বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় স্মৃতি

নূরে আলম সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর এক সূর্যস্নাত অপরাহ্নে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে শাহজাহান সিরাজ ও আমি তেজগাঁর পুরনো বিমানবন্দরে অবতরণ করি। আনন্দ ও বেদনায় ভরা মনটা কেমন যেন একটা অদ্ভূত অনুভূতিতে নিমজ্জিত ছিল। সমস্ত অনুভূতির মধ্যে আশ্চর্য এক শিহরণ, রক্তের কণায় কণায় উদগ্র উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। সেই অনুভূতি লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করার শক্তি বা ভাষা আমার নাই। মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যোদয়ের মতো হৃদয়টা পুতপবিত্র অগ্নিচ্ছটায় উদ্ভাসিত ছিল। এটি কোনদিনই বিস্মৃত হবার নয়।

দুটি ঘটনা সমস্ত চিত্তকে একটি অবর্ণনীয় বেদনায় দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিল। একটি- লাখো লাখো মানুষের বুকনিঃসৃত রক্তদানের পুতপবিত্র গর্বের অনুভূতি ও সহস্র সহস্র সতী-সাধ্বী বাঙালি নারীর সতীত্ব হারানোর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কেঁদে ওঠার বেদনাপ্লুত অনুভূতি। অন্যটি আমার প্রাণের মুজিব ভাই তখন কোথায় কী অবস্থায় আছেন জানি না। আমি সুনিশ্চিত, মুজিব ছাড়া মুজিবের বাংলার স্বাধীনতা অপূর্ণ তো রয়েই যায়, সেই স্বাধীনতা আমি কেন, কোন বাঙালিরই কাম্য নয়।

পশ্চিমবঙ্গের (কোলকাতার) সামরিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে যশোর প্রান্ত দিয়ে ঢুকতেই দু’চোখ অশ্রুতে ভিজে উঠলো। সে এক অবর্ণনীয় গৌরবের আবীরমাখানো জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে বাংলাদেশকে অবলোকন করেই দু’চোখ অশ্রুসজল হয়েছিল তো বটেই, তবুও চিৎকার করে কেঁদে উঠতে মন চেয়েছিল। আল্লাহর কাছে অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে সাথে সমস্ত অন্তরাত্মার অনুভ‚তি এক অদ্ভূত অনুরণনে আপ্লুত হচ্ছিল।

২৩ বছরের শোষণের চারণক্ষেত্রে পাকিস্তানের পাশবিক সেনাচক্রের লেলিহান কামনার শিখায় দগ্ধীভূত আমার প্রাণের চাইতেও প্রিয় মাতৃভ‚মি আজ মুক্ত ও সার্বভৌম। তার দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশ আর শস্যশ্যামল মাটির নয়ন জুড়ানো সবুজ শ্যামলিমা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে এক অব্যক্ত অনুরণন সৃষ্টি করছিল। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত হলেও আমার সোনার বাংলার মাটি, আমার দেশমাতৃকা আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম। অনেক রক্ত ও অশ্রু ঝরেছে, অনেক নির্যাতন ও নিগ্রহের স্মৃতিকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে। ২৩টি বছরের অনেক সংগ্রাম, অনেক আন্দোলনের বিস্তীর্ণ পথ আমাদের অতিক্রম করতে হয়েছে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উচ্ছ¡সিত উন্মুক্ত তরঙ্গমালার বক্ষ বিদীর্ণ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের তরণীটিকে অদম্য সাহসে বাইতে হয়েছে। সেই তরণী আজ সাফল্যের সৈকতে নোঙর করেছে। কোটি কোটি মানুষের অম্লান ও অবিস্মরণীয় আত্মদানের সঙ্গে আমিও থাকতে পেরেছিলাম। কারাগারের নির্জন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আমার যৌবনের উদ্বেলিত হৃদয়ের অনেকটা সময় ঝরে গেছে।

কারাগারের নির্যাতিত জীবনে মায়ের মৃত্যুসংবাদ শ্রবণ করে প্যারোল পাইনি। মৃত্যুপথযাত্রিনী মায়ের কান্না ইথারে ভেসে এসে আমার হৃদয়কে শুধু দগ্ধীভ‚তই করেনি, বেদনায় যন্ত্রণায় আমার অনুভূতিটাকে শুধু ক্ষতবিক্ষতই করেনি, মৃত্যুপথযাত্রিনী মায়ের আমাকে দেখতে চাওয়ার শেষ আকুতি আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করলেও মৃত্যুকালীন সময়ে শত প্রচেষ্টায়ও আমি প্যারোল পাইনি।

আমার মা না ফেরার দেশে চলে যাবার মুহূর্তে তাঁর শিয়রে বসে তাঁকে মমত্বের আবীরমাখানো ছোঁয়াটুকু দিতে পারিনি, মরণের প্রাক্কালে তাঁকে একটিবার মা বলে ডাকতে পারিনি। তাঁর কর্ণকুহরে কলেমা পাঠ করতে পারিনি, তাঁর জানাজা পড়তে পারিনি, লাশ কবরে নামিয়ে দাফন করতে পারিনি। তাইতো গণ-আন্দোলনে কারাগার থেকে বেরিয়ে গিয়ে মায়ের কবর থেকে একমুঠো মাটি তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলেছিলাম, মাগো, এই মাটিকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আমি তোমার কবর জিয়ারত করবো না। তাই সর্বদাই এ মাটিকে মুক্ত করার জন্য কবর থেকে তুমি আমাকে দোয়া করো।

উড়ন্ত হেলিকপ্টারে বসে আনন্দ ও বেদনাবিদুর হৃদয়ে তাই ভাবছিলাম- আমার মায়ের দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন। দেশমাতৃকার মাটি আজ শত্রুমুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতার সূর্যকিরণের বিকীর্ণ ছটায় আমার মাতৃভ‚মির মাটি আজ আলোকিত, উদ্ভাসিত। মুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম এ মাটির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে আর কেউ কোনদিন বিঘিœত করতে পারবে না, খর্ব করতে করতে পারবে না, পর্যুদস্ত করতে পারবে না।

হেলিকপ্টারে উপবিষ্ট আমি তখন ছাত্রলীগের সভাপতি। জীবনসায়াহ্নে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বর্তমান ছাত্রলীগের কর্মীসহ কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রী ভাইবোনদের হৃদয়নিঃসৃত পুতপবিত্র আশীর্বাদ করতে চাই, সেদিন আমরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য যে দীপ্ত পদচারণায় বিস্তীর্ণ পথ হেঁটেছিলাম, সেই দেশটিকে সুসংহত করার জন্য, তার ভৌগলিক অখন্ডতাকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় ধরে রাখার জন্য প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, রুটিরুজির নিশ্চয়তা এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে লালনের এবং পরিশীলিত মানসিকতার চর্চার জন্য নতুন প্রজন্মের সাধনা সম্পূর্ণ ক্লেশমুক্ত ও নিষ্কলুষ হোক।

আমরা ভৌগলিক স্বাধীনতা এনেছি। তোমরা অর্থনৈতিক স্বাধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করার ব্রত গ্রহণ কর। দেশমাতৃকা তার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য আমাদের চেয়েছিল। আজ অর্থনীতিকে সুসংহত করার, প্রতিহিংসার মানসিকতাকে বর্জন করার, সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার পরিশীলিত মানসিকতাকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে তোমাদের দিকে তৃষিত হৃদয়ে চেয়ে আছে।

দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আমরা দু’টি প্রজন্ম আত্মত্যাগের বিস্তীর্ণ পথে হেঁটেছি। নির্যাতন-নিগ্রহের দুস্তর বাধাকে অকুতোভয়ে অতিক্রম করেছি। সেই বাংলাকে প্রতিহিংসা, সাম্প্রদায়িকতা, অসহিষ্ণুতা এবং অবিশ্বাসীদের হাত হতে তোমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে।

১৬ ডিসেম্বরেই বিজয়ের মুহূর্তে উদ্যত উদ্ধত উদ্গত মানসিকতা নিয়ে আমাদের দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো একটি সংবাদ ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পৌঁছাল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, তারা আত্মসমর্পণ করবে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের নেতৃত্বের কাছে নয়।

এদিকে জেনারেল ওসমানী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্য মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে রওনা হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। নিছক জেদের বশবর্তী হয়ে আহাম্মকের মতো এই সিদ্ধান্তটি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ যে নিয়েছিল, সেটি ঐতিহাসিকভাবে তাদের ভুল সিদ্ধান্ত এবং বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠিতে তারা যে উন্মাদের পর্যায়ে ছিল, মূলত সেটিই প্রমাণ করেছে। এই সংবাদটি আমাদের কাছে বিস্ময় ও অসহনীয় যন্ত্রণার ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে যশোরের মুক্তাঙ্গন থেকে ফিরে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে এসে দেখলাম, কেমন যেন একটা বিমর্ষ ও থমথমে ভাব। একটা নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ দমবন্ধ করা পরিবেশ সেখানে বিরাজ করছিল। অবস্থাটা যে স্বাভাবিক না, তা বুঝতে কষ্ট হল না।

আমি সরাসরি তাজউদ্দীন ভাইয়ের কক্ষে চলে গেলাম। তিনি বিমর্ষ চিত্তে পাকিস্তানীদের হঠকারী সিদ্ধান্তটি আমাকে জানালেন। আমি খবরটি শুনে ভীষণভাবে মর্মাহত হলাম। তাজউদ্দীন ভাই খুব ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের অনাপত্তির কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি আমাকে বললেন, ভালোয় ভালোয় আত্মসমর্পণটা হয়ে যাক।

জেনারেল ওসমানী তো আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন না। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই দুঃখের। এ নিয়ে জেদ করার সুযোগ নাই। কারণ তাহলে একটা ঘোরপ্যাঁচ লেগে যেতে পারে এবং আত্মসমর্পণ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। যৌবনের উত্তেজনা, আবেগ, উচ্ছ¡াস সবকিছুকে অবদমিত করে আমিও কোনরকমের প্রতিবাদ ছাড়াই ব্যথিতচিত্তে চেয়ারে বসে রইলাম।

তাজউদ্দীন ভাই আমাকে বললেন, আপনার সঙ্গে জেনারেল ওসমানীর সুসম্পর্ক রয়েছে, আপনি তাঁর কক্ষে যান। ভদ্রলোক তো প্রচন্ড আবেগপ্রবণ ও একগুঁয়ে। ক্ষোভে দুঃখে আবার সেনাধ্যক্ষের পদ থেকে পদত্যাগ করে না বসেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে প্রতিরক্ষা দপ্তর ছিল বলে একটু পান থেকে চুন খসলেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে গিয়ে পদত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন।

বাংলাদেশ গুজবের প্রসূতিকাগার। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানীর কাছে আত্মসমর্র্পণ করতে না চাওয়ার সিদ্ধান্তটি পাকিস্তানীদের আহাম্মকির চ‚ড়ান্ত নিদর্শন ছিল। কেন যে তারা এরকম একটা বালখিল্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আজও আমাদের কাছে তার হিসেব মেলে না। কিন্তু পাকিস্তানীদের এই অপরিপক্ক, অদূরদর্শী ও বিদ্বেষমূলক সিদ্ধান্তটি এতবড় বিজয়ের মুহূর্তেও আমাদেরকে একটা অস্বস্থিকর পরিবেশের মুখে ঠেলে দেয়। দেশবাসীর মনে নানারকম প্রশ্নের উদয় হয়।

অনেকে ভেবেছিলেন, ভারত কৌশল করে জেনারেল ওসমানীকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেয়নি। আমাদের অর্জন ও সাফল্যকে ইচ্ছে করেই ভারত খাটো করতে চেয়েছে। এই জীবনসায়াহ্নে এসে এই বিতর্কের সুস্পষ্ট জবাব দেয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব। বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম যাতে সন্দেহের পরিমন্ডলে আদৌ অবরুদ্ধ না থাকে, সে কারণেই বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ও প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে আমি বলতে চাই, জেনারেল ওসমানীর অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ও ভারত সরকারের কিছুই করার ছিল না। এ ব্যাপারে জেদ করতে গেলে হয়তো নতুন কোন বিপর্যয় সৃষ্টি হতো। ফলাফলটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো বলা যায় না।

এখানে আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও এর প্রেক্ষাপট, পটভ‚মি ও পাদপীঠ রচনা করেছিল দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯৭০-এর নির্বাচনের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ১৬৭টি আসন। তার মধ্যে ১৬৫টি আসনে আমাদের বিজয় পৃথিবীর যেকোন দেশের মুক্তি আন্দোলনকারীদের কাছে ছিল একটি বিস্ময়কর ঘটনা।

এই বিজয়ে আমরা আনন্দিত, উদ্বেলিত ও উচ্ছ¡সিত হয়েছিলাম বটে, কিন্তু আশ্চর্যান্বিত ও বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলাম বললেও ভুল হবে না। নান্দাইলের নূরুল আমিন সাহেব এবং ত্রিপুরার রাজা ত্রিদিব রায় ছাড়া আওয়ামীলীগের আর সব রথী-মহারথীরা নির্বাচনে জনস্রোতের প্রচন্ড তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল।

প্রসঙ্গটি না বাড়িয়ে আমি দৃপ্ত চিত্তে বলতে চাই, ওই নির্বাচনটি অনুষ্ঠানের পূর্বে সশস্ত্র বিপ্লবের উদগ্র বাসনায় যারা বুদ হয়ে ছিলেন, তাদেরকে কটাক্ষ না করেও বলা যায়, তাদের গগণবিদারী ও চিত্তাকর্ষক সেøাগানে বিমোহিত হয়ে নির্বাচনের আগে সশস্ত্র বিপ্লবের ভ্রান্ত সিদ্ধান্তটি ‘মুজিব ভাই’ মেনে নিলে ১৬ ডিসেম্বরের প্রদীপ্ত সূর্য বাংলাদেশের পূর্ব দিগন্তে উদিত হতো কি না, আজও আমার সন্দেহ আছে। বাঙালির রাজনৈতিক সাফল্যের এই ম্যান্ডেটটিকে পাকিস্তানীরা অস্বীকার করার কারণেই বিশ্বজনমত ধীরে ধীরে আমাদের স্বাধীনতার সপক্ষে পাশে এসে দাঁড়ালো।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম স্টেটসম্যান শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী অতীব বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার ক‚টনৈতিক সফর করে সমগ্র ইউরোপের সক্রিয় সমর্থন আদায় এবং আমেরিকাকে সেন্টো-সিয়েটো চুক্তি থাকা সত্তে¡ও পাকিস্তানকে সমর্থন প্রদান থেকে বিরত রাখার যে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন, তাও ইন্ধিরা গান্ধীর একটি অসাধারণ ও ঐতিহাসিক সাফল্য।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহŸান করে আমেরিকাকে ভেটো প্রদান থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি আদায় কম সাফল্য ছিল না। বিষয়টি আমি জনাব ডি পি ধরের (বাংলাদেশ বিষয়ে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি ইন্ধিরা গান্ধীর বিশেষ দূত ছিলেন) কাছ থেকে অবহিত হই। তিনি আমাকে এও জানান যে, ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিষয়টিকে আমেরিকা জাতিসংঘে উত্থাপন বা ভেটো দেওয়ার চেষ্টা করবে না।

ডেটলাইনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শ্রীমতি গান্ধী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ নেতৃবৃন্দকে কোলকাতার রাজভবনে ডেকে বিষয়টি বিস্তারিত অবহিত করেন। এখানে ছোট্ট করে বলে রাখলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না, মুজিব বাহিনীর আতঙ্কে তাজউদ্দীন ভাই আমাকে খুব কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তাই সকল বিষয়েই তিনি আমাকে কাছে রাখতেন।

ভারত সরকারের সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তিনি আমাকে সাথে রাখতে চেষ্টা করতেন; রাখতে না পারলে বৈঠকের আলোচিত বিষয়গুলো আমাকে সম্যক অবহিত তো করতেনই। ইন্ধিরা গান্ধী ওই ব্রিফিংয়ে প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বকে জানিয়ে দেন, তিনি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি স্বীকৃতি দেবেন।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পরদিন কোলকাতার গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত সর্বকালের অন্যতম বৃহত্তম জনসভায় প্রায় একঘণ্টার ভাষণে তিনি তাঁর ইউরোপ আমেরিকা সফরের বিশদ বর্ণনা দিলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়েও তাঁর সহানুভ‚তি ও সহমর্মিতার কথা স্মরণ করলেন। কিন্তু সরাসরি বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়ে টুঁ শব্দটি করলেন না! সর্বজনাব মান্নান ভাই, ইউসুফ ভাই, সোহরাব ভাই, মোয়াজ্জেম ভাই ও আমি একসাথে বসে ভাষণ শুনছিলাম। স্বীকৃতি দেয়া প্রসঙ্গে কিছু উচ্চারণ না করায় আমরা একেবারেই মুষড়ে পড়েছিলাম।

আল্লাহর অসীম করুণায় জনসভা সমাপ্ত হবার পর ভগ্ন হৃদয়ে বিমর্ষ চিত্তে যখন থিয়েটার রোডে একটা ঘনঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে বসে ছিলাম, তখন হঠাৎ আকাশবাণী দিল্লি থেকে ঘোষণা শুনলাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। আবার আশা-নিরাশার দোলাচলে আমরা আবর্তিত হলাম। তবে হ্যাঁ, সেই গুরুগম্ভীর প্রত্যয়দৃঢ় বেতার ভাষণে তিনি প্রণিধানযোগ্য দু’টি বাক্য উচ্চারণ করলেন। ভারতের সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানী সৈন্যদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, আমরা যুদ্ধাক্রান্ত। আমি পাকিস্তান ভাঙতে চাইনি।

বাংলাদেশের অসহায় এক কোটি মানুষকে আমি যে আশ্রয় দিয়েছি, তাদেরকে জোর করে প্রত্যাবর্তন করিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারি না। অন্যদিকে যে দামাল ছেলেরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বীরদর্পে লড়াই করছে, আমি তাদেরকে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এবং বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে ভারত সরকারের স্বীকৃতি প্রদান করছি।

অদ্ভূত কৌশলী দূরদর্শী স্থিরপ্রত্যয়ী স্টেটস্ম্যান ছিলেন ইন্ধিরা গান্ধী। তখন বিশ্বরাজনীতিতে গুচ্ছ গুচ্ছ তারকায় ভরা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন, রাশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক ব্রেজনেভ, চীনে মাও সে তুং, ফ্রান্সে দ্য গোল, যুগোশ্লাভিয়ায় মার্শাল টিটোসহ বিশ্বরাজনীতির নভোমন্ডল অসংখ্য উজ্জ্বল তারকায় জ্বলজ্বল করতো। তার মধ্যেও সবচেয়ে প্রদীপ্ত তারকা মনে হতো ইন্ধিরা গান্ধীকে। তাঁর বুদ্ধিমত্তার জোরেই পাকিস্তান বিশ্বের সমর্থন হারায় ও একঘরে হয়ে যায়। এটি এতো সূক্ষèভাবে তিনি করতে পেরেছিলেন বলেই বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা এড়িয়ে ভারতের সক্রিয় সামরিক সমর্থনে মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর চতুর্মুখি দৃপ্ত আক্রমণে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছেÑ ‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না’। পরাজয়ের প্রাক্কালে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে তাদের এদেশীয় দোসরদের দিয়ে ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবি হত্যা এবং ব্যভিচারের জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এত দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতন-নিগ্রহ, বেদনা-যন্ত্রণা ও রক্তের সাগর পেরিয়ে সাফল্যের সৈকতে পৌঁছানো তরণী এবং পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করা স্বাধীনতার সূর্যকে আলিঙ্গন করতে যখন আমরা বাংলাদেশের রক্তস্নাত মাটিতে পদার্পণ করলাম, তখন মুক্তিপাগল মানুষের যে উচ্ছ¡সিত সংবর্ধনা পেয়েছিলাম, তার তুলনা কোনকিছুর সাথেই হবার নয়।

আ স ম আব্দুর রব এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন যুদ্ধকালীন সময়ে আগরতলায় সংগ্রামরত ছিলেন। তারা ইতোমধ্যেই ঢাকায় এসে শুধু পৌঁছানই নাই, বেতারকেন্দ্রসহ ঢাকা নগরীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের অগ্রবর্তী দল হিসেবে আমরা ঢাকায় এসেছিলাম। তাজউদ্দীন ভাই বুঝতে চেয়েছিলেন, তাদের সরকারের নিয়ন্ত্রণ সদ্যমুক্ত স্বাধীন দেশে কতটুকু রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (19)
Md Akash ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৩২ এএম says : 0
বিজয়ের ৪৮ বছর আজ। তাই ১ম প্রহরে আমার পক্ষ থেকে সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
Total Reply(0)
Md Razon Razon ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৩২ এএম says : 0
মুক্তির লাল সবুজ উল্লাসে পাজরের বন্ধন গুলো অন্য আলোয় উদ্ভাসিত মাসের লালিত ক্ষোভের দাবানলে ক্ষয় হয়ে যাক মনের সব নীচতা, মৌনতা, হীনতা সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা...
Total Reply(0)
Mð Háśáń Mhàmúð ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৩৩ এএম says : 0
যদি আমরা রাখি ভালো, তবেই থাকবে ভালো বাংলাদেশ।
Total Reply(0)
Imran Ali ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৩৩ এএম says : 0
শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা , ভালোবাসা ও দোয়া ।
Total Reply(0)
Prince Arafat ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৩৩ এএম says : 0
বিজয় মানে একটা মানচিত্র, বিজয় মানে একটা লাল সবুজের পতাকা, বিজয় মানে একটা গর্বিত জাতি, বিজয় মানে অস্তিত্বে বাংলাদেশ। বিজয়ের ৪৭ বছর পূর্তিতে এই গর্বিত জাতি গড়ার সকল কারিগরকে মন থেকে জানাই শুভেচ্ছা।
Total Reply(0)
আহলে বায়াত ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৩৩ এএম says : 0
যাদের রক্তে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীন বাংলা তাদের তরে জানাই হাজারও বিনম্র শ্রদ্ধা এবং সালাম
Total Reply(0)
Md Masud Hawlader ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৩৪ এএম says : 0
#একাত্তরে #লাখো_বাঙালির আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশের বিজয়। মা এবং মাতৃভূমিকে জিতিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যকে মনে লালন করে, আজও লড়াই করে চলেছেন দেশের অসংখ্য বীর সন্তান। তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল করে চলেছেন বাংলাদেশের নাম। কারণ, আমরা জিতলেই জিতে যায় মাতৃভূমি।
Total Reply(0)
Nasir Uddin Sajeeb ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:১২ এএম says : 0
আজ ১৬ ডিসেম্বর। ৪৮তম মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্য-বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার
Total Reply(0)
Salauddin Uzzal ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:১২ এএম says : 0
একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার " সবাইকে মহান বিজয় দিবসের লাল-সবুজ শুভেচ্ছা।
Total Reply(0)
Soppno Otut ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:১২ এএম says : 0
আমাদের জীবনে এই মাসটি আসুক হাজার হাজার বছর । লাখো শহীদদের প্রতি বিনম্রশ্রদ্ধা !!
Total Reply(0)
সাইফুল ইসলাম চঞ্চল ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:১৩ এএম says : 0
স্যার নূরে আলম সিদ্দিকী আমার খুব পছন্দের মানুষ।
Total Reply(0)
নীল প্রজাপতি ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:১৪ এএম says : 0
লেখাটি পড়ে অনেক ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম।
Total Reply(0)
Kazi Md Obiadullah Kazi ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:১৫ এএম says : 0
মাশাআল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ সকলকে আন্তরিক মোবারকবাদ আল্লাহপাক সকলকে হেফাজত করুন যালিমদের হাত থেকে আমিন
Total Reply(0)
Md Morshed O Positive ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:১৬ এএম says : 0
মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
Total Reply(0)
কামরুজ্জামান ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১০:২৮ এএম says : 0
মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় স্মৃতি তুলে ধরায় নূরে আলম সিদ্দিকী স্যারকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)
সোয়েব আহমেদ ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১০:২৯ এএম says : 0
দৈনিক ইনকিলাবে নিয়মিত নূরে আলম সিদ্দিকী সাহেবের লেখা চাই
Total Reply(0)
নাজিম উদ্দিন ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১০:৩১ এএম says : 0
নূরে আলম সিদ্দিকী সাহেবের মত বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে দেশের সঠিক ইতিহাস জানা যায়। তাই তার কাছে নিয়মিত লেখার জন্য অনুরোধ রইলো
Total Reply(0)
কাওসার আহমেদ ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১০:৩৩ এএম says : 0
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাশাপাশি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও এর সমাধানের বা এর থেকে উত্তরণের দিকনির্দেশনামুলক লেখা প্রত্যাশা করছি
Total Reply(0)
Niloy Khan ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১১:০৬ এএম says : 0
Thanks a lot to the writer
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন