বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা নিয়ে দুই মন্ত্রীর ক্ষোভ

| প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

দেশের সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত বৃহস্পতিবার ‘মহাসড়কের লাইফটাইম: চ্যালেঞ্জ ও করণীয় শীর্ষক এক সেমিনারে তাঁরা সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি সড়কের স্থায়িত্ব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের অদূরদর্শীতা, ঠিকাদারদের দুর্নীতি এবং বিভিন্ন দেশের সড়কের মানের উদাহরণসহ করণীয় সম্পর্কে তথ্যবহুল মতামত তুলে ধরেন। এই দুই মন্ত্রী ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করলেও সড়ক সম্পর্কে তারা যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী বক্তব্য ও মূল্যায়ণ করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। অর্থমন্ত্রী যেভাবে সড়কের ধরণ, এতে চলাচলের উপযোগিতা এবং নির্মাণের গুণগত মান সম্পর্কে বলেছেন, তা এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের চেয়েও অসাধারণ এবং প্রজ্ঞাদীপ্ত। অন্যদিকে নসরুল হামিদ সড়কের দুরবস্থা প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সড়কের বেহাল দশা ও নকশার ভুল অত্যন্ত দূরদর্শী ও স্মার্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, প্রকল্পের দায়িত্বে যিনি থাকেন তিনি কিছুই দেখেন না। নকশাও দেখেন না। তিনি সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে ফিটনেসবিহীন বলে আখ্যায়িত করেন। সড়ক সংশ্লিষ্টরা সেমিনারে দেশের মহাসড়কের আয়ুষ্কালের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেশের মাটি, পানি, গাছ, দোকান, নদী ও ট্রাক ওভারলোডিংকে দায়ী করেন। এ সময় তারা সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে পৃথক তহবিলের দাবী ও সড়ক সংস্কারে বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বলেন। তারা সড়কের বেহাল দশা নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তাদের বক্তব্য শুনে অর্থমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে সড়কের বেহাল দশার বর্ণনা দিয়ে প্রকল্প বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেন। সেমিনারে সড়ক সংশ্লিষ্টরা সড়ক টেকসই না হওয়া নিয়ে যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন তার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক। এদেশে নদী থাকবে, বৃষ্টিপাত হবে এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের অনেক দেশেই তা আছে। তারা তাদের এসব বিষয় বিবেচনা করেই সড়ক নির্মাণ করেন। তিনি অটোমেটিক টোল সিস্টেম চালুর পরামর্শ দিয়ে প্রতিটি গাড়ির জন্য প্রি-পেইড মিটার চালুর কথা বলেন। এতে সড়কের নির্দিষ্ট সীমা পার হলে স্বংক্রিয়ভাবে সড়ক ব্যবহারের টোল আদায় হয়ে যাবে। টোল প্লাজায় কোনো যানজট থাকবে না। 

দেশের সড়ক নির্মাণ, সংস্কার ও ব্যবস্থাপনায় যত অর্থ ব্যয় হয়, অন্য কোনো খাতে এত বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয় না। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ যেমন এ খাতে দেয়া হয়, তেমনি দুর্নীতিও সবচেয়ে বেশি হয়। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও এ খাতে আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও ঠিকাদারদের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অনিয়মকে বরাবরই দায়ী করে আসছেন। এসবের সত্যতাও দৃশ্যমান। নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, ভুল নকশা, সড়ক ব্যবস্থাপনার ত্রæটির কারণে একটি নতুন সড়ক নির্মাণের শুরু থেকে কিংবা কিছুদিন না যেতেই তা বেহাল হয়ে পড়ছে। সড়ক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর জন্য বৃষ্টি, পানি, গাড়ির ওভারলোডসহ অন্যান্য কারণের কথা উল্লেখ করলেও এসব যে অজুহাত, তা অর্থমন্ত্রী এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। মূল কথা হচ্ছে, যেসব সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে সেগুলো কোনোভাবেই মানসম্পন্নভাবে করা হচ্ছে না। সাধারণত একটি সড়কের লাইফ টাইম বা স্থায়িত্ব ৫০ বছর ধরা হয়। নির্মাণের প্রথম ১০ বছর কোনো ধরনের সংস্কার করা লাগে না। পরের ১০ বছর ৫ শতাংশ এগ্রি গ্যাস মিশিয়ে সংস্কার করলে আরও ১০ বছর টেকসই হয়। এভাবে প্রতি ১০ বছর পরপর এগ্রি গ্যাস মিশিয়ে সংস্কার করলে ৫০ বছর পর্যন্ত সড়ক টিকে থাকে। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয় না। এর কারণ অজানা নয়। সড়ক সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের অদক্ষতা, বেপরোয়া লুটপাট ও দুর্নীতির জন্যই এমনটি করা হয়। সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারকে এ শ্রেণী তাদের স্থায়ী ব্যবসায় পরিণত করেছে। সড়ক যদি উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় নির্মাণ বা সংস্কার করা হয়, তাহলে তাদের দুর্নীতি করার কোনো ধরনের সুযোগই থাকে না। অথচ টেকসই সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী বারবার বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিট ব্যবহারের তাকিদ দিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় সড়ক নির্মিত হলে এর স্থায়িত্ব নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অবলীলায় টিকে থাকত। কিছুদিন না যেতেই সংস্কারের প্রয়োজন পড়ত না এবং অর্থেরও অপচয় হতো না। দেখা যাচ্ছে, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর তাকিদ সংশ্লিষ্টরা প্রতিপালন করছে না। ফলে বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও সড়ক-মহাসড়ক বেহাল অবস্থায়ই রয়ে যাচ্ছে। যেসব ঠিকাদারের সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়, তাদের অনেকের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই এবং বারবার তাদেরই সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের দায়িত্ব দেয়া হয়। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ইংল্যান্ডের একটি নামকরা কোম্পানি নিয়ে এসেছিলাম, তাদের কাজ করতে দেয়া হয়নি। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সড়ক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই চায় না দেশে স্থায়ী ও টেকসই সড়ক নির্মাণ হোক। এ পরিস্থিতি যুগের পর যুগ ধরেই চলছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্তে¡ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একটি শ্রেণী তাতে বাধা হয়ে রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা নিয়ে সরকারের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষেরই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
সড়ক-মহাসড়ককে উন্নত, টেকসই ও মসৃণ করার জন্য এ খাতের দুর্নীতি ও অদক্ষতা দূর করার বিকল্প নেই। এ খাতের প্রকল্প গুলোর দায়িত্বে যারা রয়েছে তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের কোনো ধরনের অজুহাতই বরদাশত করা যাবে না। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সড়ক নির্মাণ ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত করতে হবে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের মতো দেশে পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুযায়ী সড়ক নির্মাণ করা হয়। আমাদের দেশেও আবহাওয়া অনুযায়ী সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করতে হবে। সড়ক-মহাসড়ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে যানবাহনে প্রি-পেইড মিটার বা ইলেকট্রনিক পেমেন্ট সিস্টেম (ইপিএস) চালু করতে হবে। এতে যেমন কেউ অপ্রয়োজনীয়ভাবে গাড়ি নিয়ে যখন-তখন বের হবে না, তেমনি সড়কের ওপর থেকেও চাপ কমবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করা হোক না কেন, তা নির্মাণে যেসব প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকে তাদেরকে সড়কের স্থায়িত্বের গ্যারান্টি দিতে হবে। গ্যারান্টি দেয়া সময়ের মধ্যে সড়কের ক্ষতি হলে তা তাদের খরচেই সংস্কার করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:১১ পিএম says : 0
Roads, bridges are the nerve and vain of a country just like a human body-- without nerve and vain human being cannot survive so without road, bridge a country cannot survive. This report exposed that government don't have any authority over these criminals those who are involves to built road and bridge
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন