মানব জীবনের দুইটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সৎ উদ্দেশ্য ও সৎ কর্ম। এই দুইটি দিক ব্যতীত ব্যক্তি চরিত্রের উন্নতি সাধন করা যায় না। মানুষের জীবনকে সফল করতে হলে সৎ উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতার সাথে সৎ কর্ম সম্পাদন করা একান্ত অপরিহার্য। উদ্দেশ্য সৎ না হলে কোনো অবস্থায়ই কর্ম সৎ হতে পারে না। কোনো ইবাদত আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য সৎ উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতার সাথে তা করা আবশ্যক। রসূলুল্লাহ (সা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘সৎ উদ্দেশ্য বা নিয়ত ব্যতীত কোনো কর্মই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ তাই লৌকিকতা প্রদর্শনের জন্য কেউ কোনো ইবাদত করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় না। এরূপ ইবাদত পালনকারী আল্লাহর পুরস্কার নয়, তিরস্কারই লাভ করে থাকে।
মুখের সাথে অন্তরের এবং উদ্দেশ্যর সাথে কর্মের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। যদি অন্তর ও কথায় এবং উদ্দেশ্য ও কর্মে কোনো মিল না থাকে, শরীয়তের পরিভাষায় এরূপ ব্যক্তি নিকৃষ্ট স্তরের মোনাফেক। স্মরণ থাকে যে, প্রত্যেক মানুষকে নিজ নিজ কর্মসম্পাদনের পূর্ণ অধিকার ও ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে এবং ভ্রান্ত ও সৎ পথ অনুসরণ করার অধিকারও তার, এতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সৎ কর্ম অনুষ্ঠান ও অসৎ কর্ম হতে বিরত থাকা প্রত্যেকের ইচ্চার উপর নির্ভর করে। আল্লাহর পক্ষ হতে এই স্বাধীনতা মানুষকে দেয়া হয়েছে। হাদীস হতেও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।
হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) ও হজরত জাবের (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের জন্য দায়ী, সে ইচ্ছা করলে তাদের পথ অনুসরণ করতে পারে যাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়েছে অথবা সে ঐ সকল পথ অনুসরণ করতে পারে, যেগুলোর উপর আল্লাহর অভিশাপ অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
এতে কোনো সন্দেহ নেই, যে ব্যক্তি ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হয় তাকে তার শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং যে ব্যক্তি সঠিক ও সৎ পথের অনুসরণ করে সে তার প্রতিদান লাভ করবে। কেন না আল্লাহতাআলা প্রত্যেকের উদ্দেশ্য ও কর্ম সম্পর্কে ওয়াকেফহাল, তিনিই তার প্রতিদান দেবেন।
যখন আল্লাহতাআলা সকল বিষয়ে অবগত তখন মিথ্যা, খোশামোদ ও লৌকিকতা কিংবা মোনাফেকী প্রদর্শন করে নিজের অমঙ্গল সাধন না করাই বাঞ্চনীয়। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, কেবল মোনাফেকী হতে বিরত থাকাটাই যথেষ্ট নয়, বরং মোনাফেকদের সংস্রব এবং তাদের সাহায্য-সহযোগিতা হতেও দূরে থাকা আবশ্যক। কেননা মোনাফেকের মন আন্তরিকতা হতে বঞ্চিত এবং কপটতায় পরিপূর্ণ। অসৎ উদ্দেশ্য সাধনই হচ্ছে এদের কাম্য। যেখানে মোনাফেকের আগমন ঘটবে সেখানে সৎ মনোভাবাপনের বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে।
মোনাফেকদের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা নিজেদের অপকর্ম সৎ লোকদের স্কন্ধে চাপিয়ে দিতে বিশেষ পারদর্শী। এই কাজ অতি কৌশলেই তারা সম্পাদন করে থাকে এবং সরল সঙ্গীরা তাদের প্রতারণার শিকারে পরিণত হয়ে নানা প্রকার দুষ্কর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না। মোনাফেকরা হজরত রাসূলে করিম (সা.) এর আমলে এ রূপ বহু ঘটনা ঘটিয়েছে।
একটি ঘটনা উল্লেখ্য, বনু উবায়রাক বংশের জনৈক মোনাফেক বিশিষ্ট সাহাবী হজরত রেফাআর গৃহে চুরি করে। বিভিন্ন প্রমাণের ফলে অনেকেই সন্দেহ করেন যে, এই চুরি উক্ত মোনাফেকই করে থাকবে। বনু উবায়রাক বিভিন্ন কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিল। বংশের কলঙ্ক হবে মনে করে বনু উবায়রাক উক্ত মোনাফেককে রক্ষা করার চেষ্টা করল এবং এই উদ্দেশ্য সফল করতে হলে তাকে চুরির অভিযোগ হতে মুক্ত করতে হবে। তাই তারা নিজেদের রক্ষার জন্য মিছামিছিভাবে এই চুরির সাথে হজরত বোসাইদ নামক এক সাহাবীকে জড়িত করে। এ শুনে হজরত রেফাআ তার এক আত্মীয় হজরত কাতাদাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে প্রেরণ করেন এবং ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর গোচরীভূত করান। রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘটনার তদন্ত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দান করলেন।
বনু উবায়রাক এই খবর শুনে খুব বিচলিত হল এবং কয়েকজন নেতৃস্থানীয় লোকসহ তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে উপস্থিত হলো। তারা সকলে একযোগে হজরত রেফাআ ও হজরত কাতাদার বিরুদ্ধে হজরত (সা.) এর নিকট অভিযোগ করে যে, তারা একজন দ্বীনদার মুসলমানকে চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। সদলবলে হজরত (সা.) এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাদের এরূপ বলার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তাদের ধারণা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সা.) এই ঘটনায় তাদের পক্ষপাতিত্ব করবেন। কিন্তু তিনি তাদের সমর্থন করার পরিবর্তে হজরত কাতাদাকে তলব করে জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘তুমি যথাযথ কারণ ব্যতীত একজনের বিরুদ্ধে কেন এ ধরণের অভিযোগ উত্থাপন করছ?’ হজরত কাতাদা রসূলুল্লাহ (সা.) এর এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তাঁর চাচা রেফাআকে হজরত (সা.) এর প্রশ্নটি জানান। হজরত রেফাআ এর কোনো উত্তর দান করলেন না, তিনি চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু আল্লাহতাআলা তার এই নীরবতার প্রতিদান দিলেন।
আল্লাহতাআলা কোরআন শরীফের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে এ ধরণের লোকদের সম্পর্কে জানিয়ে দিলেন, ‘(হে রসূল!) আপনি সে সকল লোকের পক্ষ হতে জওয়াবদিহির কোনো কথা বলবেননা, যারা নিজেদের ক্ষতিসাধন করছে। নিশ্চয় আল্লাহতাআলা এমন লোককে পছন্দ করেন না, যারা অধিক খেয়ানতকারী ও মহাপাপী। যাদের অবস্থা এই তারা লোকের নিকট হতে নিজেদের পাপকার্য গোপন করে এবং আল্লাহর নিকট লজ্জিত হয়না। অথচ সে সময় তারা তাঁর নিকটেই থাকে, যখন তারা আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথা বলে ও তদবীর করে এবং আল্লাহতাআলা তাদের সকল কর্ম নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।’ (সূরা: নিছা)
আল্লাহতাআলা একই সঙ্গে সে সকল লোককে সতর্ক করে দিয়েছেন, যারা মোনাফেকদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে, তাদের সাহায্য সহযোগিতা করে এবং তাদের অপরাধ গোপন রাখতে ও কর্মফল ভোগ করা হতে তাদেরকে রক্ষা করতে চায়। আল্লাহ বলেন: ‘আচ্ছা, তোমরাতো জাগতিক জীবনে তাদের অনুসরণ অথবা জওয়াবদিহির কথা বলছ, কিন্তু কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে তাদের পক্ষ হতে কে জওয়াবদিহি করবে, অথবা কে তাদের কাজ সমাধা করবে?’ (সূরা: নিছা)
অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী দুনিয়াতে যদি কোনো ব্যক্তি বা দল তাদের কথা ও কাজের পার্থক্যকে গোপন করে তাহলে পরোকালে এই পাপ মোচনের কি উপায় থাকবে?
হজরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘মোমেন ব্যক্তি ভয়-ভীতি, ক্ষুধা, অর্থ ধ্বংস, পশু কোরবানি এবং ফল ধ্বংস পর্যন্ত সহ্য করতে পারে; কিন্তু সে পারে না কেবল মোনাফেকী বা গাদ্দারী করতে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন