রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মতিঝিল, দিলকুশা ও জাতীয় প্রেসক্লাবের আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। সড়কজুড়ে রাখা হয়েছে মেট্রোরেল সড়ক নির্মাণ সামগ্রীসহ স্যুয়ারেজ লাইনের কাজের জন্য আনা ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের পাইপ। খুঁড়ে তোলা মাটি ও পিচ-পাথরের বড় বড় খন্ড সড়কেই স্ত‚প করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে দিনে-রাতে বিরতিহীন চলছে মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ও ব্যাংক পাড়া হিসেবে খ্যাত মতিঝিলে উপর দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে থাকে। চলাচলের বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ চলার কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কগুলো কোথাও ৬/৭ ফুটের সরু সড়কে রূপ নিয়েছে আবার কোথাও একেবারেই বন্ধ রয়েছে। তবুও ঝুঁকি নিয়ে এই সড়কগুলোতে যানবাহন চলছে। এ নিয়ে ঢাকার এসব এলাকার বিভিন্ন অফিসের লোকজন, দোকানি, যানবাহনের আরোহী ও পথচারীদের বিরক্তির শেষ নেই।
দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা রাজধানীর মতিঝিল। তারই পাশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দিলকুশার প্রধান সড়কটি উন্নয়ন কাজের নামে কেটে অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে গত প্রায় ৮ মাসের বেশি সময়। ফলে এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারীরা পড়েছেন দুর্ভোগে। প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দীর্ঘায়িত হওয়ায় বৃষ্টি হলে কাদা-পানি আর রোদ উঠলে বাতাসে ধুলি-কণা ছড়িয়ে পড়ছে। এতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি বৃষ্টির পানি জমে সৃষ্টি হয় বিপজ্জনক পরিস্থিতির। সড়কজুড়ে মাটি স্ত‚প করে রাখায় ব্যাহত হচ্ছে যানবাহন চলাচল। এ কাজ কবে শেষ হবে সে ব্যাপারে কারোই কিছু জানা নেই।
এ চিত্র শুধু মতিঝিল দিলকুশা এলাকার নয়। রাজধানীজুড়েই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। নগরীর এমন কোনো সড়ক বা অলিগলি নেই, যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে না। এরমধ্যে দুয়েকটি সড়ক দিয়ে কোনো রকম চলাফেরা করা গেলেও অনেক রাস্তায় এখন চলাচল কষ্টসাধ্য। সিটি কর্পোরেশন ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ, মেট্রোরেলের কাজ, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সবাই মিলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়ক, অলিগলি খুঁড়ছে। আজ এই প্রতিষ্ঠান কাটছে তো কাল কাটছে আরেক প্রতিষ্ঠান। এমনকি এক প্রতিষ্ঠান কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পরদিন আরেক প্রতিষ্ঠান এসে নতুন করে খুঁড়ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এমন সমন্বয়হীনতায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রাজধানীবাসী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতা বা দুর্বলতার জন্যই নগরীর এই বেহাল দশা।
গতকাল দিলকুশায় সরেজমিন দেখা যায়, পিপলস ইনস্যুরেন্স ভবনের কাছে বড় বড় গর্ত করা হয়েছে। খোঁড়ার পর মাটি এবং পিচ-পাথরের বড় বড় খন্ড এলোপাতাড়িভাবে রাস্তার ওপরই রাখা হয়েছে। পিপলস ইনস্যুরেন্স ভবন থেকে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) ভবন হয়ে প্রায় ২০০ মিটার পশ্চিমে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস কার্যালয় পর্যন্ত এলাকায় পাইপ বসানোর কাজ অন্তত দুইমাস আগে শেষ হয়ে গেলেও এখনো এই সড়কটিতে কার্পেটিং করা হয়নি। এ অবস্থায় সড়কটি দিয়ে গত ছয় মাসেরও বেশি সময় কোনো প্রকার যানবাবহ চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবুও ওই এলাকায় যারা অফিস করেন কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই সড়কটি ব্যবহার করতে হচ্ছে।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে দেখা যায়, এভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করা ও সংস্কারের অভাবে এবরোথেবরো হয়ে থাকা সড়কটিতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়ে আছে। সাধারণত অফিস ছুটি হলে বিসিআইসি ভবনের সামনে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বাসের কারণে যানজট লেগে থাকে। বর্তমানে তা আরও তীব্র হয়েছে। গর্ত আর বড় বড় পাইপ রাখায় গতকাল সেখানে পাশাপাশি দুটির বেশি বাসও রাখা যাচ্ছিল না। সেসব বাসের কয়েকটি দাঁড়ায় বঙ্গভবনের সীমানা দেয়ালের পার্শ্ববর্তী রাস্তায়। এর ফলে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের পাশে মতিঝিল এলাকায়, ইসলামী ব্যাংক ভবনের কাছে দিলকুশা এলাকায়, এমনকি রাজউক ভবনের দক্ষিণ দিকের রাস্তায়ও যানবাহন প্রায় স্থবির হয়ে ছিল। বিসিআইসি ভবনের কাছে ফলমূল আর সবজির বাজার বসে। কিন্তু এখন তা বসছে বিচ্ছিন্নভাবে। অনেকে পাইপের ভেতরে পণ্যসামগ্রী রেখেছেন। সেখানে ছোট ছোট ছেলেদের পাহারায় বসানো হয়েছে।
সংস্কারহীন এ সড়কটিতে অফিস ছুটির পর যানজট আর পথচারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাঁটার জায়গাও থাকে না। অফিস শেষে বিসিআইসির কর্মকর্তা মোহাম্মদ জামির উদ্দিন রাস্তায় নেমেই বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, কথা নেই, একটি সড়ক উন্নয়ন কাজের জন্য খুঁড়ে রেখে কতদিন এভাবে অচল করে রাখা যায়। কারই যেন কোন দায়িত্ব জ্ঞান নেই এটা একটা জনগুত্বপূর্ণ এলাকা। তিনি বলেন, ঢাকা হলো বাংলাদেশের রাজধানী আর মতিঝিল হলো ঢাকার রাজধানী। এতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সড়ক যদি দীর্ঘদিন এভাবে সংস্কারের অভাবে অচল হয়ে পড়ে থাকতে পারে তাহলে সহজেই বোঝা যায় সারা দেশের উন্নয়নের কি দশা।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আঞ্জুমান আরা নারিন্দা যাবেন। রিকশা খুব কম। একটি রিকশা যেতে রাজি হলে দরদাম না করেই উঠে পড়েন। পরে দেখা গেল, রিকশা সামনে এগোতেই পারছিল না। বিরক্ত হয়ে নেমে তিনি হাঁটা শুরু করলেন। তিনি একটু জোরের সঙ্গেই খেদোক্তি করেন, আর কতদিন এ ভোগান্তি ও কষ্ট সহ্য করতে হবে আমাদেরকে।
মতিঝিল সেনা কল্যাণ ভবনের পাশ দিয়ে কমলাপুরের দিকে যাওয়ার সড়কটিও গত প্রায় বছরখানেকের মত বন্ধ রয়েছে। ড্রেনেজ নির্মাণের কাজের জন্য এই সড়কটি খোঁড়া হলেও কাজ শেষ হয়ে গেছে প্রায় তিন মাসের উপরে হবে। আজো সড়কটির সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে না। এই সড়কটি দিয়ে কমলাপুর, মুগদাপাড়া, মায়াকানন, আহম্মদবাগ, মান্ড, মানিকনগরসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় চার লাখ লোক মহানগরের মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করে থাকেন। দীর্ঘদিন এই সড়কটি বন্ধ থাকার কারণে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ আর ভোগান্তির মধ্যদিয়ে ওই সমস্ত এলাকার মানুষ এই সড়কটি ব্যবহার করতে হচ্ছে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সমনের সড়কে দীর্ঘদিন ধরে চলছে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ। যে কারণে প্রেসক্লাবের দুই পাশের সড়কই এখন ৬/৭ ফুট সরু রাস্তা হয়ে গেছে। এর মধ্যে একটু পর পর বিশাল গর্ত। সেখানেও গর্তের মাটি আর রাস্তার ভাঙা অংশ যথেচ্ছভাবে রাখা হয়েছে। এতে ওই সড়কে যানজট বেড়ে গেছে। জের পড়েছে একদিকে পল্টন মোড়, গুলিস্তান ও দৈনিক বাংলার মোড় এলাকায়, অন্যদিকে নয়াপল্টন ও পুরানা পল্টন কালভার্ট রোডে। বাসাবোসহ ঢাকার পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি এলাকার টেম্পো চলাচল করে দৈনিক বাংলার মোড় থেকে। যানজটের কারণে এখন চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। স্থানীয় পদ্মা গøাসের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, দুই বছর আগেও এই সড়কে সিটি কর্পোরেশন খোঁড়াখুঁড়ি করেছে। পাইপ বসানোর ছয় মাস পর সড়ক মেরামত করা হয়। এখন চলছে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজের জন্য। নতুন করে আবার দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট ২ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ বলেন, দিলকুশা ছাড়াও মতিঝিল, ফকিরেরপুল, নয়াপল্টনসহ আশপাশের এলাকার পানিবদ্ধতা কমাতে পাইপ বসাতে হচ্ছে। অফিসিয়াল কিছু সমস্যার জন্য কার্যাদেশ পেতে দেরি হয়েছিল। যে জন্য কাজটি শুরু করতে একটু দেরি হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে বলে তিনি জানান। তবে কত দিনের মধ্যে খনন ও পাইপ বসানোর কাজ শেষ করা হবে, তা তিনি নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।
খোঁড়াখুঁড়ির ব্যপারে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নেই কোন তদারকি। ঠিকাদাররেরা যে যেমন খেয়ালখুশি মত কাজ করছে। একটু বৃষ্টিতেই কাদা-পানিতে একাকার হয়ে রাস্তায় চলাচলের উপায় থাকে না। রাস্তার মাঝখানে যখন তখন বিকল হয়ে যাচ্ছে গাড়ি। প্রতিনিয়তই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। অফিস আদালত ও কর্মমুখি মানুষ এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সকাল বেলায় ঘর থেকে বের হয়েই পড়ছে চরম ভোগান্তিতে। নগর জুড়ে অসহনীয় যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আবার কোথাও বা যানবাহনেরে সঙ্কটে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সামান্য বৃষ্টি হলে ইচ্ছা থাকলেও ময়লা, কাদা-পানি ও খানাখন্দে ভরা রাস্তায় পায়ে হাঁটা সম্ভব হয় না। আবার রোদ উঠলে বাতাসে ধুলা-বালি উড়ে চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিশ্বাসের সাথে ধুলা-বালি নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট ও এজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন