শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

ভারতীয় শিল্পরীতি ও চিত্রকলা

নিঃশব্দ আহামদ | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৯:১৫ পিএম

আবেগ ও উদ্দীপনার ফলশ্রুতি হলো শিল্প যার যুগপৎ মেলবন্ধনে বৈচিত্রময় হয়ে উঠে সীমিত বাস্তবতার। শিল্পী আবেগ, অনুভুতি বাস্তবতার নিরিখে প্রয়োগ ঘটান চিত্রশিল্পে। আর এসব চিত্রশিল্প বহন করে যুগব্যাপি একটি ভূ-অঞ্চলের মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্তার।
ভারতীয় শিল্প ও চিত্রকলার নিদর্শন পরিলক্ষিত হয় মৌর্য যুগে তথা অশোকের সময়ে। ঊক্ত সময়ে স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পাওয়া না গেলেও অশোক কিন্ত ৮৪০০০ মন্ডপ তৈরি করেছিলেন যার মধ্যে সাঁচি স্তুপ অন্যতম। প্রাচীনকাল থেকেই স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয়েছে ভারতীয় চিত্রকলা। সনাতন হিন্দু সভ্যতা থেকে এ যাত্রা শুরু হয়। মাঝে এর সাথে মিলিত হবার সুযোগ লাভ করে অনেক নতুন সংস্কৃতির। যেমন বৌদ্ধ, জৈন ও ইসলাম। বলা যায় ইসলাম ছাড়া বাকি সবগুলো সংস্কৃতি ই এখানকার স্বদেশী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দুশো বছরের শাসন অভিজ্ঞতা শেষে ভারতীয় শিল্পের ধারা আবার হিন্দু সংস্কৃতিতে এসে মিশেছে। ভারতীয় শিল্প বিভিন্ন ধরনের শিল্প সমন্বয়ে গঠিত। মৌর্যযুগে তেমন শিল্পের নিদর্শন না থাকলেও মৌর্যত্তোর যুগে মৌর্য সাম্র্যাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতে ভারহুত, বূদ্ধগয়া ও নাগার্জুনকো- শিল্প বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তক্ষশিলা, আফগানিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গান্ধোরশিল্প শিল্পরসিক ও সমালোকদের আকর্ষণ করে গান্ধার শিল্প হিসেবে পাওয়া বূদ্ধমূর্তি। গ্রীক রোমান শিল্পের প্রভাব থাকলেও গান্ধারশিল্প সম্পর্কে বলা হয় শিল্পীর হাত গ্রীকের অথচ হৃদয় তার ভারতীয়। মথুরায় যে শিল্প গড়ে উঠে তা সম্পুর্ণ বিদেশী প্রভাবমুক্ত। এই সময়ে নির্মিত গুহা, চৈত্য, নাসিক, কার্লে প্রভৃতির চৈত্য মানুষৈর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
গুপ্তযুগকে বলা হয় স্থাপত্য ভাস্কর্য্য ও চিত্রকলার স্বর্ণযুগ। অজন্তা ও ইলোরার গুহা মন্দিরগুলির নির্মাণশৈলির মধ্যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। গুপ্তযুগ পরবর্তীতে প্রাচীন যুগের শেষ সময় পর্যন্ত সময়ের শিল্পরীতিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। উত্তর ভারতীয় শিল্পরীতি ও দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পরীতি বা দ্রাবিড়ীয় শিল্পরীতি।
উত্তর ভারতীয় শিল্পরীতিতে নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূবনেশ্বর, পুরী, খাজুরান্ঢো, দিলওয়াড়া, মার্তন্ড ও কোনারক ইত্যাদি। দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পের নিদর্শন হিসেবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় বিষয়ের উপর গড়ে উঠা পল্লবশিল্প, চোল শিল্পরীতি ও চালুক্য শিল্পরীতি।
পল্লবশিল্পের অন্যতম শিল্পরীতি মাহেন্দ্র শিল্পরীতি-যেগুলো পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয় গুহা মন্দির। পাহাড় কেটে রথাকৃতির যে মন্দির নির্মাণ করা হয় তা ছিলো মামল্ল শিল্পরীতি।
চোল আমলে দ্রাবিড়ীয় শিল্পরীতির চরমুম বিকাশ ঘটে। কাঞ্চিপুরমের কৈলাসমন্দির এবং তাঞ্জোরের বৃহদেশ্বর মন্দির যার মধ্যে অন্যতম।
দক্ষিণ ভারতে চালুক্য রীতি নামে আরও একটি শিল্পরীতির প্রচলন ছিলো। চালুক্য যুগে হিন্দু মন্দিরগুলি অনেক সময় জৈন ও বৌদ্ধ মঠের অনুকরণে তৈরি হতো। বোম্বাইয়ের এলিফ্যান্ট মন্দির, বিরুপাক্ষ মন্দির, ইলোরার বিখ্যাত কৈলাস মন্দির তার অন্যতম নিদর্শন।
সুলতানি আমলে চিত্রকলা
ইসলামে ছবি আঁকা নিষিদ্ধি ছিলো বিধায় সুলতানি আমলে চিত্রকলার চর্চা নেই। তবে কালে কালে এ ধারণা ভ্রান্ত হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। ভারতে ইসলাম আবির্ভাবের ফলে ভারতের সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো। এই সময়ে কয়েকজন সুলতান ও হিন্দু প্রধান শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্টপোষকতা করেন। সুলতানি আমলে পারস্য শিল্পরীতিও ভারতীয় শিল্পরীতির সুন্দর মেলবন্ধন ছিলো। সুলতানি আমলে যে শিল্প গড়ে উঠে তা থেকে তিনটি প্রধান শিল্পরীতির উদ্ভব হয়। মুঘল, রাজস্থাধি ও দক্ষিণী। সুলতানি আমলে জৈন চিত্রশিল্পীদের আঁকা কতেক ছবির নিদর্শন পাওয়া যায়। গুজরাট, রাজস্থান ও সৌরাষ্ট্রে এসব জৈন শিল্পীরা খ্যাতি লাভ করেন।
মুঘল আমলে চিত্রশিল্প-ভারতীয় চিত্রশিল্পে মুঘল আমল অন্যতম। সুলতানি আমলের শাসকরা চিত্রশিল্পের বেশ কদর না করলেও মুঘল শাসকগণ চিত্রশিল্পের প্রচন্ড কদর করতেন। আর তাই দেখা যায় সম্রাট আকবরের আমলে তাঁর রাজদরবারে ১৭জন শিল্পী ছিলেন যার মধ্যে ১৩জন ই ছিলেন হিন্দু চিত্রশিল্পী। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুকুন্দ, কোজুলাল, মহেশ, তারা, যদু, জগন, রাম হরিবংশ বিখ্যাত। তার আমলে চিত্রশিল্পের বিশেষ বিভাগ খুলে প্রধান করেন খাজা আবদুস সামাদ কোপারস্য ও হিন্দুরীতির মিশ্রণ ই ছিলো মুঘল শিল্পরীতি।
সম্রাট জাহাঙ্গীর চিত্রশিল্পের অন্যতম সমঝদার ছিলেন তাই তিনি হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে শিল্পীদের কদর করতেন। এসব শিল্পীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন আগা, রেজা, আবুল হাসান তাঁর পুত্র ফারুক বেগ মহম্মদ, নাদির মুরাদ মনসুর, বিষেণ দাগা, কেশব , মনোহর, মাধব, তুলসি প্রভৃতজন বিখ্যাত।
সম্রাট শাহজাহান চিত্রকলার চেয়ে স্থাপত্যে ঝোঁক রাখতেন ফলে তাঁর আমলে চিত্রশিল্পীরা দরবারি অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তিনিও সম্রাট জাহাঙগীরের মতো গাছপালাও পাখি অনুরাগি ছিলেন। তাঁর পুত্র দারাশিকো ও দরবারের প্রধান অভিজাতজন আসফ খান শিক্ষানুরাগি ছিলেন। সম্রাট শাহজাহান প্রাকৃতিক দৃশ্যের পরিবর্তে সম্রাট ও মানুষের প্রতিকৃতি অংকনে আগ্রহ দেখাতেন।
চিত্রশিল্পে সম্রাট আওরঙ্গজেব এর তেমন আগ্রহ দৃশ্যত না হলেও তাঁর আমলে শিল্পও চিত্রকলার এই রীতি ও ধারা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি।
ভারতীয় শিল্পওচিত্রকলার এ ধারা আঞ্চলিক পর্যায়েও বেশ পরিলক্ষিত হয়। যেমন রাজস্তান, পাঞ্জাব ও কাশ্মীর অঞ্চলের জুম্ম, কাংড়া, গুলের ইত্যাদি চিত্রকলা। দাক্ষিণাত্যের তাঞ্জোর, বাংলা, নেপালও উড়িশা অসম প্রভৃতি অঞ্চলেও নিজস্ব শিল্পরীতি গড়ে উঠে। যুগ যুগ ধরে এসব শিল্পরীতি সে সময়কার শিল্প ও চিত্রের যে সৌন্দর্য্যবোধ ছিলো তা অক্ষয় হয়ে যুগব্যাপি মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করে নেবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Shampa monima ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৮:৩২ এএম says : 0
চিত্রশিল্প জীবন বাঁচাতে যার সূচনা, সেই শিল্প সহায়ক হয়েছে জীবনবোধে, তাকে ঊষর মনোভূমিতে উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন ,নিঃশব্দ আহমেদের নিরলস কারুশৈলী লিখনী,অতলান্ত প্রতিভার উন্মোচিত হয়েছে যেমন, তেমন উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছি।এমন তথ্য সহকারে প্রয়াস সকল পাঠকের দরবারে সমাদৃত হবে তা বলার অবকাশ রাখেনা।
Total Reply(0)
Shampa monima ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৮:৪৪ এএম says : 0
চিত্রশিল্প জীবন বাঁচাতে যার সূচনা, সেই শিল্প সহায়ক হয়েছে জীবনবোধে, তাকে ঊষর মনোভূমিতে উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন ,নিঃশব্দ আহমেদের নিরলস কারুশৈলী লিখনী,অতলান্ত প্রতিভার উন্মোচিত হয়েছে যেমন, তেমন উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছি।এমন তথ্য সহকারে প্রয়াস সকল পাঠকের দরবারে সমাদৃত হবে তা বলার অবকাশ রাখেনা।
Total Reply(0)
Shampa monima ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৮:৪৫ এএম says : 0
চিত্রশিল্প জীবন বাঁচাতে যার সূচনা, সেই শিল্প সহায়ক হয়েছে জীবনবোধে, তাকে ঊষর মনোভূমিতে উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন ,নিঃশব্দ আহমেদের নিরলস কারুশৈলী লিখনী,অতলান্ত প্রতিভার উন্মোচিত হয়েছে যেমন, তেমন উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছি।এমন তথ্য সহকারে প্রয়াস সকল পাঠকের দরবারে সমাদৃত হবে তা বলার অবকাশ রাখেনা।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন