শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

বাংলাদেশের চিত্রকলা

শাহরিয়ার সোহেল | প্রকাশের সময় : ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৮:৪১ পিএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
একই শিল্পী বিভিন্ন ধারায় কাজ করেছেন।
লোকজ-আধুনিক ধারায় অনেকেই ছবি এঁকেছেন। অনেকেই যামিনী রায়ের শিল্পাঙ্কন পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। হালকা প্রাথমিক রং ও দ্বিমাত্রিক ডিজাইনের মাধ্যমে স্বচ্ছল, সবেগ ও সতেজ স্টাইল নির্মাণ করেছেন। বিশেষত ফিগারেটিভ বা স্বাস্থ্যবতী গ্রাম্য লাস্যময়ী রমনীদের চিত্র অংকনের ওপরই প্রাধান্য দিয়েছেন এ ধারার অনেকে। এস.এম.সুলতান, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান প্রমুখ মূলত এ ধারার শিল্পী। শুধু রমনীদের এঁেকছেন তা নয়, আবহমান বাংলার প্রকৃতির চিত্রও চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের ক্যানভাসে। আধুনিক পাশ্চাত্য চিত্র কলার ধারার সাথে এ ধারার তেমন কোন মিল নাই। তবে এ শিল্পীরাই কখনো রিয়েলিস্ট এক্সপ্রেশনিস্ট, কখনো লোকজ আধুনিক, কখনো এক্সপ্রেশনিস্ট ধারায় এঁকেছেন। তাদের ছবির মূল প্রেরণা ছিল গ্রাম বাংলা, বাংলার লোক-শিল্প, গণ-জীবন প্রভৃতি। যেমন, কর্ষণ, গুনটানা নৌকা, মাঝি, গরুর গাড়ীর চালক, সাপুড়ে মেয়ে প্রভৃতি। বাংলাদেশের চিত্র শিল্পের সার্থকতা এদের হাত ধরেই পরবর্তীতে পৌঁছে যায়।
পাশ্চাত্য-বাঙালী ধারা বাংলাদেশের চিত্রকলার দ্বিতীয় প্রধান ধারা। এ ধারায় পাশ্চাত্যের সাথে লোক শিল্পের বিশেষ সংমিশ্রণ ঘটেছে। এ ধারার প্রধান শিল্পীদের ভেতর রয়েছে শফিউদ্দিন আহমদ, কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ। তাদের ছবিগুলি প্রধানত তল নির্মাণ করে করা হতো। কেউ কেউ কোন মানুষের ফিগার আকেঁন নি। নদী, বন্যা, নৌকা, জাল, উদ্ভিদ ইত্যাদি ছিল তাদের শিল্প প্রেরণার মূল। আবার কেউ কেউ নিসর্গ, লোকজ কর্ম বা মানবদেহের রূপ সবই সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ ধারায় দ্বি-মাত্রিকতার পরিবর্তে ত্রি-মাত্রিকতা সংযোজন করার প্রচেষ্টা চলে। এ ধারার ছবিগুলি কখনো উজ্জ্বল রং, কখনো হালকা, কখনো মিশ্র প্রভৃতি ভাবে চিত্রিত হতো। তেল রং এ ধারার প্রধান মাধ্যম। কিছুটা পাশ্চাত্য ধারার সাথে লোক শিল্প মিলিয়ে এগোতে থাকে পাশ্চাত্য-বাঙালী ধারা। এ ধারায় বাংলার নিসর্গ, চৈতন্য, মানুষ ও সংস্কৃতির প্রতীকিরূপ অধিক বিধৃত হয়েছে। কাব্য-ধর্মী হয়েও যেন বাস্তববাদী। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধারা এক্সপ্রেশনিস্ট এবং সিম্বলিক হয়ে ওঠে।
এদেশের আধুনিক শিল্পীদের বেশীর ভাগই পাশ্চাত্য-আধুনিক ধারার অন্তর্ভূক্ত। এ ধারা মূলত বিমূর্ত রূপ। বিমূর্ত রূপের ভেতর থেকেই প্রকৃতি ও স্যুকে শিল্পীরা অনুসন্ধান করেছেন। কিউবিজম, সুরিয়ালিজম, এক্সপ্রেশনিজম, এ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের দ্বারা এ ধারার ছবিগুলি প্রভাবিত। এ পর্যায়ে যারা ভাল করেছেন, তাদের ভেতরে রয়েছেন আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, কিবরিয়া, আব্দুল বাসেু, আবদুর রউফ, দেবদাস চক্রচর্তী প্রমুখ। নব প্রজন্মের অনেকেই এ ধারার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এ ধারায় ব্যক্তিগু অনুভূতি, রঙের স্বাধীন ব্যবহার, নিজ ইচ্ছাকে বৃহৎ আঙ্গিকে দেখাবার প্রচেষ্টা চলছে। এটি অনেকটা নিরীক্ষাধর্মী ধারা। এ ধারাতে ইসলামী, মোগল, লোক-বাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্য নিয়ে কিছুটা পাশ্চাত্য ধারার আদলে ত্রিমাত্রিক ভল্যুম প্রধান ডাইনামিক নির্বস্তুক চিত্র অংকন করা হচ্ছে। এগুলি অনেকটাই ম্যাজিক-রিয়ালিজম বা নিও-রিয়ালিজম জাতীয়।
বাংলাদেশের চিত্র শিল্পীরা বিশ্ব চিত্র শিল্পীদের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছেন। তবে এদেশের শিল্পীদের তেমন কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সহজে চোখে পড়ে না। প্রচলিত ধারা, ব্যবহৃত মাধ্যম, পরীক্ষিত দৃষ্টি ভঙ্গীর ভেতর থেকেই কাজ করছেন। তারপরও অনেকের কাজ দৃষ্টি নন্দন হচ্ছে। বাংলাদেশের চিত্রকলা মূলত লোকজ আধুনিক, পাশ্চাত্য-বাঙালী এবং পাশ্চাত্য-আধুনিক ধারার অনুসারী। এদেশের অনেক চিত্র কর্মই আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকিৃত পেয়েছে। যদিও এদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-পরিবেশ সর্বদা শিল্প প্রচেষ্টার অন্তরায়। শিল্প চর্চা এদেশে বিলাসিুার নামান্তর হয়ে পড়েছে। যে দেশের নাগরিকেরা মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যই সমগ্র প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়, সে দেশে প্রকৃত সুন্দর-স্বপ্নময় শিল্পী পাওয়া বেশ কষ্টকর। ড. মুহম্মদ শহীদুলল্লাহ বলেছিলেন, ‘যে দেশে গুণের কদর হয় না, সে দেশে জ্ঞানী-গুণী জন্মাতে পারে না। ’ এই নির্মম স্যুটি তিনি বহু পূর্বেই বুঝেছিলেন। এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য শিল্পীরা যদিও চেষ্টা করে চলেছেন, তবুও আরও বাস্তবিক পদক্ষেপ ও গণ-সচেতনতা প্রয়োজন। তবুও আমরা একেবারে আশাহত নই। এস এম সুলতানের বলিষ্ঠ কৃষক ও বাংলার রমনী সকল, প্রথম বৃক্ষরোপন, জয়নুল আবেদীনের ম্যাডোনা-৪৩, দুর্ভিক্ষের চিত্র সমূহ, কামরুল হাসানের বিখ্যাত পোস্টার, স্বাধীনতা ভিত্তিক চিত্র কর্মগুলি আমাদেরকে উজ্জীবিত করে, প্রাণবন্ত করে, উদ্ভাসিু করে, আবারও বেঁচে ওঠার আশা জাগায়। তরুণ প্রজন্মের অনেক শিল্পীরাই বাস্তবকে ধারণ করে শাশ্বত সুন্দরের চিত্র নির্মাণের প্রতি এগিয়ে চলেছেন। এ জাতি বহু বার প্রতারিত হয়েছে। কিন্তু অস্তিত্ব একেবারে শেষ হয়ে যায়নি এবং এ জাতিকে কেউ আবহমান কাল ধরে পরাজিত করে রাখতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এ জাতি জয়ী হয়েছে। আমাদের চিত্র শিল্পীরা এদেশ এ জাতিকে আরও বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে নিশ্চয়। পৃথিবীর বুকে এ দেশের মানচিত্র জ্বল জ্বল করবে নক্ষত্রের মতো, এটি আমাদের গভীর প্রত্যাশা। এদেশের শিল্পকলা বলিষ্ঠ, বৈচিত্র্যময় এবং উদ্দীপ্ত। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানের এসব চিত্রকলা সম্বন্ধে আমরা আশাবাদী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন