মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আমাদের সন্তানদের মেধা ও সম্ভাবনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

ব্রেইন ড্রেইন বা মেধা পাচার সম্পর্কে এক সময় অনেক লেখালেখি হতো। সরকারের নীতি নির্ধারক, উন্নয়ন গবেষক এওবং সমাজবিজ্ঞানীদের অনেককে দেশের মেধা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন দেখা যেত। এখন আর এ বিষয়ে তেমন কোনো কথা শোনা যায় না। বরং বিদেশে গিয়ে দেশের মেধাবী সন্তানরা কী কী কৃতিত্বপূর্ণ কাজ করছে, তারা দেশের জন্য কতটা সম্মান বয়ে আনছে এবং রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ অবদান রাখছে তার হিসাব তুলে ধরে আত্মতুষ্টি বোধ করছেন। তবে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত প্রবাসী কর্মীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমের মজুরির যে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে, উচ্চশিক্ষিত উচ্চ আয়ের মেধাবীদের আয়ের হিসাব সে তুলনায় খুবই গৌণ। কারণ হোয়াইট কলার জব বা শিক্ষকতা ও গবেষণার মতো বৃত্তিতে নিয়োজিত উচ্চশিক্ষিত মেধাবীরা অশিক্ষিত-অদক্ষ একজন শ্রমিকের চেয়ে ক্ষেত্রবিশেষে ১০ গুণ বা তার বেশি আয় করলেও তাদের আয়ের বেশিরভাগ অর্থ সে সব দেশে পরিবার পরিজনদের ভরণ-পোষণ, সন্তানদের লেখাপড়া ও সামাজিক স্ট্যাটাস রক্ষা করতেই ব্যয় হয়ে যায়। এসব ইমিগ্র্যান্ট বাংলাদেশিরা বিশ্বে বাংলাদেশি ডায়াসপোরাকে সমৃদ্ধ করতে অবদান রাখলেও তাদের মেধা ও অর্থে বাংলাদেশ যতটা লাভবান হতে পারতো তার এক আনাও পাচ্ছে না দেশ। এসব মেধাবীদের গড়ে উঠতে এবং বিদেশে ফেলোশিপ ও উচ্চশিক্ষার পেছনে দেশের মানুষের যে পরিমাণ ট্যাক্সের পয়সা খরচ হয়েছে, তার প্রতিদান থেকে দেশের মানুষ চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ লাভের সাথে সাথে বাংলাদেশি প্রতিভাবান গবেষক ও উদ্ভাবকরা নিজেদের মেধা ও প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন, এটা যেমন সত্য, একইভাবে সেই প্রতিভাকে দেশের প্রয়োজনে, দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে যে কমিটমেন্ট বা ব্যক্তিগত-সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে হয় তার যথাযথ প্রতিফলন ঘটাতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। একজন এমবিবিএস ডাক্তার বা কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারের পেছনে গরিব দেশের মানুষের ট্যাক্সের লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয়। দেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রয়োজনে উন্নত, বিশেষায়িত পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞ তৈরি করতেই এসব বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পেছনে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। মেধাবীরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর গবেষণা ও ডিগ্রি নিয়ে দেশে এসে দেশের প্রয়োজনে তা কাজে লাগাবে, এটাই দেশের মানুষের স্বাভাবিক দাবি। এই দাবিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ধরনের ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন তা না থাকার কারণেই অধিকাংশ মেধাবী গবেষকরা দেশে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ও কাজের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় বিদেশেই স্থায়ী আবাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে, যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা, গবেষণার মধ্য দিয়ে তাদের মেধা ও উদ্ভাবনী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে সেখানে অঢেল বিত্ত-বৈভবে জীবন যাপনের সুযোগ থাকার পরও দেশের প্রতি ও দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও কমিটমেন্টের কারণে দেশে এসে নিরাপত্তাহীন সংগ্রামী জীবন বেছে নেয়ার অনেক উদাহরণ আছে।

ইউরোপীয় রেঁনেসার বহু আগে ইসলাম ধর্মেই প্রথম সব মানুষের জন্য শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ইউরোপীয় রেঁনেসা ও শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, নাভাল পাওয়ার ও ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর ভর করে যে নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্ম হয়, সেখানে সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে মুসলমানদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার উপর। শত শত বছরে গড়ে ওঠা অটোমান ও মুঘলদের শিক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে যে ধর্মীয় নৈতিকতা ও আধ্যাত্মবাদের সমন্বয় ঘটেছিল, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সূচিত শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথমেই সে সব ধর্মীয় সামাজিক মূল্যবোধের উপর আঘাত করেছিল। অথচ এরাই আবার আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় বাইবেলের শিক্ষা ও খ্রিস্টীয় নৈতিকতার প্রতিফলন ঘটানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছিল। পক্ষান্তরে ভারত-বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বড় অংশ জুড়েই ছিল ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধের সম্পৃক্ততা। কোম্পানি আমলে গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার পুরনো পরিকাঠামোকে ধরে রাখার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও পরবর্তীতে ম্যাকলের শিক্ষানীতিতে ভারতে বৃটিশ ঔপনিবেশিক স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেখানে শিক্ষার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজি ভাষা-সংস্কৃতি, বৃটিশ প্রশাসন এবং পুঁজিবাদী স্বার্থের অনুসঙ্গ। হাজার বছরে গড়ে ওঠা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মেলবন্ধনের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রকে নড়বড়ে করে দিয়ে দুই জাতির মধ্যে বিভেদ-বিসম্বাদ ও হিংসার বীজ ছড়িয়ে দিতে বৃটিশদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক সংস্কার মূল ভূমিকা পালন করেছিল। ইসলামে শিক্ষা হচ্ছে মানবিক উৎকর্ষের সোপান, যা মানুষকে জীবন-জগৎ ও আধ্যাত্মবোধের দ্বারা সমৃৃদ্ধ করে তোলে। ইসলামের সার্বজনীন শিক্ষার অন্তর্নিহিত বোধ উপেক্ষা করে মানুষকে শুধুমাত্র পণ্যের উৎপাদনশীলতার সাথে সম্পৃক্ত করে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের অবলম্বন হিসেবে গড়ে তোলা হয়। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমল পেরিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ৭০ বছর পেরিয়ে এসেও আমরা এখনো আমাদের শেকড় সন্ধানী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। যতই দিন যাচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ততই ভোগবাদী, বৈষম্যমূলক ও পুঁজিবাদী হয়ে পড়েছে। সে অর্থেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। শুধু যে উন্নততর কর্ম পরিবেশ ও শিক্ষা গবেষণার সুযোগ নিতেই দেশ থেকে হাজার হাজার মেধাবী তরুণ বিদেশে চলে যাচ্ছে তা নয়। এমনকি সাধারণ শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত লাখ লাখ তরুণ দলে দলে দেশ ছাড়ছে উচ্চ আয় এবং উন্নত জীবনমান অর্জনের লক্ষ্যে। এরা বিদেশে গিয়ে শ্রম বিক্রি করে সে সব দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। প্রায় এক কোটি প্রবাসী জনশক্তির পাঠানো রেমিটেন্সের বিপরীতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় দেশেও নানামুখী অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও উৎপাদনশীন কর্মমুর্খী উদ্যোগ হাতে নেয়া হচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ওষুধ শিল্প, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতসহ বিভিন্ন রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলেও আমাদের সাধারণ ও কারিগরী শিক্ষাব্যবস্থা এসব খাতের জন্য প্রয়োজনীয় জনশক্তির আঞ্জাম দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অথবা দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও নীতিমালা না থাকায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যথেচ্ছভাবে বিদেশিদের নিয়োগ দিয়ে দেশ থেকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১ কোটি প্রবাসী জনশক্তি বছরে যে পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে আনছেন শুধুমাত্র ভারতীয় কর্মীরা তার এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বাদ দিলে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা পুঁজিবাদী মানদন্ডেও আমাদের চলমান শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যর্থ।

আইন প্রণেতা, বিচারবিভাগ, শাসন ব্যবস্থা, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, বিনিয়োগ ও আমদানি-রফতানি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্টদের সবাই উচ্চ শিক্ষিত। যারা বছরে ৫-৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করছে, যারা সরকারি ক্রয়ের নামে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক প্রকল্পে বালিশ কিনতে বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কিনতে যারা শতগুণ বেশি ব্যয় দেখিয়ে জনগণের অর্থ লোপাট করছে তাদের প্রায় সবাই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবান উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার ও আমলা। অর্থপাচার, লুটপাট, ক্যাসিনো জুয়া, মাদক ও মানব পাচারের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে দেশে খুন-ধর্ষণসহ পৈশাচিক কর্মকান্ড বেড়ে চলেছে। দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে পিটিয়ে হত্যা করার মতো ঘটনা পুরো জাতি স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক মদত ও ছত্রছায়ায় মাদরাসা শিক্ষককেও ধর্ষক ও হন্তারকের ভূমিকায় দেখা গেছে। একপাক্ষিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রশাসনের সর্বত্র দলীয় পরিচয় ও বিবেচনায় নিয়োগ পদায়নসহ সামগ্রিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে। এহেন বাস্তবতায় দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে সরকারি দলের মধ্যম সারির বেশকিছু ডাকসাইটে নেতা গ্রেফতার হয়েছে। তবে ১৭৮ জনের তালিকা নিয়ে দুর্নীতিদ দমন কমিশনের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে বলে গত সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযান অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি বার বার দেওয়া হলেও যুবলীগ নেতা ঈসমাইল হোসেন চৌধুরী স¤্রাট গ্রেফতার হওয়ার পর গত এক মাসের বেশি সময়ে আর কোনো নেতাকে গ্রেফতার হতে দেখা যায়নি। দেশ থেকে প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, ৪০ টাকা দরে পেঁয়াজ আমদানি করে পাইকারি বাজারে দেড়শ টাকায় বিক্রি করা-সহ ভোগ্যপণ্যের মূল্য কারসাজি করে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার সাথে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করা দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দুঃসাধ্য নয়। পাঁচ-দশহাজার টাকার ক্ষুদ্র কৃষিঋণের জন্য সার্টিফিকেট মামলায় দেশের হাজার হাজার প্রান্তিক কৃষকদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ নিয়ে গেলেও দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়া ব্যাংক লুটেরা, টেন্ডারবাজ, সরকারি জমি ও নদীদখলবাজ, শেয়ারবাজার কারসাজির হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে। সরকারি সংস্থার ঠিকাদারি থেকে শুরু করে স্কুল-মাদরাসা ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসেবে সারাদেশে যারা বসে আছে তাদের বেশিরভাগই একেকজন রিফাত ফরাজি, তুফান সরকার, এরশাদ সিকদার বা মোকিম গাজীর ভূমিকায় বিচরণশীল। বছরের একেবারে শুরুতে ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে ফেনীর সোনাগাজীতে চার সন্তানের জননী এক নারী স্থানীয় আওয়ামী-যুবলীগ কর্মীদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল। সারা বছর ধরেই ধর্ষণের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে এক শ্রেণির স্থানীয় বখাটে মাস্তান। এদের অনেকে সরকারি দলের স্থানীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় তারা অনেক বেশি বেপরোয়া হয়ে অপকর্ম চালাচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)’র প্রতিবেদন অনুসারে সোমবার ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, গত ৬ মাসে দেশে ৬৩০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সাধারণত পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট ও থানায় করা মামলার সংখ্যা দিয়ে এ ধরনের পরিসংখ্যান তৈরি করলেও হত্যা ও ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্যাতন সংক্রান্ত ডেস্কের তথ্য অনুসারে, দেশের ১১টি মেডিকেল কলেজের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে(ওসিসি) গত আড়াই বছরে ৩৮ হাজার ১২৪ নারী ভর্তি হয়েছে। এটিও কোনো পূর্ণাঙ্গ হিসাব নয়। গত আড়াই বছরে এ হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ৪২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় এক নারীকে মিথ্যা অপবাদে বটি দিয়ে তার চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক আওয়ামীলীগ নেতার বিরুদ্ধে। হাইকোর্টের একজন আইনজীবী এই সংবাদ হাইকোর্টের বিচারপতির নজরে আনলে সিরাজগঞ্জের ডিসি, এসপি এবং উল্লাপাড়া থানার ওসিসহ স্থানীয় প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে জানাতে ডেপুটি এটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সারাদেশে প্রতিদিন এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে, বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটি ঘটনা গণমাধ্যম ও আদালতের নজরে আসলেও বাকি সব ঘটনা স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা লোকচক্ষুর অন্তরালে ধামাচাপা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিলম্বিত বিচার, অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ ইত্যাদি কারণে দেশে খুন, ধর্ষণ, দখলবাজির মতো গুরুতর অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলেছে বলে মনে করছেন দেশের সমাজ বিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ না থাকা, মানুষের মত প্রকাশ ও প্রতিবাদী ভূমিকা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় এক পাক্ষিক ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে দুর্বৃত্তরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সেই সাথে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এক শ্রেণির মানুষ দানবীয় শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।

আইনের সব হাত আপসহীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী না হলে দানবীয় রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবেলা করে সমাজে ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র হঠাৎ করেই এমন বিভৎষ হয়ে উঠেনি। দীর্ঘদিনের অনৈতিক শিক্ষা, ভোগবাদী জীবন দর্শন এবং প্রশাসনের দলীয়করণ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এ এমন এক সময়, যখন ৫ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়। পিতা-মাতার হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে পিতা-মাতা হত্যার শিকার হয়। ধর্ষণ-নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে পুনরায় ধর্ষণের শিকার হতে হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক মামলাবাজিকে পুঁজি করে যখন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য অগাধ ক্ষমতা ও বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে যায়, তখন শুধুমাত্র দুদকের অভিযান চালিয়ে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। দেশের সব নাগরিকের জন্য সম্মানজনক, নিরাপদ ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলতে হলে প্রথমেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন থামাতে হবে। গত সাত দশক ধরে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট চলছে। বার বার শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও কোনো শিক্ষানীতিতেই বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলের সূচিত ভোগবাদী-পুঁজিবাদি শিক্ষানীতির নিগড় থেকে বেরিয়ে আসার পথনির্দেশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শিক্ষার উপরি কাঠামো এবং কর্মমুখী কারিকুলামের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরও দেশের উৎপাদন, বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক কর্মসংস্থানের উপযোগী জনশক্তির যোগান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার পুঁজি বৈদেশিক মুদ্রায় পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়েও অনেক বেশি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সরকার উপযুক্ত কর্মসংস্থান ও সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারায় দেশের মেধাবী সন্তানরা বিদেশে চলে যাচ্ছে। অথচ শুধুমাত্র মেধাবী ও উদ্ভাবনী প্রতিভা এবং দক্ষ জনশক্তির উপর ভর করে জাপান, কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডের মতো অনেক দেশ প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ ছাড়াই বিশ্বের শীর্ষ উন্নত ও ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ আমেরিকার নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশি গবেষকদের যে সব সাফল্যের কথা জানা যায়, তা যদি দেশের জন্য কাজে লাগানো যেত তাহলে অনেক আগেই বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হতো। ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পর্দাথ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের সমমান ও সমান মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর বাংলাদেশি সহকর্মী বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। অবসর জীবনে পশ্চিমা দুনিয়ার বৈভব পরিহার করে বাংলাদেশে ফিরে এলেও এ দেশের সরকার তার মেধা ও প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেনি। ২০১৩ সালে ৭৪ বছর বয়েসে জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামে মৃত্যু বরণ করার পর তাঁকে এবং স্টিফেন হকিংকে যারা কাছ থেকে জানতেন, তাদের কেউ কেউ দুজনের মধ্যে জামাল নজরুলকে মেধা ও প্রতিভায় স্টিফেন হকিংয়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার দাবি করেছেন। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নাসার গবেষকদের মধ্যে বাংলাদেশি তরুণরা বিস্ময়কর মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হচ্ছে। জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী প্রতিভা মূল্যায়ন করে ৩ জনকে পুরস্কার ও সনদ প্রদান করে থাকে। গত সপ্তাহে ঘোষিত এ বছরের ৩ জন পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২ জনই বাংলাদেশের। সারমিন মিতু ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞানে ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়ে জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিমার সায়েন্সে মাস্টার্স করছেন। পলিমার সায়েন্সে উদ্ভাবনী প্রতিভা হিসেবে পুরস্কার প্রাপ্ত অন্যজন আবির তালুকদার খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়ে হালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিমার সায়েন্সে মাস্টার্স করছেন। এদের উদ্ভাবনী প্রতিভাব জার্মানির শিল্পোন্নয়নের কাজে লাগবে, নাকি বাংলাদেশের, এটি যেমন একদিকে তাদের নিজস্ব শিক্ষা ও মূল্যবোধের বিষয়, অন্যদিকে আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থারও দায় রয়েছে নিজেদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমাদের সন্তানদের প্রতিভা ও সম্ভাবনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যারা দেশের টাকা লুট করে বিদেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন, দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নিজেদের সন্তানদের বিদেশে লেখাপড়া ও বসবাসের ব্যবস্থা করছেন, তাদের দ্বারা দেশের মেধা ও সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন