শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বুলডোজারের সঙ্গে লড়াই

অন্ধকারে বিহারি ইস্যু-৩

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

আস্সালাতু খাইরুম মিনান্ নাউম....! সুললিতকণ্ঠের আজানের ধ্বনিতে ফজরের নামাজ পড়তে ওঠেন সাদাকাত খান। ছেলে ইমরান খান (২৫) তখনো ঘুমে। হঠাৎ বাইরে গোলমাল। সেকশন-১১, বøক-বি, এভিনিউ-২, মিরপুর বিহারি ক্যাম্পে হামলা। যেন মুম্বাই ফিল্মের অ্যাকশন দৃশ্যের শুটিং। লাঠিসোটা, হকিস্টিক নিয়ে হৈ হৈ রৈ রৈ করে পিকআপ থেকে নামল একদল সন্ত্রাসী। অধিবাসীদের ঘুমের আড়ষ্টতা ভাঙে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি আঘাত-ভাঙচুরে। কিন্তু কারা? কী কারণেই বা আকস্মিক এই হামলা? কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রাণপণ ছুটলেন ক্যাম্পের নারী-পুুরুষ-শিশু, বৃদ্ধ-যুবা। সম্ভ্রম বাঁচাতে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে পালিয়ে বাঁচেন তরুণীরা। সেদিনের আর্তচিৎকার প্রাণপণ ছুটে পালানোর সাক্ষী শুধু ভোরের পাখি। কারণ মিনিট দশেকের সন্ত্রাসী তাÐবে প্রাণীশূন্য হয়ে যায় ক্যাম্পটি। সাক্ষ্য দেয়ার মতো কোনো মানুষও অবশিষ্ট ছিল না।

পরের দৃশ্যে গরগর করে আবিভর্‚ত হয় চার-চারটি বুলডোজার। আবারো সেই সিটি করপোরেশন! এসেছে ‘অবৈধ বসতি’ উচ্ছেদ করতে। এতক্ষণে ঘটনা আঁচ করতে পারেন বাপ-বেটা। ত্বরিত সিদ্ধান্তে তারা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান ধাবমান বুলডোজারের সামনে। ‘চালাও বুলডোজার! আমাদের ওপর দিয়ে চালাও!!’ হৃদয়হীন বুলডোজার সেদিন এতটুকুন রহম করেনি। নিমিষেই ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয় ৪০ বছরে তিলতিল গড়ে তোলা সেমিপাকা ঘরটি। সুপ্রিম কোর্টের স্ট্যাটাসকো সম্বলিত কাগজ ছিল তুচ্ছ।

২০১৭ সালের ১৭ মে। মিরপুর বিহারি ক্যাম্পের ঢাকা উত্তর সিটি সর্বশেষ ‘উচ্ছেদ অভিযান’ হয় ওই দিন। ৩০-৪০টি উর্দুভাষী পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয় এক ভোরে। সেই স্থানটিতে এখন ময়লার ভাগাড়। কাক-কুকুরের অভিন্ন আস্তানা। ওই ভিটা আর ফিরে পাননি সাদাকাত পরিবার।

শুধু সাদাকাত নন। একই স্টাইলে মাঝে মধ্যেই উচ্ছেদের শিকার হন মিরপুর বিহারি ক্যাম্পের উর্দুভাষীরা। তাদের উচ্ছেদ করে সরকার। কখনো সিটি করপোরেশন, কখনো বা বেসরকারি ডেভেলপার কোম্পানি। স্থানীয় প্রভাবশালীরা অধিকাংশ সময় সেই ‘উচ্ছেদ অভিযান’-এর সঙ্গে থাকেন। ফলে কোনো উচ্ছেদেই খুব বেশি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন না উর্দুভাষীরা। ১৯৯৪ সাল, ২০১০ সাল, ২০১৭ সালে একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চলে মিরপুরের বিহারি পল্লীতে। ২০১১ সালে একবার কয়েক হাজার ঘর বুলডোজারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়। একযোগে গৃহহীন হয় ২-৩ হাজার উর্দুভাষী পরিবার। এ কারণে এখানকার অধিবাসীদের সব সময় উচ্ছেদে আসা বুলডোজারের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। বুলডোজার আতঙ্ক সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায় মিরপুরের উর্দুভাষীদের। এক্ষেত্রে মৌলিক সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস্তুভিটা, আবাসস্থল। যুগ যুগ কাটিয়ে দিলেও স্থায়ী কোনো বসতভিটা নেই উর্দুভাষীদের। তাই যেকোনো অজুহাতে ১০ ফিট আয়তনের খুপড়ি ঘরটিও ‘নাই’ হয়ে যেত মুহূর্তেই। বুলডোজারের সামনে সটান হয়ে শুয়ে পড়া, বুকের তাজা রক্তকে বাজি রাখা ছাড়া তেমন কিছুই করার থাকে না নিষ্পেষিত এই জনগোষ্ঠীর।

লড়াই মামলা এবং আগুনের বিরুদ্ধেও
উর্দুভাষীদের বাস্তুভিটাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আইনি লড়াই করছে ‘উর্দু স্পিকিং পিপলস ইয়ুথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্ট’ নামক সংগঠন। তৎকালীন বিহারি নেতা নাছিম খানের ব্যর্থ এবং ভ্রান্ত নেতৃত্বের প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই অরাজনৈতিক সংগঠন। হাইকোর্টের বারান্দায় কথা হয় সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাদাকাত খান ফাক্কুর সঙ্গে। আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরলেন স্থায়ী বসতভিটাহীন উর্দুভাষীদের দুর্ভোগ প্রসঙ্গ। প্রথমে জানালেন নিজের কথা। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন। তারপরও সম্প্রতি রুজু হওয়া তিনটি ফৌজদারি মামলার হুলিয়া নিয়ে ঘুরছেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পল্লবী থানায় একটি মামলা (নং-৩৭১২/২০১৮) হয়। ওই মামলায় আসামি ১৭৩ জন। এর মধ্যে ৫২ জন উর্দুভাষী। গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের কাজে বাধাসহ নানা অভিযোগ আনা হয় এজাহারে। যে ঘটনার জন্য এই মামলা ওই সময় ফাক্কু ছিলেন ভারতে চিকিৎসাধীন। ২০১৪ সালের ১৪ জুন মিরপুর কালসিতে ৯ জন উর্দুভাষী নারী-পুরুষ-শিশুকে পুড়িয়ে মারা হয়। ওই ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় কয়েকজন রাজনীতিকের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলে। ফাক্কু তাদের গ্রেফতারের দাবি জানাতেন। এ কারণেই তার বিরুদ্ধে এ মামলা দেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।

২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শুধু মিরপুর বিহারি ক্যাম্পেই আগুন লাগে ৪ বার। ২০০৫ সালে আগুন লাগে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের মুড়াপাড়া ক্যাম্পে। তাতে ৬ জন উর্দুভাষী জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান। ওই ঘটনায় বহু উর্দুভাষী ক্যাম্পছাড়া হয়। ২০১৪ সালে কালসির অগ্নিকাÐে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ৯ উর্দুভাষী। এ ঘটনায় পৃথক ৫টি মামলা হয়। আসামি করা হয় ৫-৬ হাজার উর্দুভাষীকে। এর মধ্যে চারটি মামলায়ই ইতোমধ্যে চার্জশিট দিয়েছে সিআইডি। তবে ৯ জন মারা যাওয়ার মামলাটি সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর। এ মামলাটি সিআইডি থেকে ডিবিতে পাঠানো হয়েছে। এটি এখনো তদন্তাধীন। ফাক্কুর মতে, পরিকল্পিতভাবেই বার বার লাগানো হয় এই আগুন। উদ্দেশ্য, উর্দুভাষীদের ক্যাম্প থেকে বিতাড়িত করে জায়গা দখলে নেয়া। এ মামলায় ফাক্কু এবং তার ছেলে ইমরান খানকেও আসামি করা হয়েছে। ক’দিন পরপর বাপ-বেটা মামলায় হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন।

উর্দুভাষীদের বহুমাত্রিক সমস্যার বড় একটি হচ্ছে ভূমির মালিকানা। দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পে থাকলেও তাদের মালিকানা নেই। হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে তাদের বসবাস করতে হয়। দেশের আর সব নাগরিক যে অধিকারটি জন্মগতভাবেই পেয়ে থাকেন একই অধিকারটি পেতে উর্দুভাষীদের উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিতে হয়। ভোটার তালিকায় নাম ওঠানোসহ একেকটি অর্জনের জন্য ব্যাপক বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে শিকার হতে হয় হামলা-মামলার। গত তিন দশকে অন্তত ৪ বার উচ্ছেদ এবং হামলার শিকার হয়েছেন ফাক্কুর পরিবার। কারণ, বসতভিটার অধিকার নিয়ে তিনি লড়াই করছেন।

এ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকটি উচ্ছেদ মামলার বাদীও সাদাকাত খান। সেকশন-১১/সিতে রয়েছে ৩২টি প্লট। ৭-৮ শ’ উর্দুভাষী পরিবারের বাস এখানে। কিছু ‘বরাদ্দ গ্রহীতা’ জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক)-এর কথিত আদেশ নিয়ে উচ্ছেদের চেষ্টা চালায়। এই উচ্ছেদ অভিযান সম্পূর্ণ বেআইনি। কারণ, ঢাকা শহর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (ডুইপ) নামে একটি প্রকল্প শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৩ সালে কিছু আবেদনকারীকে সেকশন-১১/সিতে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু দেখা গেল বরাদ্দকৃত জায়গাগুলোতে বহু আগে থেকে উর্দুভাষীদের ক্যাম্প রয়েছে। জাগৃকের তৎকালীন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জালিয়াতি এবং পরস্পর যোগসাজশ করে এ বরাদ্দ দেয়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে ভুল তথ্য দেয়া হয়। অন্যদিকে বরাদ্দ গ্রহীতাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। যে মানচিত্র ধরে ডুইপ প্রকল্প বরাদ্দ দিয়েছে তাতে উর্দুভাষীদের ক্যাম্পগুলোকে দেখানো হয়েছে নর্দমা, ডোবা, নালা, খাল, জলাশয় এবং পতিত জমি হিসেবে। ক্যাম্প দেখানো হচ্ছে ওয়াপদা ভবনগুলোকে। ফলে ডুইপ গ্রহীতাদের জমির বাস্তব দখল বুঝিয়ে দিতে পারেনি। দখল না পেয়ে কথিত সেই বরাদ্দপত্র আবার স্থানীয় ভূমিদস্যু এবং ডেভেলপারের কাছেও হস্তান্তর করেছে কেউ কেউ। এসব কাগজপত্র নিয়ে তারা মাঝে মধ্যেই এই ৭-৮শ’ উর্দুভাষী পরিবারকে উচ্ছেদ করতে আসে। আমরা সেটি চ্যালেঞ্জ করি। এখানে ক্যাম্প থাকার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ উর্দুভাষীদের পক্ষে রয়েছে। কারণ ১৯৭৩ নালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই জায়গাগুলোতে অস্থায়ীভাবে বিহারিদের থাকতে দিয়েছেন। কথা ছিল, এই বিহারিরা পাকিস্তান চলে যাওয়া সাপেক্ষে জায়গাগুলো তৎকালীন পৌর করপোরেশনের আওতায় চলে আসবে। কিন্তু আমরা পাকিস্তান যাইনি। যেতে চাইও না। তাহলে আমাদের কেন উৎখাত করা হবে? পল্লবীতে ৩৯টি বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং তাদের এখানে থাকতে দিয়েছেন। এগুলোর সীমানা নির্ধারণ না করে কোনোক্রমেই এখান থেকে উর্দুভাষীদের উচ্ছেদ করা যাবে না। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমরা চিনি না। ওই দেশে কোনোদিন যাইওনি। এদেশের মাটিতে আমার জন্ম। বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। এদেশে ছেড়ে আমরা কখনোই পাকিস্তান যাব না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
নীল আকাশ ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৩:৩৭ এএম says : 0
বিহারিদের সাথে এভাবে আচরণ করা ঠিক হচ্ছে না।
Total Reply(0)
নাসিম ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৩:৩৭ এএম says : 0
দুর্বল সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে এভাবে নিপীড়ক করার ওষুধ বের হয়নি???
Total Reply(0)
মজলুম জনতা ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৩:৩৮ এএম says : 0
এই সমস্যার একটা সমাধান হওয়া জরুরি।
Total Reply(0)
তরুন সাকা চৌধুরী ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৩:৩৯ এএম says : 0
সরকারকে বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার অামন্ত্রণ জাানচ্ছি।
Total Reply(0)
** হতদরিদ্র দিনমজুর ** ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৯:১৩ এএম says : 0
এরা আর কিছু না হোক মানুষ হিসাবে এদের বাচাঁর অধিকার আছে।তাই এদের বিষয় বিবেচনা পূর্বক ব্যাবস্থা নেওয়া উচিৎ বলে মনে করি।
Total Reply(0)
jack ali ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:১৬ পিএম says : 0
Government have no mercy on Poor People--- our head of the government live a king-where as millions and millions of people living in a slum and also they were evicted from their dwelling place without giving them another place to live....We ask Allah to save us from this type of government--Ameen
Total Reply(0)
শাহ্ মান্না বেনারশী ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:৫৭ পিএম says : 0
বিচারহীনতার সাংস্কৃতিক, শিকার এই বিহারী জনতা। যার সব থাকতেও কিছুই নাই।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন