে বর্তমানে এ সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফিলিস্তিন ছাড়াও গত দুই দশকে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনের উপর সামরিক আগ্রাসন চালানোর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু ও চরম দারিদ্র্য ও দুর্ভীক্ষের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে চীন যখন শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোতে কর্মসংস্থান, উৎপাদনশীলতা ও যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে আস্থাহীন অবিশ্বস্ত প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরানের পাশাপাশি উত্তর কোরিয়ার প্রতিও অনবরত সামরিক হুমকি-হুঁশিয়ারির পর কোরীয় নেতা কিম জং উনের সাথে একাধিক বৈঠকের পরও দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারেননি। অন্যদিকে কোরিয়া, ইরান, বা সিরিয়ার উপর চীন-রাশিয়ার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি আফগানিস্তানে দুই দশক ধরে আগ্রাসন ও নিয়ন্ত্রণ চালিয়েও সেখানে কোনো প্রকার রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিজয় অর্জনে ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে সম্মানজনকভাবে বের হওয়ার কূটনৈতিক পথ খুঁজতে গিয়েও সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে না পেরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যে লেজেগোবরে করে ফেলেছেন। একের পর এক সামরিক-কূটনৈতিক পরাজয়ের ফলে কেউ আর আমেরিকাকে পাত্তা দিচ্ছে না, আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘনের ফলে প্রতিপক্ষ দেশগুলো এখন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর আস্থা রাখতে বা বিশ্বাস করতে পারছে না। ইউনিপোলার বিশ্বের মোড়লের জন্য এটা অনেক বড় ক্ষতি।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ও সাবেক মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জারের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এক প্রকার মিল লক্ষ্য করা যায়। মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন ও পররাষ্ট্রনীতির প্রতি ইঙ্গিত করে সম্প্রতি সিএনএন কে দেয়া সাক্ষাৎকারে মিখাইল গর্বাচেভ বলেন, আবার শীতল যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসন ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। তবে আফগান মুজাহিদদের প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয় সোভিয়েত সৈন্যরা। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণ করেই সম্ভবত তিনি বলেন, আঞ্চলিক সমস্যায় যদি পরাশক্তি নাক গলাতে যায় তাহলে তা পুরো বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। শান্তি ও নিরাপত্তার কথা বলে দেড়যুগ আগে সামরিক হামলা চালিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নেয়ার পর লাখ লাখ আফগান ও হাজার হাজার মার্কিন সেনা হতাহত হলেও দেড়যুগে আরো অস্থিতিশীল ও নিরপত্তাহীন হয়েছে আফগানিস্তান। অবস্থা বেগতিক দেখে নিরাপদে আফগানিস্তান ছাড়ার উপায় হিসেবে আফগান তালেবানদের সাথে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দেয়ার পর আলোচনা থেকে হঠাৎ পিছুটান দেন ট্রাম্প। তবে সম্প্রতি আবারো শান্তি আলোচনায় ফিরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প। তবে ইতোমধ্যে ফিলিস্তিন সংকটকে আরো জটিল করে ফেলেছেন ট্রাম্প। হংকংয়ের আন্দোলনের সমর্থনে আইন পাস করে চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যতকেও জটিল করে তোলা হয়েছে। এহেন বাস্তবতায় গত ১৪ নভেম্বর নিউ ইয়র্কে জনসম্মুখে দেয়া বক্তব্যে হেনরি কিসিঞ্জার যে বিষয়গুলোকে খোলাখুলি তুলে ধরেছেন তা হচ্ছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ইউনিপোলার বা একক শক্তি নয়, চীন এবং আমেরিকার এমন ভাবা উচিৎ নয় যে একটি দেশ আরেকটি দেশকে ডমিনেট করতে পারবে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে নিজেকে এক্সেপশনাল ইউনি পাওয়ার বলে গণ্য করছে তা নিতান্তই ভুল। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘ফুল স্পেকট্টাম ডমিনেন্স’ থিউরির প্রবক্তাদের অন্যতম একজন ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। আজকের বাস্তবতায় কিসিঞ্জার সে অবস্থান থেকে সরে এসে চীনের শক্তি সামর্থ্যকে স্বীকার করে নিয়ে সমঝোতামূলক অবস্থানের কথা বলছেন। তিনি অত্যন্ত উদ্বেগ ও সর্তক বার্তা দিয়ে বলেছেন, আমেরিকা যদি চীনের ‘মোডাস বিভেন্ডি’ (জীবনযাত্রা ও কর্ম প্রণালী) বুঝতে ব্যর্থ হয়, তবে বিশ্ব এমন এক সংঘাতের মুখোমুখী হবে যা এর আগে আর কখনো কোনো বিশ্বযুদ্ধে ঘটেনি। ছিয়ানব্বই বছর বয়েসী প্রাজ্ঞ কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হেনরি কিসিঞ্জার শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ও চীনের মধ্যে একটি বৃহত্তর সমঝোতার মধ্য দিয়ে সংকট উত্তরণে দুই দেশের নেতারা সক্ষম হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তবে চীন মার্কিন সমঝোতা যেন ¯্রফে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ভাগাভাগি হয়ে না দাঁড়ায়। বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক অধিকার, আত্মপরিচয় ও মানবাধিকারের প্রশ্নগুলো যেন বৃহৎ শক্তির পুঁজিবাদি নীলনকশার নিচে হারিয়ে না যায়।
bari_zamal@yahoo.com.

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Jaydul Islam ৪ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৫৫ এএম says : 0
It is very good appreciable report considering near future world strategy. It has lot of indications for peace in the world. Thanks
Total Reply(0)
llp ৪ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:৪৩ এএম says : 0
It was FM later PM of Pakistan Zulfikar Ali Bhutto, who played the most strategic role in establishing US-China trade relation in 1972 by the cost abandoning soviet style economy and culture. His vision was far too reaching and now look how Asia is benefiting from China.
Total Reply(0)
oti_shadharon ৪ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১০:২১ এএম says : 0
হেনরি কিসিঞ্জারের কথা বাংলাদেশিরা ভুলে গেছে ….. এই লোকটি বাংলাদেশকে "তলাবিহীন ঝুড়ি" বলে অপমান করেছিল….. মুসলিমদের অপমান করার কোনো সুযোগ এই লোক ছাড়েনা।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন