বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

উর্দুভাষীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ দিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

‘আটকে পড়া পাকিস্তানী’ নামে কথিত উর্দুভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীটি স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্যাম্পে অমানবিক পরিবেশে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান ও ভারতের অভ্যুদয় ঘটলে ভারতের বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে উর্দুভাষী মুসলমানদের একটি অংশ তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (পূর্ব পাকিস্তান) হিজরত করে আসে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে তারা এখানে চলে আসে বলতে গেলে একেবারেই খালি হাতে। বাড়িঘর, জমি-জিরাত, সম্পদ-সম্পত্তি পরিত্যাগ করে আসা এই জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণ নিরালম্ব অবস্থায় তাদের জীবন শুরু করে। প্রবল আত্মপ্রতিষ্ঠাকামী এবং অত্যন্ত পরিশ্রমী হওয়ার কারণে অচিরেই তারা তাদের অর্থিক সঙ্গতি ও জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সমর্থ হয়। ১৯৪৭ সালে এদেশে এসে ভুল না করলেও তারা ১৯৭১ সালে বিরাট ভুল করে বসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে। এই ভুলের খেসারত এই প্রজন্মের উর্দুভাষীদেরও দিতে হচ্ছে। দেশ স্বাধীনের পর কয়েক লাখ উর্দুভাষীকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্পে রাখা হয়। তারা পাকিস্তানী হিসাবে নিজেদের পরিচয় নির্দিষ্ট করায় তাদের আটকে পড়া পাকিস্তানী বলে অভিহিত করা হয়। তাদের শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হয় এবং পাকিস্তানে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক তাদের একটি অংশকে পাকিস্তানের পাঠানো সম্ভবপর হয়। বাকীরা ক্যাম্পেই অবস্থান করতে থাকে। তারা পরবর্তীতে আর পাকিস্তানে যেতে পারেনি। এখানেও তাদের নেতাদের মস্তবড় ভুল হয়ে যায়। তাদের কেউই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসেনি। তাই পাকিস্তান তাদের নেবে কেন? তারা এসেছে ভারত থেকে। তাই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য পোষণ করা তাদের ঠিক হয়নি। তাদের বরং বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা উচিৎ ছিল। তাহলে তাদের পরবর্তী বংশধরদের এরকম না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হতো না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দ্বিতীয় প্রজন্ম চলছে। এই দুই প্রজন্মের লোকেরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তাদের জন্ম বাংলাদেশে। বাংলাদেশে আলো-বাতাসে তারা বেড়ে উঠেছে। তারা জন্মগতভাবে বাংলাদেশী। এখনকার উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর নেতারা মনে করেন, তাদের পূর্ব পুরুষদের একাধিক ভুলের মাসুল তাদের দিতে হচ্ছে।

মুসলমান হওয়ার কারণেই মূলত উর্দুভাষীরা ১৯৪৭ পরবর্তীতে বাংলাদেশে আসে। সেদিন তারা যে ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিল, তাদের পরবর্তী বংশধররাও সেই বিড়ম্বনা থেকে বাইরে আসতে পারেনি। তাদের পাকিস্তানের প্রতি কোনো মোহ নেই। আবার বাংলাদেশেও তারা নাগরিক অধিকার ঠিকমত ভোগ করতে পারছে না। উচ্চ আদালত তাদের ভোটাধিকার দিয়েছে। কিন্তুু পুরো নাগরিক অধিকার তারা পাচ্ছে না। এখনকার উর্দুভাষীরা বাংলাদেশী উর্দুভাষী হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে। মহাজির ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তাদের পূর্ববর্তী নেতাদের ভুল সিদ্ধান্তের কথা অকপটে স্বীকার করে বলেছেন, আমরা আটকে পড়া পাকিস্তানী নই। আমরা বাংলাদেশী উর্দুভাষী। একই সঙ্গে আমরা মুসলমান। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ধর্মভিত্তিক বহু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে। তারা সমনাগরিক অধিকার এবং মর্যাদা নিয়ে বসবাস করছে। শুধুমাত্র উর্দুভাষী হওয়ার কারণে আমাদের হিসাবটা ভিন্ন। দু:খ করে তিনি আরো বলেছেন, ভোটাভুটির জটিল অংক মেলানোর জন্য আমাদের ভোটার করা হয়েছে বটে কিন্তু আমাদের জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করতে কেউই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তার একান্ত প্রত্যাশা, এদেশের মাটিতে জন্ম নেয়া উদুর্ুুভাষী প্রজন্ম উর্দুভাষী বাংলাদেশী পরিচয়ে পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে এদেশেই থাকতে চায়।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল বাংলাদেশে। বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর নিরাপদ ঠিকানা এই দেশ। সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আজকের বিশ্বে কঠিন ব্যাপারে। বিভিন্ন দেশে যেখানে সংখ্যালঘুরা নানাভাবে পীড়িত, নির্যাতীত ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদই শুধু নয়, সকল প্রকার মানবিক ও নাগরিক অধিকার ভোগ করছে। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও তা স্বীকার করেছেন। তার বক্তব্যের মূল কথা, বাংলাদেশে হিন্দুরা নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করছে। আর সেটা নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ১০-১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয় দিয়ে মানবতাবোধের অন্যন্য নজির স্থাপন করেছে। সেই দেশে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ বছরের পর বছর অন্ধকারে থেকে যাবে, এটা হতে পারে না। এটা বাংলাদেশের সুনাম, সুখ্যাতি ও মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, দেশে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা কত, তার সঠিক কোনো তথ্য কোথাও নেই। ধারণা করা হয়, সবমিলে ১৪-১৫ লাখের বেশি হবে না। যেহেতু তারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যাশীল এবং বাংলাদেশী নাগরিক হিসাবে এদেশে বসবাস করতে চায় এবং উচ্চ আদালত তাদের ভোটাধিকার দিয়েছেন সুতরাং এই অধিকারের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাদের পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান, চাকরি-বাকরি ও শিক্ষাদীক্ষার বন্দোবস্ত করতে হবে। ২০১৬ সালে তাদের কয়েক হাজার পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য জমি বরাদ্দের যে উদ্যোগ নেয়া হয় তা এখনো চিঠি চালাচালির মধ্যে সীমিত হয়ে আছে। এটা অত্যন্ত দু:খজনক। এ প্রসঙ্গে আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, উদুর্ভাষী জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবন-যাপনের সুযোগ দিতে হবে, তাদের সকলকে নাগরিক অধিকার দিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে। ধর্মীয় ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করবো, সরকার ভাগ্যতাডিত উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসার জন্য অতিদ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন