শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নদীদূষণ রোধে ব্যাপক ও সমন্বিত কার্যপরিকল্পনা প্রয়োজন

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

পরিবেশগত ছাড়পত্র ও তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নেই, বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত এমন শিল্পকারখানা এক মাসের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব কারখানার তথ্যসহ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে ৮ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদফতরকে প্রতিবেদন পেশ করতে বলেছেন। এর আগে আদালতে দাখিল করা পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাশে কেরানীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত ৫২টি কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র ও ইটিপি নেই। এদিকে ঢাকা ওয়াসার প্রতি এক নির্দেশনায় হাইকোর্ট ছয় মাসের মধ্যে সুয়ারেজ লাইন বন্ধে অঙ্গীকার বাস্তবায়নের তাকিদ দিয়েছেন এবং এর আগ্রগতির প্রতিবেদন ৮ জানুয়ারি পেশ করতে বলেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, ঢাকা ওয়াসার তরফে ১৮ জুন আদালতকে জানানো হয়, ওয়াসার কোনো সুয়ারেজ লাইন দিয়ে বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য নি:সরিত হয়না। এ ব্যাপারে বিআইডবিøউটিএ’র দাখিল করা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ৬৬টি সুয়ারেজ লাইন বা ড্রেন রয়েছে, যার মধ্যে ওয়াসার ৫৬টি। গত ১৭ নভেম্বর দূষণ রোধে ব্যবস্থা না নেয়া এবং সুয়ারেজ লাইন না থাকা নিয়ে অসত্য তথ্য দেয়ার জন্য ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়। অত:পর ওয়াসার পক্ষ থেকে গত রোববার আদালতকে হলফনামার মাধ্যমে বলা হয়েছে, যেসব সুয়ারেজ লাইন দিয়ে বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য পড়ছে সেগুলো ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হবে। এবিষয়ে কর্মপরিকল্পনার জন্য একটি কমিটি করা হবে এবং প্রতি মাসে অগ্রগতির প্রতিবেদন দেয়া হবে। হলফনামায় স্বীকার করা হয়েছে, ইতোপূর্বে হলফনামা আকারে দেয়া প্রতিবেদন সঠিক ছিল না। এজন্য নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, বুড়িগঙ্গা নদীর পানিদূষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা চেয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) নামের একটি সংগঠনের পক্ষে ২০১০ সালে একটি রিট করা হয়। রিটের চূড়ান্ত শুনানি পর ২০১১ সালের ১ জুন তিন দফা নির্দেশনাসহ রায় প্রদান করা হয়। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রেক্ষাপটে চলতি বছর ৩০ এপ্রিল সম্পূরক আবেদন করে এইচআরসিবি। আদালত নির্দেশনা বাস্তবায়নে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা জানিয়ে বিবাদীদের অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় আলোচ্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

অত্যন্ত দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ২০১১ সালের ১ জুন হাইকোর্টের দেয়া তিন দফা নির্দেশনাসহ রায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর এসেও কিছুমাত্র বাস্তবায়ন হয়নি। পরিবেশ অধিদফতরের তরফে দেয়া প্রতিবেদন পরিবেশ ছাড়পত্র ও ইটিপিহীন শিল্পকারখানার একটি তালিকা কেবল দেয়া হয়েছে। আর ঢাকা ওয়াসা তো প্রথমে স্বীকারই করতে চায়নি তার কোনো সুয়ারেজ লাইন বুড়িগঙ্গায় পতিত হয়েছে। পরে অবশ্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, বেশির ভাগ সুয়ারেজ লাইন তার, যেগুলো বুড়িগঙ্গারদুষণে বড় রকমের ভূমিকা রাখছে। দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ অধিদফতর ও ঢাকা ওয়াসা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পাত্তা দেয়ারই প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। বাস্তবায়নের উদ্যোগ তো পরের কথা। যদি বাদী সংগঠনটির তরফে সম্পূরক আবেদন করা না হতো তাহলে হয়তো শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনাগুলো তামাদিই হয়ে যেতো। এইচআরপিবিকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ এ জন্য যে, তার কর্তৃপক্ষ ‘লেগে থাকার’ ধৈর্য দেখিয়েছে এবং ইস্যুটি ‘শেষ’ হতে দেয়নি। তার ফলে আদালতের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেয়া সম্ভবপর হয়েছে। বিবাদীদের পক্ষে অত:পর নির্দেশনা অগ্রাহ্য করার তেমন কোনো সুযোগ হয়তো থাকবে না। পরিবেশ ছাড়পত্র নেই কোন কোন শিল্পকারখানার, কোন কোন কারখানায় ইটিপি নেই, এটা জানার ও শনাক্ত করার জন্য যেমন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লাগার কথা নয়, তেমনি কার কার সুয়ারেজ লাইন বুড়িগঙ্গাদূষণের জন্য দায়ী, তা খুঁজে বের করাও দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ও কঠিন ব্যাপার নয়। অথচ এদুটি কাজ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদ্বয়ের দ্বারা সম্ভব হয়নি। ফলে বুড়িগঙ্গার পানিদূষণ বন্ধ করারও কোনো পদক্ষেপ নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। আশা করা যায়, এবারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে তারা ওজর দেখাবে না কিংবা গড়িমসি প্রদর্শন করবে না।

ঢাকার আশপাশের নদীগুলোসহ দেশের সব নদীই ভয়ংকর দূষণের শিকার। এই সঙ্গে আছে নদী দখলকরার দুর্নিবার কার্যতৎপরতা। দূষণ ও দখলে নদীগুলোর অস্তিত্ব এখন চরমভাবে বিপন্ন। ‘নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না’, যখন একথা বলা হয়, তখন নদীর অস্তিত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্ব কতটা ওতপ্রোত, সহজেই উপলব্ধি করা যায়। ঢাকার পার্শ্ববতী তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন নদীর পানি কারখানার বর্জ্য, মানববর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূর্ষিত হচ্ছে। এখন কোনো নদীকেই স্বচ্ছ সলিলা বলার উপায় নেই। পানির রং যেমন বদলে গেছে তেমনি তাতে দূষণ ও অনিশেষ। বর্ষা বাদে অন্যান্য ঋতুতে বুড়িগঙ্গার পানি আলকাতারার মতো কালো ও দুর্গন্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য নদীর অবস্থাও প্রায় একই রকম। বলা বাহুল্য, এ অবস্থা চলতে পারে না। অবশ্যই নদীর পানি দূষণমুক্ত করতে হবে এবং দূষণের সকল উপায়-উপকরণ ও প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। বুড়িগঙ্গার জন্য হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন, অন্যান্য নদীর দূষণমুক্তির জন্যও একই নির্দেশনা প্রয়োজন ও প্রযোজ্য। আমরা আশা করি, উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনা সকল নদীর ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য করা হবে। প্রয়োগযোগ্য করলেই হবে, প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এব্যাপারে একটি ব্যাপক ভিত্তিক কার্যপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন