রাতের আকাশ ঠিকরে শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে লাল-নীল-বেগুনী হাজারো দ্যুতির রোশনাই, দূর থেকেই কানে বাজছে সাউন্ড সিস্টেম টিউনিংয়ের ঝাঝালো শব্দ। হোম অব ক্রিকেটের মূল ভেন্যুতে ঢুকে যে কেউ ভিমড়ি খেয়ে যেতে বাধ্য। যেখানে লড়াইয়ে মেতে ওঠেন ক্রিকেটাররা সেই ২২ গজি পিচ দখল করে দাঁড়িয়ে বিশালাকায় লৌহ মঞ্চ। তার তিনপাশ ঘিরে বিন্যস্ত আসন অলংকৃত করো দর্শকরাও প্রস্তুত জমকালো এক আয়োজন উপভোগ করতে।
সঞ্চালক সঙ্গীতা আহমেদের ধন্যবাদ পর্বের পর স্টেজ মাতানোর দায়িত্ব দিতে হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল নাম ঘোষনা করলেন ডি রকস্টার খ্যাত শুভর। তবে সময় গড়িয়ে গেলেও মঞ্চে আগমনের নাম গন্ধও নেই তার। প্রায় মিনিট দশেক পর স্টেজে এসেও খাবি খেতে হয়েছে। গান গাওয়ার চেষ্টায় বেশ ক’বার মাইক ঠিক ঠাক করেও ব্যর্থ হয়ে নেমে যেতে বাধ্য হয়েছেন শুভ। পরে গাইলেও সেই ছন্দ আর খুঁজে পাননি গোটা সময়জুড়ে। এরপর দায়িত্বটা পড়েছিল নতুন প্রজন্মের আরেক শিল্পী রেশমি মির্জার কাঁধে। তবে কথা আর সুরের মাঝে ছন্দের বুননে যে গানের উৎপত্তি, বাজে সাউন্ড সিস্টেমের কারণে তার ছিঁটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তার কণ্ঠে। জাতিক জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী রাঙাতে এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ পেয়েছে বিশেষ নাম ‘বঙ্গবন্ধু বিপিএল’। আলো ঝলমলে এক অনুষ্ঠানেরই প্রতিজ্ঞা করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তার শুরুটা হল এমন অব্যবস্থাপনা আর বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ!
বিসিবির স‚চি অনুযায়ী, বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে শুভর পরিবেশনা দিয়ে শুরু হবার কথা ছিল। বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিটে রেশমি মির্জা, সন্ধ্যা ৬টায় জেমস এবং ৬টা ৪০ মিনিটে মঞ্চে আসার কতা ছিল মমতাজের। তবে যান্ত্রিক ত্রæটি বিড়ম্বনায় পাল্টে ঘটেেেছ শিডিউল বিপর্যয়। তার মাঝেই ছন্দহীন কনসার্ট চলল সন্ধ্যা থেকেই। ব্যান্ড তারকা জেমস মঞ্চে উঠে তার পরিবেশনা শুরু করার পরই মাঠে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভিআইপি গ্যালারির বারান্দায় বসানো অস্থায়ী মঞ্চ থেকেই সন্ধ্যা ৬টা ৫৬ মিনিটে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষনা করে সরকার প্রধান বলেন, ‘যারা উপস্থিত আছেন, সকলকে আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আগামী দিনে এই অনুষ্ঠান স্বার্থক হোক, সফল হোক এবং আজকের অনুষ্ঠান আপনারা সবাই ভালোভাবে উপভোগ করুন, সেই কামনা করে আমি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার টি-টোয়েন্টি লিগ ২০১৯ এর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।’ সঙ্গে সঙ্গেই মঞ্চের চারপাশ আলোকিত করে আকাশের দিকে ছুটে যায় বর্ণিল সব আতশবাজী। সঙ্গীতের তালে মিনিট দশেক চলে এই আয়োজন। ফের মঞ্চে ফেরেন জেমস। ভিআইপি গ্যালারি থেকে প্রধানমন্ত্রী উপভোগ করেন ব্যান্ডের গুরুখ্যাত দরাজ কণ্ঠে গাওয়া ‘মা’, ‘তারায় তারায়’ ও ‘চল চলে আপনে ঘর’ গানগুলো।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে কনসার্টের জৌলুসও। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মঞ্চে আসেন বিশ্ব মাতানো ভারতীয় শিল্পী সনু নিগাম। তবে বিজয়েল মাসে যে দেশপ্রেমের ছোঁয়াটা পাওয়ার কথা ছিল দেশীয় শিল্পীদের কাছ থেকে সেটিই দিয়েছেন সুন। শুরুটা করেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা দেশাত্মবোধক গান ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা... সে যে আমার জন্মভূমি’- দিয়ে। এরপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ‘শোন একটি মুজিবুরের কণ্ঠ’ গানটিও গেয়ে শোনান এশিয়ার প্রখ্যাত এই সুরেলা কণ্ঠের অধিরাকী। পরে একে একে তার নিজের জনপ্রিয় গান দিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক বুঁদ করে রাখেন দর্শকদের।
কনসার্টের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ক’দিন আগেও ফোক ফেস্টে ঢাকা মাতিয়ে যাওয়া কৈলাশ খেরের পার্ফরম্যান্স। ‘তওবা তওবা.. তেরি সুরত’, ‘তেরি দিওয়ানী’, ‘টুটা টুটা এক পারিন্দা’, ‘সাইয়া’সহ তার জনপ্রিয় গান দিয়ে মাতিয়ে তোলেন গোটা মিরপুর স্টেডিয়াম। তবে এখানেও দেখা গেছে সমন্বয়হীনতা। সেই একই বাজে সাউন্ড সিস্টেমের কারণে আগত দর্শকদের সঙ্গে কোন সংযোগই ঘটাতে পারেননি শিল্পীরা। দর্শকদের আশপাশে ছিলনা কোন মাইকের ব্যবস্থাও। শিল্পীদের সঙ্গে গলা মেলাতে বললে তাই নিষ্প্রাণ হাসিতেই কাজ চালাতে দেখা গেছে অনেককেই। তালে তাল মিলিয়ে হাত তালি দিতে বললেও সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন বিশ্বেময় মঞ্চ কাঁপানো এই শিল্পীরা।
এর মাঝেই মাঠে উপস্থিত আয়োজনের সেরা দুই আকর্ষণ বলিউড হার্টথ্রব সালমান খান ও ক্যাটরিনা কাইফ। এসেই ভিআইপি গ্যালারিতে গিয়ে দেখা করে কুশল বনিময় করেন দু’জনেই। বেশ কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে সময় কাটান ক্রীড়া বান্ধব প্রধানমন্ত্রীও। সেখান থেকে ঘুরে প্রথমে এককভাবে এসে ‘ধুম মাচালে’, ‘কালা চশমা’র মতো জনপ্রিয় গানের সঙ্গে কোমরের দুলুনিতে নাচিয়েছেন ৮ হাজার দর্শককে। এরপরই স্টেজে আসেন এশিয়ার মেগা স্টার সালমান। ‘ও ও জানে জানা’, ‘কাভ তাক জাওয়ানী’, ‘ডার্লিং তেরে লিয়ে’, বেবিকো ফেস পছন্দ হে’, ‘প্রেম রতন ধন পায়ো’, ‘জুম্মে কি রাত হো’ গানের তালে স্টেজ মাতিয়ে যান দাবাং তারকা। একসগে ‘এক থা টাইগার’ জুটির স্টেজ মাতানো ‘সোয়াগসে করেঙ্গে সবকা সওগাত’- গানের তালে মন মাতানো নাচ দিয়ে শেষ হয় বর্ণিল এই উদ্বোধনী আয়োজন।
মাঠের খেলা অবশ্য গড়াবে আগামী পরশু। এই মিরপুরেই দুপুর দেড়টায় খেলবে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স ও সিলেট থান্ডার্স আর সন্ধ্যায় কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের মুখোমুখি হবে রংপুর রেঞ্জার্স। ছোট-খাটো ভুল-ত্রæটি বাদ দিলে বর্ণিল এক আয়োজনেই হলো উদ্বোধন। এবার দেখার পালা, মাঠের লড়াইয়ে কতটুকু বৈচিত্র্য আনতে পারেন ক্রিকেটাররা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন