নাগরিকত্ব সংশোধন বিল (বর্তমানে আইন)কে নিয়ে অনেক প্রতিবাদ হচ্ছে এবং আরো হবে। এই আইনটি সংবিধানের হৃদয়ে আঘাত করেছে। সব মিলিয়ে ভারতকে অন্যরকম একটি রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা রয়েছে এর মধ্যে। এ জন্যই বিভিন্ন গোষ্ঠীর এত সংখ্যক মানুষ এর বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠ জোরালো করেছে।
প্রতিবাদী এসব কণ্ঠের মধ্যে রয়েছেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। জনস্বার্থের বিষয়গুলো নিয়ে সমন্বিত প্রতিবাদের সঙ্গে এ সম্প্রদায়টির সাধারণতো কোন পরিচিতি নেই। বিলটি যখন পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা হচ্ছিল তখন এর প্রতিবাদে একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন হাজার হাজার ফ্যাকাল্টি সদস্য, ডক্টরাল শিক্ষার্থী। তারা শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করছেন।
তাদের পিটিশনে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ভারতের ধারণা এবং আমাদের সংবিধানে যেমনটি বলা হয়েছে, তা হলো, এ দেশটির সব ধর্মের মানুষের প্রতি সমান আচরণ দেখাবে। কিন্তু প্রস্তাবিত বিলে নাগরিকত্ব নির্ধারণে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। যা এই ইতিহাসের সঙ্গে ব্যবধান রচনা করে। আর তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে বেমানান। আমাদের আশঙ্কা যে, বিশেষ করে, দেশে যে বহুত্ববাদী ধারণা প্রচলিত আছে নাগরিকত্ব নির্ধারণে শুধু মুসলিমদের বাইরে রাখায় তাতে বিরাট টান পড়বে।’ বিজ্ঞানীরা ‘অবিলম্বে এই বিলটি প্রত্যাহার করে নেয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বৈষম্যহীনভাবে শরণার্থী এবং সংখ্যালঘুদের বিষয়টি বিবেচনার কথা বলেছেন।
এই পিটিশনে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন রয়েল সোসাইটির (বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত বিজ্ঞান বিষয়ক পরিষদ, এতে বেশ কিছু সদস্য ভারতীয়) বেশ কিছু ফেলো, আমাদের বিশ্বমানের হাতেগোনা কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা এবং ভারতের সব ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউটস অব টেকনোলজির পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা।
এই লেখক একজন ইতিহাসববিদ হওয়া সত্তে¡ও লেখাটি একটি বিজ্ঞানী পরিবারের পক্ষে। আমার নিজস্ব গবেষণা ক্যারিয়ারে, ভারতীয় বিজ্ঞানের সবচেয়ে চমৎকার মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ৩৫ বছরেরও বেশি সময় আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে, আমি বলতে পারি, এমন বিবৃতি অপ্রত্যাশিত। এ জন্য যে, এই বিবৃতি জেএনইউ ঝোলাওয়ালা বা মানবাধিকারকর্মী বা বাম ধারার আর্টিস্টদের নয়, যারা নিয়মিত প্রচারণার আয়োজন ও তাতে অংশগ্রহণকারীদের স্বাক্ষর পেতে ব্যর্থ হন না। খুব প্রয়োজনের সময়ে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি আইনের প্রতিবাদে একত্রিত হয়েছেন এতসব বিজ্ঞানী, সম্মানীত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, মেধাবী, উদীয়মান।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, স্বাক্ষরকারীরা সমর্থন পেয়েছেন এমন একজনের কাছ থেকে, যিনি যৌক্তিকভাবে বর্তমানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত জীবিত সবচেয়ে ব্যতিক্রমী বিজ্ঞানী, নোবেল পুরস্কারবজয়ী ভেঙ্কটরমন (ভেঙ্কি) রামাকৃষ্ণণের পক্ষ থেকে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, বিজ্ঞানের যেমন তেমনি সমাজের জন্যও ধর্মভিত্তিক বৈষম্য খারাপ। এমন একটি পরিবেশ যেখানে কুসংস্কার, বৈষম্যহীনতার মধ্য দিয়ে স্বীকৃত প্রতিটি মেধাবীকে গ্রহণ করা হয়, এমন একটি বিজ্ঞান সবচেয়ে ভাল কাজ করে। এমন একটি পরিবেশ চান শিক্ষাবিদরা, যেখানে সবাই তাদের অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, প্রফেসর রামাকৃষ্ণণ নিয়মিত দেশে আসছেন, যে দেশে তিনি জন্মেছিলেন এবং বড় হয়েছেন (এবং যেখানে তিনি তার প্রথম ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। পড়াশোনা করেছিলেন এমএস ইউনিভার্সিটি অব বরোদা’তে)। প্রতি বছর তিনি ভারতে আসেন এবং দেশজুড়ে বক্তব্য দেন। বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগ দেন। সব বয়সী এবং সব ব্যাকগ্রাউন্ডের ভারতীয়ের সাথে কথা বলেন। এটা তার প্রাথমিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে, যেটা তিনি বলেন যে, ভারতের তরুণরা হলেন অত্যন্ত উদ্যমী, কিছু করতে গিয়ে তারা কঠিন পরিস্থিতিতে কর্মঠ। আমরা চাই না দেশের ভিতর বিভক্তি সৃষ্টি করে তাদেরকে হতাশ করা হোক।
অনন্য অন্য বিজ্ঞানীদের মতো ভেঙ্কি রামাকৃষ্ণণ নিজের গবেষণার দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। সহসা তিনি পাবলিক বিতর্কে যোগ দেন না। কিন্তু তিনি যেহেতু এ ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছেন, তাই বলেছেন, ‘আমি বিদেশে অবস্থান করলেও ভারতকে চরমভাবে ভালবাসি। তাই আমি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভারত দুর্দান্ত সহনশীলতার আদর্শ বহন করে বলে আমি সব সময় ভারতের কথা চিন্তা করি এবং প্রত্যাশা করি ভারত সফল হোক। তিনি আরো যোগ করেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলছি ২০ কোটি মানুষকে, দেখুন আপনার ধর্ম অন্য সবার সমান মর্যাদার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। এটা দেশের জন্য অত্যন্ত বিভাজন সৃষ্টিকারী বার্তা’।
আমাদের এইচআরডি মন্ত্রী (এবং আমাদের এসঅ্যান্ড টি মন্ত্রীও) জনগণের প্লাটফরমে যখন মিথ্যা কথা উচ্চারণ করছেন তখন এরই মধ্যে ভারতে কর্মরত শীর্ষ বিজ্ঞানীরা হতাশ। গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন তারা। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন তাদের আতঙ্ককে আরো নিশ্চিত করবে যে, স্বাধীন, অরিজিনাল বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরিবেশ আরো সঙ্কুচিত হবে।
ভারতে রয়েছে সবচেয়ে সেরা বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হলো যুক্তরাষ্ট্র। এই অভিধা একসময় বহন করতো জার্মানি। দ্য টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভেঙ্কি রামাকৃষ্ণণ বলেছিলেন, ‘যেসব দেশের বিজ্ঞানভিত্তিক আদর্শ রয়েছে তারা ধ্বংস করে দিয়েছে তাদের বিজ্ঞানকে। হিটলারের কাছ থেকে বিজ্ঞানকে পুনরুদ্ধারে জার্মানির সময় লেগেছিল ৫০ বছর।’ তিনি বলতে পারতেন, জার্মানির পরাজয়ে, অর্জন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হিটলারের নীতির কারণে জার্মানির বিখ্যাত সব বিজ্ঞানী অভিবাসী হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞান বিকশিত হতে একটি দেশে অবশ্যই শক্তিশালী অর্থনীতি থাকতে হয়। বিজ্ঞানে রাষ্ট্রের সমর্থন থাকতেই হয়। রাজনৈতিক পরিবেশ অবশ্যই গণতন্ত্রকে অনুমোদন করতে হয় এবং সেখানে থাকতে হয় বহুত্ববাদ। যুক্তরাষ্ট্রে এই তিনটি জিনিস পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। এর প্রতিটিকে লালন করতে সংগ্রাম করছে ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের নীতির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। মোদি সরকার গভীরভাবে বুদ্বিজীবী বিরোধী। এখন নাগরিকত্ব সংশোধন আইন পাস করার মাধ্যমে গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদও হুমকিতে পড়েছে। এ জন্যই সম্মিলিত প্রতিবাদে অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ নিয়েছেন ভারতের এসব বিজ্ঞানী।
১৯৭০ এর দশকে চীনের বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক অগ্রগামী ছিল ভারতের বিজ্ঞান। এখন ভারত অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এর কারণ, চীনা অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দ্রæততর এবং সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সক্রিয়ভাবে অনুমোদন দিয়েছে রাষ্ট্র হিসেবে চীন। চীনে যারা বিজ্ঞান পরিচালনা করেন তারা বিশ্বাস করেন না যে, প্রাচীন চীনা চিন্তাভাবনার কাছ থেকে তাদের ক্লু নেয়া উচিত। চীনের শি জিনপিং কখনোই অযোগ্য ব্যক্তিদের তার শিক্ষামন্ত্রীদের নিয়োগের কথা বিবেচনা করবেন না, যে কাজটি করেন মোদি। এ কারণে মোদি ও ভারতীয় জনতার পার্টির মতো না হয়ে শি জিনপিং এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বুঝতে পারে যে, একুশ শতাব্দীতে দেশের অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগত মান ও স্বায়ত্তশাসনের ওপর।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য কর্তৃত্বপরায়ণতা খারাপ। কিন্তু গোঁড়ামি আরো খারাপ। ভারতের বিজ্ঞান কখনোই তার ভবিষ্যতের ওপর নির্ভর করে না, কখনোই অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে না, যতদিন আমাদেরকে ওইসব রাজনীতিক শাসন করবেন যারা বিশ্বাস করেন হিন্দুরাই সব আবিষ্কার করেছেন এবং হিন্দুরা মুসলিমদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ততদিন তারা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন না।
১৯৫০ এর দশক এবং ১৯৬০ এর দশকে বিদেশে প্রশিক্ষণ নেয়া ভারতীয় বহু বিজ্ঞানী দেশে ফিরে এসে দেশেই কাজ করেছেন। তারা এমন আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যা মুক্ত ও স্বাধীন ভারত গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। সঙ্গে তাদেরকে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে। এমনটা করেছেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। তারা গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও উদার বিজ্ঞানের প্রতি ছিলেন প্রতিশ্রæতিবদ্ধ।
পরের বছরগুলোতেও বেশ কিছু বিজ্ঞানী বিদেশে গিয়েছেন শিক্ষা নিতে এবং তারা ভারতে ফিরেছেন। যদিও পশ্চিমা দেশগুলোতে জীবনের বিপুল আকর্ষণ ছিল, তা সত্তে¡ও ভারতে এখন চমৎকার কিছু বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে অরিজিনাল গবেষণা অনুমোদন দেয়া হয়। আমার সমসাময়িক অনেকে আইভি লিগ ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করেছেন। তারা সহজেই আইভি লিগ ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করতে পারতেন। তবে তারা ফিরে এসেছেন। কিন্তু তাদের ছাত্রছাত্রীরা কি ফিরেছেন?
ভারতীয় তরুণ বিজ্ঞানীরা আজ দেখতে পান কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা, এমনকি তাদের প্রধানমন্ত্রীও এমন দাবি করেন যে, প্রাচীনকালে হিন্দুরা জানতেন কিভাবে টেস্টটিউবে সন্তান জন্ম দিতে হয়, তারা জানতেন উড়োজাহাজের ডিজাইন এবং তার উড়ান। তারা আরো দেখতে পান যে, বৈজ্ঞানিক কমিটির বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে অশ্রদ্ধা দেখাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। তারা দেখছে আমাদের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভাইস চ্যান্সেলর এবং পরিচালক নিয়োগে খোঁজা হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অনুগতদের। তারা দেখতে পান যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ভাংচুর করে পুলিশ। এটা এমন একটি দৃশ্যপট যা বৃটিশরাজের সময়েও কখনো ঘটেনি। তাই এমন অবস্থার মধ্যে এসব বিজ্ঞানীর সামনে যদি বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য অধিক উপযোগিতা আসে তাহলে কে ভারতে থাকাকে বেছে নেবেন?
নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (এবং হিন্দুত্ববাদী কর্তৃত্বপরায়ণতা) একটি পরিণতি হতে পারে, মস্তিষ্কের ধ্বংস ত্বরান্বিত হবে। কম থেকে কম ভারতীয় বিজ্ঞানী যারা বিদেশে শিক্ষিত হবেন তাদের খুব কম সংখ্যকই ভারতে ফিরতে চাইবেন সাম্প্রদায়িক কুসংস্কারের মধ্যে। ভারতের পরাজয়ে অর্জন করবে যুক্তরাষ্ট্র। স্বল্প (ও মধ্য) মেয়াদী ভারতীয় বিজ্ঞানের বিকাশ ¤øান হয়ে আসবে। তা সত্তে¡ও, কৃতজ্ঞ থাকতে হবে যে, আমাদের এত সংখ্যক বিজ্ঞানী এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, যে আইন প্রকাশ্যেই বৈষম্যমুলক। যে সরকার দেশের ভবিষ্যতের পরোয়া করে তার উচিত ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মনের শ্রেষ্ঠ কথাগুলো শোনা। মোদি সরকার তা করবে না। কারণ তারা সংকীর্ণমনা এবং গোঁড়া। ইতিহাসই বিজ্ঞানীদের বিচার করবে। ভারতে তাদের কথা বলা দরকার ছিল এবং তারা তা করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন