বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

খেজুরের গুড় শিল্পে দুর্দিন

কমছে গাছ ও গাছি, গাছির ছেলে হচ্ছে না গাছি

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

খেজুরের রস হচ্ছে যশোরের যশ। ঐতিহ্যটি দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন একেবারেই খুঁড়িয়ে চলছে খেজুরের গুড় শিল্পটি। কোনরূপ উদ্যোগ নেই শিল্পটি রক্ষার। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ শীতকাল আসলেই হা-হুতাশ করে থাকেন। চারিদিকে জোরেশোরে উচ্চারিত হয় নানা প্রশ্ন ‘শিল্পটি কী কোনভাবেই বাঁচানো যাবে না, এভাবে শেষ হয়ে যাবে, একটু উদ্যোগ কী নেয়া যায় না, ঐতিহ্য নিয়ে গর্বের জায়গাটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে।’-এসবের উত্তর খুঁজে পান না তারা।
শুধু যশোর নয়, একসময় দেশ ছাপিয়ে উপমহাদেশের মধ্যে শীর্ষস্থানের রেকর্ডে গড়ে যশোরের খেজুরের গুড পাটালি। বিশেষ করে নলেন গুড়। ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউজ যশোরের চৌগাছার তাহেরপুরে এসে ১৮৬৪ সালে প্রথম খেজুরের রস থেকে বাদামি চিনি উৎপাদন করে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। সেই সময় যশোরের আশেপাশে ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইলের বিভিন্ন গ্রামে ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠে খেজুরের রস থেকে গুড় ও নলেন পাটালির কারখানা। এখন সেসবের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
যশোরের খাজুরা এলাকার বয়োবৃদ্ধ শামসুল আলমসহ বেশ কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে জানান, খেজুরের রস থেকে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাদামি চিনি উৎপাদন করে যশোর বিপ্লব সৃষ্টি করে। দিনে দিনে সম্ভাবনার নানা দিক গবেষণা করে সফলতা আসে। কিন্তু বিপ্লবের কিছুদিন পর মুখ থুবড়ে পড়লো কেন তার অনুসন্ধান নেই। গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র কারখানা যেখানে স্থানীয় পদ্ধতিতে রস জ্বালিয়ে গুড় ও পাটালি তৈরি বহুকাল থেকেই চলে আসছে। বর্তমানে সেটিও মৃত্যুমুখে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাঠ কর্মকর্তারা অন্যান্য বিষয় যেভাবে উপর নীচে যোগাযোগ করে থাকেন, এটির ক্ষেত্রে মোটেও হয় না। কোন নির্দেশনাও থাকে না উপর মহলের। পারতপক্ষে কেউ খোঁজ রাখেন না এ ব্যাপারে।
মাঠপর্যায়ের একজন কৃষি কর্মকর্তা নামপ্রকাশ করতে নিষেধ করে জানালেন, আমি দীর্ঘদিন চাকরি করছি, উপরের কোন কর্মকর্তা কখনো বলেননি খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কেন, বাড়ানো যায় কিভাবে, সমস্যার সমাধানই বা কি। তার মতে, সাংবাদিকরা মৌসুমী রিপোর্ট করে থাকেন। আসলে মহাসঙ্কটে শিল্পটি। তার উপর শিল্পটির করুণ অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ গাছি সঙ্কট। বিভিন্ন পেশা বংশপরম্পরায় চলে থাকে। গাছিদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। গাছির ছেলে গাছি হচ্ছেন না। যেসব গাছি আছেন তারা খেজুর গাছে বাদরের মতো ঝুলে রস সংগ্রহের জন্য সকাল বিকাল পরিশ্রম করেন এখন বয়সের ভারে তারা পেরে উঠছেন না। তাছাড়া সিংহভাগ গাছির মাজায় ও হাটুতে ব্যাথা স্থায়ী হয়ে গেছে।
যশোরের সদর উপজেলার ডাকাতিয়া মাঠপাড়ার গাছি আলী হোসেন ময়না জানান, আমি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের সাথে জড়িত প্রায় ৪০ বছর। এখন কোনরকমে ২টি ছোট গাছ ঝেড়েকুটে রস সংগ্রহের জন্য বাঁশের নলি ও ভাড় ঝুলাতে পারছি। আগে আমি নতুন খয়েরতলা, ডাকাতিয়া, নওদাগ্রামের প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি গাছে থেকে রস সংগ্রহের কাজ করতে পারতাম। তিনি বললেন আর পারি না। তাছাড়া সেইরকম গাছও নেই। গ্রামে গ্রামে সারি সারি খেজুর গাছ যেভাবে দেখা যেত, এখন দেখা যায় না। তার মতে, অল্পকিছু গাছি যশোরের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তাও কতদিন স্থায়িত্ব হবে তা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র জানায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০১৪ সালের মাঠ জরিপ অনুযায়ী যশোর অঞ্চলে ২ হাজার ৮শ’ ৩৮ হেক্টরে খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল ১৭লাখ ৮২হাজার ৫শ’৭০টি। গুড় উৎপাদন হতো ২৫হাজার ৯শ’ মেট্রিক টন। আগের জরিপে (১৯৯৮) এর সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। দ্রæত কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় খেজুর গাছ সাবাড় হচ্ছে। তাছাড়া নতুন করে কোন খেজুর গাছ লাগানো হচ্ছে না।
জানা গেছে, গ্রামাঞ্চলে বাড়ীর আঙ্গিনায় ও মাঠে জমির আইলে কিংবা বাগানে অযতœ অবহেলায় ও সম্পুর্ন বিনা খরচে বেড়ে ওঠে ‘মধুবৃক্ষ’ খেজুর গাছ। প্রতিবছর শীত মৌসুমের ৩/৪মাস মানুষের রসনা তৃপ্তির যোগান দেয়। খেজুরের রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা গুড়, নলেন গুড়, মিছরি দানার গুড় ও পাটালি তৈরির দৃশ্য অনেকটাই অভিনব মনে হয়। পুরো শীতে গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক এই উৎসব চলে আসছে আবহমান কাল ধরে।
যশোরের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এখনো খাজুরা, বাঘারপাড়া, ফতেপুর, ছাতিয়ানতলাসহ বিভিন্ন গ্রামের কিছু ব্যক্তি শীত মৌসুমে খেজুরের রস গুড়ের ব্যবসা চালিয়ে যান। অসাধু ব্যবসায়ীরা গুড়ে ভেজাল দিয়ে থাকে চিনি ও সেগারিন। অবশ্য এই ভেজালের বিরুদ্ধে এবার প্রশাসন থেকে কড়া হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
ইলেকট্রনিক মুদি যশোর ৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৮:৪৬ পিএম says : 0
খেজুরের গুড়/ পাটালি কেবল পিঠা-পায়েস নয়, নানা অসুখের প্রতিরোধক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এমনকি, আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও এই গুড়ের ব্যবহার পরিলক্ষিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘খেজুরের গুড়ের আয়রন শরীরের নানা কাজে লাগে। চিনি বা কৃত্রিম চিনির চেয়ে এটি অনেক উপকারী। চিনি নিয়ে চিকিৎসকদের নানা দ্বিমত থাকলেও খেজুরের গুড় নিয়ে কোনো মতভেদ নেই।’ তাই এই শিল্পকে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। => চিনির বিকল্প গুড়। চিনির কার্বোহাইড্রেট শরীরে জমে। কিন্তু গুড়ের কার্বোহাইড্রেটের ক্ষেত্রে সে সমস্যা নেই। তা রক্তের সঙ্গে দ্রুত মিশে যেতে পারে আবার রক্তে বেশিক্ষণ থাকতেও সক্ষম। => এই গুড় হজমে সাহায্যকারী উৎসেচকের শক্তি বাড়ায়। ফলে খাবার দ্রুত হজম হয়, বদহজমজনিত সমস্যাও থাকে না। => খেজুর গুড়ে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে আয়রন। যা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে। শরীরে আয়রনের অভাব ঘটলে হিমগ্লোবিনের ঘাটতি হয় ফলে নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন অল্প পরিমাণে গুড় খেলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি কমতে পারে। => পিরিয়ডের সমস্যা মেটাতে এই গুড় কার্যকর। পিরিয়ডের আগে বা সময় এই গুড় খেলে নানা শারীরিক সমস্যার সমাধান হয়। প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম বা ‌পিএমএস সমস্যায় কমবেশি প্রায় সমস্ত মহিলারা ভোগেন। প্রতিদিন নিয়ম করে অল্প পরিমাণ গুড় খেলে শরীরে হরমোনের সমতা বজায় থাকে। => হরমোনের সমতা রক্ষা ছাড়াও এনডোরফিন্স বা ‘হ্যাপি হরমোন’-এর ক্ষরণ বাড়িয়ে এই সমস্যাগুলো দূরে রাখে খেজুরের গুড়। => খেজুর গুড় লিভারকে রাখে সুস্থ। খেজুর গুড়ে রয়েছে প্রচুর পটাসিয়াম ও সোডিয়াম। যা পেশিকে শক্তিশালী করে। অতিরিক্ত মেদ ঝরায়। ফলে, ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। ব্লাড প্রেশারকে নিয়ন্ত্রণ করে। => ত্বককে যদি রাখতে চান মসৃণ, বয়স যদি ধরে রাখতে চান, তবে খেজুর গুড় খান। ফুসকুড়ি ও ব্রণ নিরাময়ে নিয়মিত খেজুর গুড় খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। => গুড় শীতকালে শরীরকে গরম রাখে। ফলে ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে লড়তে সুবিধা হয়। ......................
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন