রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

উলামাদের দৃষ্টিতে জামাতে নামায পড়ার হুকুম

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

ইসলাম ধর্ম সর্বময় শুধু ইবাদত করার কথা বলে না। দ্বীনি এবং পার্থিব, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিষয়সমূহের সুন্দর ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার প্রতিও দৃষ্টি রাখে। আর একটি সুন্দর সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে পাঁচটি জিনিসের ওপর ভিত্তি করে। ১. পরকালের প্রতি বিশ্বাস, ২. দুর্বলদের প্রতি দয়া, ৩. কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ৪. উদারতা ৫. উপরস্থ কেন্দ্রের সাথে ভাল সম্পর্ক। এর সবটিই নামাযের মধ্যে পাওয়া যায়। অর্থাৎ পুরো জামাতটিই যেন একটি আদর্শ সমাজের চিত্র। মসজিদ হচ্ছে কেন্দ্র, ইমাম হচ্ছে সভাপতি, মুয়াজ্জিন সাধারণ সম্পাদক। বাকী মুসল্লিগণ সদস্য। এটি এমন একটি সুন্দর ব্যবস্থা যে, তার নজীর পৃথিবীর কোথাও নেই। এজন্য তার সভাপতি বা ইমামের জন্য শর্তও খুব বেশি। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর যোগ্যতায় তাকে সবার সেরা হতে হবে। বুদ্ধিমত্তা এবং দ্বীনদারীতেও অনন্য হতে হবে। চারিত্রিক মাধুর্য থাকতে হবে। যদি রাষ্ট্রে ইসলামী হুকুমত থাকে, তবে ইমাম হওয়ার সবচেয়ে অধিকারী ব্যক্তি হল, রাষ্ট্রের বাদশা বা গভর্নর। জামাত সহকারে নামায পড়ার উপকারিতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সমাজের সবাই যেহেতু তাদের কেন্দ্র মসজিদে সমবেত হয় এবং সভাপতি (ইমাম) সেক্রেটারী (মুয়াজ্জিন) থেকে শুরু করে সব সদস্য সেখানে উপস্থিত থাকে। তাই কারো কোন সমস্যা হলে সেখানে উপস্থাপন করে তার একটা সুন্দর সমাধান পাওয়া যায়। এখানে সম্ভব না হলে জুমার দিন জামে মসজিদে যখন জুমার জন্য শহরের সবাই সমবেত হবে, বিভিন্ন মহল্লার সভাপতি-মেম্বারেরা উপস্থিত হবেন, তখন সবাই মিলে সমাধানের ব্যবস্থা তো অবশ্যই গ্রহণ করবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, ইসলামের অন্যান্য সুন্দর বৈশিষ্ট্যগুলো যেভাবে আমরা ধ্বংস করে দিচ্ছি, এই বিষয়টিকেও আমরা গলাটিপে হত্যা করছি। আল্লাহর কসম, যদি আজ সমাজে এ-ধরণের ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে আমাদের অনেক ইমাম পাঁচ পয়সার বেতনভোগী কর্মচারী হতোনা! গ্রাম থেকে ভিক্ষুকের মত রুটি ভিক্ষা করতে হত না। কাপড়-চোপড়ের অবস্থা, কী আর বলব! অনেক জীর্র্ণশীর্ণ! ধর্মীয় সভাপতির পজিশন যদি এই হয়, সামাজিক ব্যবস্থাপনা সুন্দর হওয়ার আশা করাটাই তো বোকামী ছাড়া কিছু নয়। একজন সভাপতি বা প্রধানের গুণাবলী কি এটা হতে পারে? আপনার বিবেক কী বলে? এভাবে কি সমাজ টিকে থাকতে পারে?

ভাবুন! ইসলাম কী চায়, আর আপনাদের গতিপথ কোন দিকে? ইমামতির সেই গুরু দায়িত্ব যা স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঞ্জাম দিয়েছেন, আবু বকর, উমরও দিয়েছেন, সেটার প্রতি আপনি কতটা সম্মান প্রদর্শন করতে পারলেন। একটু ভাবুন!!
জামাতের শরয়ী রহস্য: যে শহর বা গ্রামে ৩ জন ব্যক্তি থাকে, আর তারা যদি জামাত সহকারে নামায আদায় না করে, তখন অবশ্যই শয়তান কাউকে না কাউকে পাকড়াও করে পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যাবে। এজন্য জামাতের সহিত নামায পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দল থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া ছাগলের ওপর বাঘ আক্রমণ করবে, এটাই স্বাভাবিক।
১. ইমাম আহমদ রহ. এর মতে জামাত সহকারে নামায আদায় করা ফরযে আইন। ২. ইমাম শাফেয়ী রহ. এর মতে ফরযে কেফায়াহ। ৩. হানাফী মাযহাব মতে সুন্নাতে মুয়ক্কাদাহ তথা অনেকটা ওয়াজিবের কাছাকাছি। ৪. অনেকের মতে জামাত ওয়াজিব। ৫. তবে সবার মতামত অনুযায়ী নিচের বিষয়সমূহের কারণে অপারগতা প্রকাশ পেলে জামাতে শরীক না হলেও গুনাহগার হবে না। বিষয়সমূহ নিম্নরূপ- ১. অসুস্থতা, ২. হাত-পা কেটে যাওয়া, ৩. অন্ধ হওয়া, ৪. প্যারালাইজড হওয়া, ৫. মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা, ৬. অধিক বৃষ্টি, ৭. রাস্তা কর্দমাক্ত হওয়া, ৮. অতিমাত্রায় শীত পড়া, ৯. ভয়ানক অন্ধকার হওয়া, ১০. সম্পদ ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকা, ১১. মানহানীর আশঙ্কা, ১২. প্রাণনাশের ভয়, ১৩. অতি বাথরুম আসা ইত্যাদি। বিস্তারিত জানতে হলে উলামায়ে কেরামের নিকট যাওয়া জরুরী।
জামাতবদ্ধ হয়ে নামায পড়ার সওয়াব: জামাত সহকারে নামায পড়া একাকী নামায পড়ার চেয়ে ২৭ গুণ বেশি উত্তম। অর্থাৎ একাকী নামায পড়লে যদি দশ নামাযের সওয়াব হয়, সেখানে জামাত সহকারে পড়লে ২৭০ নামাযের সওয়াব পাবে। (বুখারী, মুসলিম)
হযরত উবাই ইবনে কাব রা. বলেন, একদিন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ফজরের নামায আদায় করলাম। নামাযের পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, অমুখ এসেছে? সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, আসেনি। তিনি আবার বললেন, অমুখ এসেছে? সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, আসেনি। তখন তিনি বললেন, এশা এবং ফজরের নামায মুনাফিকদের জন্য খুবই ভারী। যদি তোমরা এই দুই নামাযের সওয়াবের পরিমাণ জানতে, হামাগুড়ি দিয়ে হলেও মসজিদে চলে আসতে। (আবু দাউদ,নাসায়ী)
হযরত উমর রা. এর খিলাফতকালে একদিন তিনি সুলায়মান বিন হাছমা রা. কে ফজরের নামাযে দেখেননি। নামায থেকে ফারেগ হয়ে সেদিন তিনি বাজারে গেলেন। বাজার এবং মসজিদের মাঝামাঝি স্থানে সুলায়মান রা.-এর বাড়ি ছিল। ঘটনাক্রমে সুলায়মান রা. এর মাতা হযরত শেফা রা. এর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়ে গেল। তিনি বললেন, কী ব্যাপার, আজ আপনার ছেলেকে মসজিদে দেখলাম না যে! তিনি উত্তর দিলেন, আমীরুল মুমিনিন! সুলায়মান সারা রাত নফল নামায পড়েছে, কিন্তু ফজরের সময় ক্লান্ত হয়ে সে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিল। হযরত উমর রা. বললেন, যদি রাতে নামায পড়ার দরুন ফজরের জামাতে শরীক হতে না পারে, তাহলে রাতে ঘুমিয়ে ফজরের জামাতে শরীক হওয়াটাই ভাল। যে সমস্ত মানুষ খুব দীনদারী দেখিয়ে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে সারা রাত কাটিয়ে দেয়, আর ফজরের জামাতে শরীক হয় না, তাদের উচিৎ হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসটি নিয়ে ভাবা এবং কাজের পরিশুদ্ধি ঘটানো।
জামাত ছাড়া একাকী নামায পড়ার শাস্তি: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঐ সত্ত¡ার শপথ, যার কুদরতী হস্তে আমার প্রাণবন্দী। আমার ইচ্ছে হয়, কাউকে যেন জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের নির্দেশ দিই, তারপর নামাযের সময় হলে একজনকে লোকদের কাছে নামায পড়ানোর জন্য পাঠাই। এবার আমি সেখানে গিয়ে দেখি, জামাতে কে কে উপস্থিত হয় নি। যারা উপস্থিত হয় নি ইচ্ছে হয় তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিই, যাতে তারাও পুড়ে মরে যায়। কিন্তু ঘর-বাড়িতে থাকা শিশু ও বয়স্কদের জন্যে আমার মায়া হয়। আল্লাহর কসম! জামাতে যারা আসে না, তারা যদি জানতে পারে যে, মসজিদে গেলে অনেক গোশতের টুকরা পাবে বা দুইটি ভাল মুক্তার দানা পাবে তখন তারা এশার নামাযেও অবশ্যই উপস্থিত হবে। অর্থাৎ দুনিয়া অর্জন করার জন্য অবশ্যই চলে আসবে। কিন্তু পরকালের সওয়াব এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার ব্যাপারে কোন আগ্রহই তাদের নেই। (বুখারী, মুসলিম)
মসজিদে জামাতসহকারে নামায পড়ার সওয়াব: ১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি অজু করে ঘর থেকে মসজিদে জামাতের উদ্দেশ্যে নামায পড়ার জন্যে বের হয়, সে ঐ ব্যক্তির পরিমাণ সওয়াব পায়, যে ইহরাম বেঁধে হজ্ব করে। আর যে ব্যক্তি শুধু চাশতের (সূর্য একটু প্রখর হওয়ার পর বিশেষ নফল নামায) নামাযের উদ্দেশ্যে বের হয়, সে ওমরা পালনকারী ব্যক্তির ন্যায় সওয়াব অর্জন করে। আর যে ব্যক্তি একটি নামায আদায় করার পর দ্বিতীয় নামায আদায় করে এবং দুই নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে কোন অহেতুক কথাবার্তা না বলে, তার আমল জান্নাতের উচ্চস্তরে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ সে আল্লাহর কাছে নেককার বান্দা হিসেবে গণ্য হয়। (মুসনদে আহমদ)
২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিন প্রকার মানুষের সব ধরনের দায়িত্ব আল্লাহ নিজের হাতে নিয়ে নেন।
(ক) ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। তার মৃত্যুর পর জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত বা তাকে সওয়াব এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ অর্জন করে ফিরে আসা পর্যন্ত সব যিম্মাদারী আল্লাহর হাতে। (খ) ঐ ব্যক্তি যে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে, তার যিম্মাদারী আল্লাহর হাতে। তার কোন কাজ ব্যর্থ হবে না। (গ) ঐ ব্যক্তি যে সালাম দিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করে, তার যিম্মাদারীও আল্লাহ নিজের হাতে নিয়ে নেন। তাকে এবং তার পুরো পরিবারকে বরকত আর ধন-সম্পদ দিয়ে পূর্ণ করে দেন। (আবু দাউদ শরীফ)
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন তোমরা কোন ব্যক্তিকে মসজিদে আসা-যাওয়া করতে দেখবে তখন তার ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান কর। অর্থাৎ যে ব্যক্তি মসজিদে নামায পড়ে, ইবাদত করে, সেখানে বসে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয় বা শিক্ষা নেয়, মসজিদ পরিষ্কার করে, মেরামত করে- তোমরা এমন ব্যক্তির ব্যাপারে সাক্ষ্য দাও যে, সে ঈমানদার। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
৪. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঐ সকল লোকদেরকে কেয়ামতের দিনের পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ দাও, যারা রাতের অন্ধকারে মসজিদে আসে। অর্থাৎ যারা অন্ধকার উপেক্ষা করে মসজিদে আসে, তারা কেয়ামতের অন্ধকার দিনে পূর্ণ আলো পাবে। (আবু দাউদ, তিরমিযী)
৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের আযান শুনল, কিন্তু (যৌক্তিক) কোন কারণ ছাড়া মসজিদে আসেনি, সে যতই নামায পড়–ক না কেন কবুল হবে না। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, যৌক্তিক কারণ বলতে কী? তিনি বললেন, ভয় বা অসুস্থতা।
৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসূলের যুগে প্রকাশ্য মুনাফিকরাই শুধু জামাত ত্যাগ করত। গোপন মুনাফিকরা পর্যন্ত জামাতে শরীক হত। অনেক সাহাবা তো জামাতের ব্যাপারে এত আগ্রহী ছিলেন যে অসুস্থতার সময়েও জামাত ছাড়তেন না। একাকী চলার শক্তি হারিয়ে ফেললে অন্য দুই জন ব্যক্তির সহযোগিতা নিয়ে জামাতে শরীক হতেন। (মুসলিম শরীফ)
৭. যে মুসলমান হয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে চায়, তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সহিত আদায় করতে হবে। জামাত সহকারে নামায পড়া হিদায়াতের রাস্তায় চলার মাঝে অন্তর্ভূক্ত। আর সুন্নাত ও নফল নামায ঘরে পড়া উত্তম, ফরয নামায মসজিতে পড়া উত্তম। ইহা নবীর সুন্নাত পদ্ধতি। আর যে ব্যক্তি পাক-পবিত্র হয়ে মসজিদে এসে জামাতের সাথে নামায আদায় করে, তার প্রত্যেক কদমের পরিবর্তে একটি করে সওয়াব হয়, একটি করে গুনাহ মাফ হয়, একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে জামাত ত্যাগ করে, হাদিস শরীফে তাকে মুনাফিক বলা হয়েছে। আল্লহ তায়ালা সকলকে শরিয়তের আলোকে নামায পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন