স্টাফ রিপোর্টার : আলোচিত হত্যাকা- চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর ঘাতক ও পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গভীর রাতে ঢাকার শ্বশুরালয় থেকে এসপি বাবুলকে গোয়েন্দাদের নিয়ে যাওয়া, অজ্ঞাত স্থানে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ, আবার তাকে ছেড়ে দেয়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে দীর্ঘসময় নিজেদের হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদে স্ত্রী হত্যার পরিকল্পনাকারী স্বামী বাবুল আক্তার নিজেই কিনা এ নিয়েও সর্বত্র সন্দেহের সৃষ্টি হয়। গতকাল দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাবুল আক্তার পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি সবাইকে চেনেন, জানেন। ‘যেসব অপরাধীকে আমরা শনাক্ত করেছি, ধরেছি এবং তাদের জবানবন্দি পেয়েছি, তাদের কনফার্ম করতেই বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে’ Ñস্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পর বিকেল ৪টায় বাসায় ফেরেন বাবুল আক্তার। এ সময় তিনি দাবি করেন, তাকে আটক করা হয়নি। মামলার তদন্তের বিষয়ে আলোচনা করতে তাকে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তবে দীর্ঘসময় তাকে কোথায় রাখা হয়েছিল সে ব্যাপারে তিনি মুখ খোলেননি।
গত ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় শিশুসন্তানের সামনেই দুর্বৃত্তরা গুলি ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে। এটি নিছক ছিনতাই কিংবা ব্যক্তি শত্রুতাজনিত ঘটনা নয় বলে দাবি করছিলেন বাবুল আক্তার। স্ত্রী খুনের ঘটনায় বাবুল আক্তার নিজেই বাদী হয়ে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত তিন ব্যক্তিকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পর পুলিশ দাবি করে, বাবুল আক্তারের জঙ্গিবিরোধী ভূমিকার কারণেই তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সারাদেশে শুরু হয় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পুলিশের বিশেষ অভিযান। দেশব্যাপী চলে ধড়পাকড়। পুলিশের গণগ্রেফতারের শিকার হন সাড়ে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। এদের মধ্যে জঙ্গি অভিযোগে পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ জন। বিশেষ এ অভিযান চলাকালে অভিযোগ ওঠে, পুলিশ যে কাউকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বাণিজ্য করেছে।
মিতুর খুনের দৃশ্য ধরা পড়ে ঘটনাস্থলের পাশের একটি ভবনের সিসি ক্যামেরায়। তাতে দেখা যায়, মোটরসাইকেল আরোহীরা মিতুকে খুন করেছে। ওই ঘটনার পর থেকে এক মোটরসাইকেলে ৩ জন আরোহণ না করতে পুলিশ নির্দেশনা দেয়। মিতু হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও উদ্ধার করে সেখানকার পুলিশ। চাঞ্চল্যকর ওই হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু পুলিশ মিতু হত্যার কারণ ও ঘাতকদের সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানাতে পারেনি।
স্ত্রী খুনের পর সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করেন এসপি বাবুল আক্তার। বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, শুক্রবার দিবাগত রাত ১টার দিকে তাদের বনশ্রীর বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে নিয়ে যায় খিলগাঁও থানার ওসি মঈনুল হোসেন ও মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার আনোয়ার হোসেন। আইজি সাহেব দেখা করতে বলেছেনÑএ কথা বলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আর যোগাযোগ হচ্ছে না। মোবাইল ফোনও রিসিভ করছেন না। বাবুল আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তার স্বজনদের মধ্যে তৈরি হয় সন্দেহ আর উদ্বেগ। তাকে নিয়ে সৃষ্টি হয় ধূ¤্রজাল। তাকে আটক করা হয়েছে কিনা এমন সন্দেহ করেন অনেকে। গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা ক্লাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বাবুল আক্তার পুলিশের কর্মকর্তা। তিনি সবাইকে চেনেন, জানেন। যেসব অপরাধীকে আমরা শনাক্ত করেছি, ধরেছি এবং তাদের জবানবন্দি পেয়েছি, তাদের কনফার্ম করতেই বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কয়েকজন আসামির সামনে মুখোমুখি করে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
তবে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বাবুল আক্তার মামলার বাদী। মামলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য পাওয়ার জন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডেকে নেওয়ার দীর্ঘসময় পর বাবুল আক্তার বাসায় ফেরেন গতকাল বিকেল ৪টার দিকে। এ সময় গণমাধ্যমকে তিনি জানান, মামলার তদন্তের বিষয়ে আলোচনা করতে তাকে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তবে ওই সময় বাবুল আক্তার কোথায় ছিলেন, সে তথ্য তিনি দেননি। স্ত্রী হত্যার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি নাÑএই প্রশ্নে বাবুল আক্তার পাল্টা প্রশ্ন করেন, এগুলো কে বলল? তিনি বলেন, আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। যারা তদন্ত করছেন, তারা বিভিন্ন বিষয়ে আমার সাথে আলোচনা করেছেন।
বাবুল আক্তারের বিষয়ে কিছুই জানে না সিএমপি!
এদিকে আমাদের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানান, স্ত্রী হত্যার ঘটনায় বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ বা অন্য কোনো কাজে ঢাকার ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তাদের অফিসিয়ালি জানানো হয়নি। মামলা তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে দাবি করে সিএমপির কর্মকর্তারা জানান, খুব শিগগির এ বিষয়ে মিডিয়াকে জানানো হবে।
এদিকে মিতু হত্যা নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলছে পুলিশ। ঘটনার পরপরই সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, বাবুল আক্তার জঙ্গি দমনে সক্রিয় ছিলেন। জঙ্গিরা প্রতিশোধ নিতেই এই খুনের ঘটনা ঘটাতে পারে। নিহতের বাসায় এসে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও জঙ্গিদের সন্দেহ করার কথা জানান। খুনের পর চারজনকে আটক করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরদিন ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ চার জনকে ধরে ফেলেছে। তবে রাতেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সিএমপির কমিশনার বলেন, তাদের কাছ থেকে কিছুই মিলেনি। ওই দিন প্রেসব্রিফিংয়ে পুলিশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে এবং রাতের মধ্যেই ভাল খবর দিতে পারবেন বলেও জানান পুলিশ কমিশনার। ১২ জুন চট্টগ্রাম সফরকালে আইজিপি একেএম শহীদুল হক স্বীকার করেন এই খুনের ঘটনায় জঙ্গিরা জড়িত থাকা বিষয় এখনও স্পষ্ট নয়।
হত্যাকা-ের একদিন পর খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটি চট্টগ্রাম নগরীর বাদুড়তলা এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ। তখন এই খুনের সাথে জামায়াত-শিবিরের জড়িত থাকার ‘সম্ভাবনার’ কথা বলেন পুলিশ কমিশনার। মিতু হত্যার পর প্রথমে পাঁচলাইশ থানার একজন এসআই বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরদিন সকালে ওই মামলার বাদি পরির্বতন করে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে বাদি দেখানো হয়।
৭ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে আবু নসুর গুন্নু (৪৬) নামের একজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায়, তিনি একজন সাবেক শিবির কর্মী। তবে হাটহাজারী মুসাবিয়া দরবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করা হয়, তিনি কখনো শিবির করেননি। মাজারের বিরোধের জেরে ত্রিশ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে তাকে এই মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষ।
মিতু খুনের পর ঘটনাস্থল অতিক্রম করা কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস ও তার চালককে একইদিনে আটক করার দাবি করে পুলিশ। পরে জানা যায়, সিসিটিভিতে ওই মাইক্রোবাসের ছবি দেখে পুলিশ সন্দেহ করেছে মর্মে মিডিয়ায় খবর আসলে চালক জানে আলম নিজেই মাইক্রোবাস নিয়ে পুলিশের কাছে হাজির হন। তিনি দাবি করেন, ঘটনার পর প্রতিদিনের মতো তিনি ওই এলাকা অতিক্রম করছিলেন মাত্র। এই খুনের সঙ্গে তার দূরতম সম্পর্কও নেই। এরপর তাকে দুই দিন আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১০ জুন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে এসপিপতœী খুনের ঘটনায় মানববন্ধন চলাকালে সন্দেহজনক ঘোরাফেরার অভিযোগে ইব্রাহিম (২৬) নামের রিকশাচালক এক যুবককে ছোরাসহ আটক করে পুলিশ। পরে জানা যায়, সে এই ঘটনায় জড়িত নয়।
১১ জুন নগরীর বায়েজিদ থানার শীতল ঝর্ণা এলাকা থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন (২৮) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যাকা-ের সময় রাস্তার পাশের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে মিতুকে যে যুবককে অনুসরণ করতে দেখা গিয়েছিল, ওই যুবকই রবিন বলে পুলিশের সন্দেহ। প্রকৃত ঘটনা হলো মদ্যপ অবস্থায় এক রিকশা চালককে মারধর করার সময় পুলিশ তাকে ধরে আনে। এরপর তাকে এই মামলায় আসামী হিসাবে চালান দেওয়া হয়। ১২ জুন গ্রেপ্তার নসর ও রবিনকে সাত দিনের রিমা-ে নেয়ার অনুমতি পায় পুলিশ। ওইদিন ঘটনা তদন্তে পাঁচটি পৃথক কমিটি গঠন করে পুলিশ। একই দিন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল করা হয়। নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিবির সিনিয়র সহকারি কমিশনার মো. কামরুজ্জামানকে। রবিনকে ৭ দিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। নসরকে এখনও জিজ্ঞাবাদের প্রয়োজনও মনে করেনি পুলিশ। একপর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ কমিশনার জানান, ওই দু’জনের কাছ থেকে কিছুই পাওয়া যায়নি। তারা এই ঘটনায় জড়িত নয়।
১৪ জুন জেএমবি সদস্য বুলবুল আহমেদ ওরফে ফুয়াদকে বাকলিয়া থানার একটি হত্যা মামলায় রিমা-ে নেয়ার আবেদন করে পুলিশ। ফুয়াদকে এসপি পতœী হত্যার বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান। এরপর থেকে পুলিশের অভিযান চলমান থাকলেও নতুন কাউকে গ্রেপ্তার বা অগ্রগতির বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে মুখ খুলছিলেন না। অবশ্য ‘কয়েকদিনের মধ্যে’ রহস্য উন্মোচিত হবে বলে তারা দাবি করেন। এই সময়ের মধ্যে পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা চার-পাঁচজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সাংবাদিকদের কাছে তাদের কারও পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তাদের আদালতেও হাজির করা হয়নি। এখনও সিএমপির কর্মকর্তারা দাবি করেন, তাদের হাতে খুনিচক্রের সব সদস্য আটক আছে। গত কয়েকদিনে তাদের মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকড়াও করা হয়। তবে প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। পুলিশ কর্মকর্তারা খুনিদের ধরে ফেলার বিষয়টি জোর দিয়ে বললেও কী কারণে মিতু খুন হয়েছে সে বিষয়ে মুখ খুলছে না। চট্টগ্রাম অঞ্চলে দীর্ঘসময় দায়িত্ব পালনকালে তিনি সততা, নিষ্ঠা পেশাদারিত্বের পরিচয় দেন। সম্প্রতি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে বদলি হন।
**************
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন