শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

কঠোর এনবিআর

বিভিন্ন পদক্ষেপেও আশানুরূপ নয় কর আদায় ষ সাধুবাদ বিশেষজ্ঞদের

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বিশ্বব্যাপি নাগরিকরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কর দেন বিনিময়ে নানা সুবিধা ভোগ করেন। বাংলাদেশেও গত কয়েক বছর থেকে আয়কর বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সরকার চায় কর প্রদানে সক্ষম সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর দিক। কয়েকবছর ধরে আয়কর হার না বাড়িয়ে বেশি মানুষকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত আয়কর মেলার পাশাপাশি সর্বোচ্চ কর প্রদানকারীদের উৎসাহ দিতে সম্মাননাও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আয়কর দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, সচেতনতার অভাব ও মানুষের অনীহা কারণে বর্তমানে দেশে ১৬ কোটির বেশি জনগণ থাকলেও কর দেয় মাত্র এক শতাংশ। প্রায় চার কোটি মানুষ মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও এর মধ্যে ৪৬ লাখের মতো মানুষের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে। তবে সরকারের হিসাবে, তাদের মধ্যে মাত্র অর্ধেকেরও কম আয়কর দেন। আর তাই দেশের স্বার্থে এনবিআর চেয়ারম্যান টিআইএনধারীদের আয়কর দেয়ার যোগ্যদের করসহ রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করার কথা বলেছেন। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরাও এনবিআর চেয়ারম্যানের এই কঠোরতাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
সূত্রমতে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি অনুপাতে কর রাজস্ব আদায়ের হার সবচেয়ে কম, মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ; সবচেয়ে বেশি নেপালের, ২৩ শতাংশ। সেখানে উন্নত বিশ্বে এই হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে। চলতি বছর বাজেটে সরকার আগামী দুই বছরের মধ্যে জিডিপি রাজস্বের অনুপাত ১০ থেকে ১৪ শতাংশে উন্নীত করার প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সক্ষম ব্যক্তিদের কর দেয়া নৈতিক দায়িত্ব। তবে নাগরিকদের আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে হলে সরকারের ব্যয়ের স্বচ্ছতা, আর্থিক খাতে সুশাসন ও সর্বোপরি নাগরিক সেবা নিশ্চিতের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি বাড়তি প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব করেন অনেকেই। কেননা স্থিতিশীল উন্নয়নের স্বার্থে অবশ্যই কর জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হবে। এজন্য করযোগ্য সবাইকে কর দিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া দীর্ঘদিন থেকে চলমান ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা এবং ব্যবসায়ীদে মধ্যে ভয়-ভীতি দূর করে নির্বিঘেœ ব্যবসা করার সুযোগ দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে ভীতিকর পরিবেশ থাকলে ব্যবসায়ীরা কর দেবেন কিভাবে।
আয়কর আইন অনুযায়ী সাত ধরনের আয়, আয় করের আওতায় পরে। যেমনÑ চাকরি থেকে পাওয়া বেতন, ব্যবসা থেকে আয়, বাড়িভাড়া থেকে পাওয়া অর্থ, কোনো সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তর ফলে প্রাপ্ত অর্থ, জামানতের সুদ (সঞ্চয়পত্র, বন্ড, ব্যাংকের সুদ ইত্যাদি), কৃষি হতে আয়। এছাড়াও অন্যান্য আয়ের মধ্যে পরতে পারে অনেক কিছু।
এজন্য কয়েকবছর ধরে আয়কর হার না বাড়িয়ে বেশি মানুষকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের; আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত আয়কর মেলার আয়োজন করলেও আশানুরূপ ফল মিলছে না।
২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা আগের মতোই আড়াই লাখ টাকা। নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী করদাতাদের ৩ লাখ টাকা। প্রতিবন্ধী করদাতাদের ক্ষেত্রে ৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা দিদারুল আলম বলেছেন, জনগণ যদি মনে করে সরকার তাদের কথা চিন্তা করে না, নিজেদের বঞ্চিত মনে করে তাহলে তারা কর দিতে আগ্রহী হবে না। সাধারণ মানুষ যখন মনে করবেন যে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তখন দেশের উন্নয়নে তার শিহরণ জাগবে না।
তিনি বলেন, দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে। জিডিপির বিপরীতে রাজস্ব আদায় যে নগণ্য জানলে মানুষ নিজেই দেশ চলার জন্য অর্থের যোগান দেবে। কিন্তু তার আগে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে নাগরিকদের প্রাপ্য সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাড়তি প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব করেন অবসরপ্রাপ্ত এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, সরকারকে এমন আচরণ করতে হবে, যাতে দেশের প্রত্যেকটা মানুষ মনে করে দেশটা আমার। এজন্য সরকার কিছু পদক্ষেপও নিতে পারে। যেমনÑ ঈদে-পার্বনে মানুষ যখন গ্রামের বাড়িতে যায়Ñ তখন ট্রেন, বাস কিম্বা লঞ্চের টিকিটে সরকারের পক্ষ থেকে কিছুটা ভর্তুকি বা ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সম্প্রতি শেষ হওয়া আয়কর মেলায় চাকরিজীবী নাজির হোসেন বলেন, জনগণ যে কর দিচ্ছে সরকার তা যথাযথ ও স্বচ্ছভাবে ব্যয় করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার যখন জনগণের অর্থ স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারবে, তখন সাধারণ মানুষই দেশের প্রয়োজন বিবেচনা করতে শিখবে, কর দিতে উদ্বুদ্ধ হবে। আর বেশি নাগরিকদের করের আওতায় আনতে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা রকম দাফতরিক কাজে জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো টিআইএন সার্টিফিকেট জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেন তিনি।
মেলা আয়কর বিবরণী দাখিল করতে আসা ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী সৈয়দ বেলায়েত হোসেন বললেন, রাজস্ব কর্মকর্তাদের কাছে এসে হয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়ে জনমনে ভীতির কথা। মানুষ কর দিতে চাইলেও শুল্ক কর্মকর্তাদের হয়রানির ভয়ে অনেক ব্যবসায়ী শুল্ক ফাঁকি দেন বলে তিনি মনে করেন।
সত্তরোর্ধ্ব সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আব্দুস শুকুর বলেন, এদেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ কর দিতে সক্ষম। বেশিরভাগ মানুষ কর দিতেও চাও। কিন্তু বিদ্যমান পরিবেশ দিয়ে সরকার মানুষের কাছ থেকে কর নিতে পারছে না। তিনি বলেন, কী করলে সাধারণ মানুষ নিজে থেকে এসে আয়কর দেবে তা সরকারকেই বুঝে বের করতে হবে।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম বলেন, সরকার প্রচার করেছে যে মেলায় এসে কর দিলে কাউকে কিছু প্রশ্ন করা হবে না। দেশের জন্য বিনা প্রশ্নে কর দেয়ার আশ্বাস দেয়ায় সাধারণ মানুষ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের টাকা সরকারকে দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এসব করদাতারা দেশকে কিছু দিতে পেরে গৌরব বোধ করছেন বলে আমি মনে করি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এভাবে কৌশলে দেশপ্রেম ঢুকিয়ে দিতে পারলে দেশের বেশিরভাগ মানুষই কর দিবে বলে আমি বিশ্বাস করি। একই সঙ্গে দেশের আয়কর প্রদানে যোগ্যদের বিরুদ্ধে এনবিআর চেয়ারম্যানের কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে অবশ্য তিনি দেশে দীর্ঘদিন থেকে চলমান ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা এবং ব্যবসায়ীদে মধ্যে ভয়-ভীতি দূর করে নির্বিঘেœ ব্যবসা করার সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে ভীতিকর পরিবেশ থাকলে বা ব্যবসায়ীরা আয় করতে না পারলে আয়কর দেবেন কিভাবে।
এদিকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আসছে না। আর তাই কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনধারী সবাইকে রিটার্ন দাখিলে যে কোনো মূল্যে বাধ্য করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেছেন, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ে দোকানে দোকানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন বসানোর কাজ চলতি (ডিসেম্বর) মাসেই শুরু হবে। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে দেশে ৪৬ লাখ টিআইএনধারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করেছেন ২২ লাখ। যারা এখনও রিটার্ন দাখিল করেননি, তাদের করাঞ্চলের কর্মকর্তারা ফোন করবেন। আগামী জানুয়ারি থেকে রিটার্ন দাখিল না করা প্রত্যেক টিআইএনধারীকে ফোন দেবেন। তাদের রিটার্ন দাখিল করতে বলবেন। যারা আয়কর দেয়ার যোগ্য তাদের করসহ রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করা হবে। এতে না হলে প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দেন।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২২ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিল করেছেন। এর মধ্যে নতুন বেড়েছে দুই লাখ। নতুন-পুরোনো আরও ৫০ হাজার কোম্পানি রিটার্ন দাখিল করবে। সব মিলিয়ে চলতি বছর নতুন আড়াই লাখ রিটার্ন দাখিলকারী যুক্ত হবে।
তিনি বলেন, ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হয়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, এমসিসিআই, দোকান মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে বিভিন্ন স্তরে যেমনÑ পাঁচ শতাংশ, সাড়ে সাত শতাংশ, ১০ শতাংশ এবং ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এত কিছু করার পরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব না আসা দুঃখজনক। এখন থেকে যেসব টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিল করেন না, তাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। একই সঙ্গে এতদিন ব্যবসায়ীদের প্রতি এনবিআর নমনীয় ছিল। এখন থেকে ভ্যাট আদায়ে রাজস্ব কর্মকর্তাদের কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হবে। তবে কঠোর হওয়ার ক্ষেত্রে কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে খেয়াল রাখার কথা বলেছেন মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।
এছাড়াও সরকার ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিচ্ছে। তাই সরকারকেও প্রাপ্য রেভিনিউ দিতে হবে। ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা ছাড় দিয়েছি। তবে এখন থেকে আমাদের ভ্যাট আদায় কঠোর হতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ভ্যাট আদায়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভ্যাট আদায় গত বছরের তুলনায় এ বছর নয় শতাংশ বেড়েছে।
রাজস্ব আহরণের তথ্য তুলে ধরে এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে চার শতাংশ বেশি। এর মধ্যে কাস্টমসে রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি চার শতাংশ। ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি আট দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং ইনকাম ট্যাক্স আহরণের প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে, উন্নয়ন হচ্ছে। দেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের রাজস্ব প্রয়োজন। এজন্য এনবিআর ১০ ডিসেম্বর জাতীয় ভ্যাট দিবস ও ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় ভ্যাট সপ্তাহ পালন করবে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে ভ্যাট সপ্তাহ পালন করা হবে। এ ভ্যাট সপ্তাহের উদ্দেশ্য হলো ভ্যাট সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা। মানুষ যাতে ভ্যাট দিতে আগ্রহ হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন