বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পরিকল্পনা মাফিক কৃষিপণ্যের উৎপাদন আবশ্যক

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

দেশের বেশিরভাগ বিষয়ের তথ্য ভুল। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরও কথায় সত্যতার অভাব রয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ফলে নানা সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। যেমন: সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রায়ই বলেন, ‘দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে। কিছু চাল রফতানি হচ্ছে।’ কিন্তু বাস্তবতা কী? এ দেশে খাদ্য বলতে অতীতে প্রধানতঃ ভাতকেই বুঝাতো। পরবর্তীতে ভাতের স্থানে দখল নিয়েছে আটা। দেশে বর্তমানে অন্ততঃ এক বেলা রুটি খায় এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এছাড়া, বিভিন্ন নাস্তাও মূলত আটারই তৈরি। শস্য দানার মধ্যে চাল ও গম মিলেই এখন খাদ্য। এবার দেখা যাক দেশে এদের উৎপাদনের অবস্থা কী? গত ১ ডিসেম্বর বিআইডিএস’র সম্মেলনে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম বলেন, ‘পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে বছরে চালের উৎপাদন ৩.৬০ কোটি টন। আর মাথাপিছু চাল খাওয়ার পরিমাণ যোগ করলে বছরে ৩ কোটি টনের বেশি চালের চাহিদা থাকার কথা নয়। এই হিসাব আমলে নিলে দেশে ৬০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে কয়েক বছর পরপর ১০-২০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়।’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চাল আমদানির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। খাদ্যের দ্বিতীয় পণ্য গমের চিত্র কী? দেশে গম উৎপাদন হয় চাহিদার এক তৃতীয়াংশেরও কম। বাকী আমদানি করতে হয়। এ ব্যাপারে গত ৪ নভেম্বর এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘দেশে বছরে গম উৎপাদন হয় ১০-১২ লাখ মেট্রিক টন। দুই বছর ধরে বøাস্ট রোগের কারণে গমের উৎপাদন দ্রুত কমছে। অন্যদিকে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে রুটি ও গম থেকে উৎপাদিত খাদ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। গত এক যুগে দেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬০ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির প্রয়োজন হতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিষয়ক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।’ মাছ, মাংস, শাক-সবজি, ফল ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বলা হয়, উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসবের অবস্থা কী? কথায় বলে মাছে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু সে মাছ এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কারণ, মূল্য অস্বাভাবিক। বিদেশ থেকে প্রচুর আসার পরও এই অবস্থা। তাও মাছের ভরা মওসুমে। মওসুম শেষ হলে মাছ সোনার হরিণে পরিণত হতে পারে। যেমন এবার হয়েছে ইলিশ মাছ। তদ্রæপ অবস্থা মাংসেরও। ভারত ও মিয়ানমার থেকে অনেক গরু ও ছাগল আসে। এছাড়া, ফ্রিজিং মাংসও আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। বিশেষ করে ভারত থেকে। স¤প্রতি গোখামারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রিজিং মাংস আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে ভারত। অর্থাৎ বিদেশ থেকে অনেক গরু-ছাগল ও মাংস আসার পরও মাংসের মূল্য অস্বাভাবিক। মাছ-মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন হলে তো এসব হওয়ার কথা নয়। নাকি পথে, ঘাটে ও হাটে ব্যাপক চাঁদাবাজির কারণে এই মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে? তেমনি অবস্থা ফলেরও। বাজারে যে ফল পাওয়া যায় তার বিরাট অংশই বিদেশি। মূল্যও অনেক। আর মসল্লার সবই আমদানিকৃত। এছাড়া, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, ভোজ্য তেল, ডাল ইত্যাদির বেশিরভাগই আমদানিকৃত। তাই এসব পণ্যের মূল্য আকাশ ছোঁয়া। সর্বোপরি পেঁয়াজের মূল্যে এবার বিশ্বরেকর্ড হয়েছে। বিপুল পরিমাণে আমদানি করার পরও মূল্য তেমন কমেনি কয়েক মাসে। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণেই মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। দেশে পেঁয়াজ এবার এমন আকর্ষণীয় পণ্য হয়েছে যে, মানুষ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিফট হিসাবে পেঁয়াজ দান করেছে। এছাড়া, মোবাইল ও আরও কিছু পণ্য ক্রয় করলে পেঁয়াজ ফ্রি দেওয়া হয়েছে বেশি বিক্রির আশায়। উপরন্তু টিসিবি’র ট্রাকের পেঁয়াজ নেওয়ার জন্য নারী-পুরুষের লম্বা লাইন ছিল দেশব্যাপীই। এরূপ অবস্থা হয়েছিল স্বাধীনতার পর থেকে গত ৮০’র দশক পর্যন্ত। সে সময় রেশন দোকানের পণ্য নেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন হতো। অনেকেই লাইনে ইট রেখে টাকা আদায় করতো। দীর্ঘদিন পর সেই অবস্থা হয়েছে এবার পেঁয়াজের ক্ষেত্রে। এই সংকটের প্রধান কারণ, চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির মধ্যে ব্যাপক ফারাক। গত ৩ ডিসেম্বর জার্মান বেতারে প্রকাশ, ‘কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৬.১৯ লাখ টন। কিন্তু এই উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ৩০ ভাগ নষ্ট হয়। ফলে বছরে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে ৮-৯ লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে। তাই অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ ৪০% পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ২২ লাখ টন। নতুন অর্থ বছরে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে ৪.৭২ লাখ টন।’ অপরদিকে, দেশে শাক-সবজির ভরা মওসুম হচ্ছে শীতকাল। তাই মূল্য কম হয়। আর মওসুম শেষ হওয়ার দিকে মূল্য এমন হ্রাস পায় যে অনেকেই সবজি পশুকে খাওয়ায়। আবার অনেক সবজি মাঠেই পচে নষ্ট হয়ে যায়। কৃষক ঘরে তোলে না, খরচ উঠে না বলে। যেমন: কয়েক বছর যাবত কৃষক ধানের সঠিক মূল্য না পেয়ে ধান উৎপাদনে নিরুৎসাহী হয়েছে। অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে মাঠে আগুন দিয়েছে। চলতি আমন মওসুমেও নির্দিষ্ট সময়ে ধান-চাল ক্রয় না করায় মণপ্রতি ৫শ’ টাকা করে লোকসান হয়েছে কৃষকের। আলুর অবস্থাও তাই। মওসুম শেষ হলেও পুরানো আলু এখনো শেষ হয়নি। আর পাটের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না কৃষক বহুদিন যাবত। তাই গলার ফাঁস হয়েই আছে। বেশিরভাগ পাটকলের অবস্থাও শোচনীয়। অথচ পাটের সোনালী ব্যাগ প্রয়োজন মোতাবেক তৈরি করা হলে এত দুর্গতি হতো না। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যেত। পরিবেশও রক্ষা পেত। যা’হোক, এ বছর সবজির ভরা মওসুমেও মূল্য আকাশ ছোঁয়া। মওসুম শেষকালে কী হবে তা এখন বলা কঠিন।

এটা ঠিক যে, দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বেড়েছে অনেক। কৃষকের বাধ্যগত অক্লান্ত পরিশ্রম আর হাইব্রিডের কারণে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বেড়েছে অনেক। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রণীত বৈশ্বিক সূচক-২০১৯ মতে, ‘কৃষি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২১তম, মূল্য ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালের সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে এই তালিকা করা হয়েছে।’ পরবর্তী দু’বছরে দেশে কৃষিউৎপাদন আরও বেড়েছে । গত ৯ ডিসেম্বর কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ‘ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। কৃষিজমি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। তবে দেশে এখন নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যের শেষাংশ সঠিক। কারণ, গত ৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত খাদ্য ও পুষ্টি অধিকার জাতীয় সম্মেলন ২০১৯-এ বক্তারা বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। গত ১০ বছরে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৭ লাখ।’ অন্য এক তথ্য মতে, ‘বিশ্বে খাদ্যশক্তি গ্রহণের গড় ২,৯৪০ কিলো ক্যালরি। বাংলাদেশে তা ২,৫১৪ কিলো ক্যালরি। এক বছরে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ বেড়েছে চার লাখ।’ স্মরণীয় যে, দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ দরিদ্র। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০১৯ মতে, ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম, স্কোর ২৫.৮ (২০১৮ সালে ছিল ৮৬তম, স্কোর ২৬.১)।

দেশে ক্রমান্বয়ে কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। এ ব্যাপারে গত ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিআইপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রতিবছর দেশের প্রায় ৭১ হাজার হেক্টর কৃষিজমি অকৃষি খাতে পরিবর্তিত হচ্ছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বনভূমি ও জলাশয় তৈরি এবং আবাসনই এর মূল কারণ। খুব দ্রুত সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে না পারলে কৃষি জমি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।’ এই অবস্থায় বর্তমানে ৮.৭৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে বলে জানা গেছে। আরও জানা গেছে, বর্তমানে জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৩-১৪%। বিবিএস›র চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.৯২% (শিল্প খাতে ১২.৬৭% ও সেবা খাতে ৬.৭৮%)। অন্যদিকে, জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। দেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা যত কমবে, খাদ্যের চাহিদা তত বাড়বে। সর্বোপরি রয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষতি। জলবায়ু পরিবর্তনে বোরো ও আমন উৎপাদন ব্যাহত হয়ে ৭০% পর্যন্ত কমতে পারে। এ ছাড়া নোনাজলের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের ৬২% ফসলি জমিতে চাষাবাদ এবং সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ার কারণে এক-চতুর্থাংশ জমি কমে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সর্বোপরি মাঝে-মধ্যেই প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ফসলের ক্ষতি হয় ব্যাপক। তাই দেশে খাদ্য উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করা আবশ্যক। এছাড়া, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, পরিকল্পনার অভাব, চাহিদা ও উৎপাদনের নির্ভুল তথ্যের অভাব আছে। সর্বোপরি অধিকাংশ কৃষক অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত। তাই তারা পণ্যের চাহিদা, পুষ্টিগুণ, মাটির উর্বরতা, পানির স্তর, জলবায়ুর পরিবর্তন, বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনের পরিস্থিতি ইত্যাদি বোঝে না।

ফলে তারা দেশে যখন যে ফসলের মূল্য বেশি দেখে তখন সে ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে উৎপাদন বেড়ে চাহিদার অতিরিক্ত হয়ে যায়। তখন মূল্য ব্যাপক হ্রাস পায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা। তখন তারা সে ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। তাই উৎপাদন হ্রাস পায়। তখন আবার মূল্য বেড়ে যায়। দেশে কৃষিপণ্যের প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সুষ্ঠ বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নেই। তাই যখন যে ফসল উঠে, তখন তার মূল্য ব্যাপক হ্রাস পায়। আবার মওসুম শেষ হলে মূল্য অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু কৃষক তার সুবিধা পায় না। কারণ, তারা ফসল উঠার সাথে সাথেই কম মূল্য ফসল বিক্রি করে দেনা পরিশোধ করে। কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সুবিধা ভোগ করে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোক্তারা। কারণ, অধিক মূল্যেই তাদের ক্রয় করতে হয়। এছাড়া, দেশে নিরাপদ ও পুষ্টিগুণ খাদ্যের প্রচন্ড অভাব রয়েছে। এভাবে কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বহুকাল যাবত। অপরদিকে, দেশের কৃষিব্যবস্থা এখনো আধুনিক হয়নি। অধিকাংশই সেকেলে রয়েছে। উপরন্তু সা¤প্রতিককালে কৃষি শ্রমিকের সংকট চলছে ব্যাপক। মজুরীও অত্যধিক। সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদিরও মূল্য বেশি। এসব নানা কারণে কৃষির উৎপাদন ব্যয় ব্যাপক। ফলে পণ্যের মূল্য বেশি। তাই বিশ্বায়ন মোকাবেলা করতে পারছে না। বিশেষ করে ভারতের পণ্যের সাথে। কারণ, ভারতসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের কৃষিব্যবস্থা যান্ত্রিকরণ করা হয়েছে। ফলে তাদের উৎপাদন ব্যয় অনেক কম। পণ্য মূল্যও কম। আমাদের কৃষি ও কৃষক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকেই কৃষি কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। তাই জিডিপিতে কৃষির অবদান হ্রাস পাচ্ছে। অথচ দেশটি এখনও কৃষিভিত্তিক। মোট জনসংখ্যার ৮০% এবং শ্রমশক্তির ৬০% কৃষিতে নিয়োজিত। তবুও কৃষিকে অবহেলা করে শিল্পায়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অনেকদিন যাবত। কিন্তু তাতে সাফল্য আসেনি। দেশের বেশিরভাগ শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে অসংখ্য শ্রমিক বেকার হয়েছে বিশ্বায়ন মোকাবেলা করতে না পেরে! মাঝখানে শিল্পায়নের নামে ব্যাংকের কয়েক লাখ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে,যার সব আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম। অথচ এই বিপুল অর্থ দিয়ে যদি কৃষির আধুনিকায়ন ও কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠা করা হতো, তাহলে এতদিনে কৃষিখাত আধুনিক হয়ে চেহারা পাল্টে যেত। কৃষক ও দেশের অনেক টেকসই উন্নতি হতো। আঞ্চলিক বৈষম্য সৃষ্টি হতো না। তাই দেশের টেকসই ও সার্বিক উন্নতির মূল স্তম্ভ হচ্ছে কৃষি। এ ক্ষেত্রে কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য স্মরণীয়। তিনি গত ১১ ডিসেম্বর বলেন, ‘পুষ্টির অন্যতম প্রধান উৎস হলো মাছ, মাংস, দুধ, ডিম। আমাদের মাথাপিছু যে আয় তা দিয়ে সবার পক্ষে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা সম্ভব না। মাথাপিছু আয় বাড়াতে হলে কৃষিকে আধুনিক কৃষিতে নিয়ে যেতে হবে এবং প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে। কৃষিই এ দেশের কৃষ্টি। কৃষিই এ দেশের অর্থনীতির প্রধান হাতিয়ার।’ স্মরণীয় যে, দেশের কৃষি খাতের অবনতি দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কারণ, ১৭-১৮ কোটি মানুষের খাদ্য আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই দেশকে সুষম খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংভর ও লাভজনক করা ছাড়া বিকল্প নেই।

দেশকে সুষম খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংভর ও লাভজনক করার জন্য কৃষিজমিকে শতভাগ রক্ষা ও পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা আবশ্যক। এছাড়া সময়োপযোগী পরিকল্পনা এবং প্রতিটি কৃষিপণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রয়োজন। উপরন্তু এর ভিত্তিতে কোন খাদ্যের চাহিদা বেশি, কোন ফসলে পুষ্টিমান কত, বিশ্বে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি এবং এসব দেশের কোন অঞ্চলে উৎপাদন ভাল হবে সে ব্যাপারে কৃষককে সার্বক্ষনিক পরামর্শ, উৎসাহ ও প্রণোদনা দিতে হবে। আর এসব করতে হবে মেয়াদভিত্তিক। অর্থাৎ কয়েক বছর পরপর তথ্য ও পরামর্শ হালনাগাদ করতে হবে। অন্যদিকে, পানিতে ভাসমান ও ভূমিতে ৩-৪ তলাবিশিষ্ট মাচাং করে কৃষি চাষ শুরু হয়েছে। এসব করার প্রচুর সুযোগও রয়েছে দেশে। এসব ক্ষেত্রে কৃষককে উৎসাহিত করতে হবে। অপরদিকে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা মোকাবেলা ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কৃষিপণ্যের মান বৃদ্ধি ও মূল্য কমাতে হবে। সে জন্য দরকার কৃষিকে শতভাগ যান্ত্রিকরণ, শস্য বহুমুখীকরণ,সব জমিকে সেচের আওতায় আনা এবং তা সৌর বিদ্যুতে চালানো দরকার। এছাড়া, সার, সেচ, বীজ ও কীটনাশকে ব্যাপক ভর্তুকি দিয়ে স্বল্প মূল্যে কৃষকের কাছে সরবরাহ করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে স্বল্প সুদে প্রয়োজনীয় কৃষিঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব করা হলে দেশের কৃষির অনেক উন্নতি ঘটবে। পণ্যমূল্যও অনেক হ্রাস পাবে। কৃষির উন্নতির পাশাপাশি কৃষকেরও উন্নতি ঘটাতে হবে। সে লক্ষ্যে প্রতিটি ফসল উঠার সাথে সাথে তা ন্যায্যমূল্যে ক্রয় করতে হবে সরাসরি কৃষকের নিকট হতে। এবং তা সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সংরক্ষণাগার ও প্রক্রিয়াজাতকরণেরে ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য ৫০ লাখ মে.টন খাদ্য সংরক্ষণাগার এবং বহু প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার বলে ব্যবসায়ীদের অভিমত। এটা করা হলে ভোক্তারাও লাভবান হবে। তারা স্বল্পমূল্যে সারা বছর প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পাবে। কোন খাদ্য নষ্ট হবে না। অবশ্য খাদ্যের প্রয়োজনীয় সংরক্ষণাগার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে (কৃষিযন্ত্রের জন্যও। কারণ, মূল্যবান কৃষিযন্ত্র ক্রয় করার মতো সামর্থ্য নেই কৃষকের)। তাহলে ব্যবসায়ীরা কয়েক বছরের মধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। দ্বিতীয়ত: কৃষকের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে খাদ্য দ্রব্যের চোরাচালান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ এবং যেসব পণ্য দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন হয়, তার আমদানির উপর সর্বাধিক শুল্ক আরোপ করতে হবে। তাহলে কৃষক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। দেশে কৃষি পণ্যের মান যত বাড়বে ও মূল্য হ্রাস পাবে,তত রফতানি বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বে এখন অর্গান ফুডের চাহিদা বেশি। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকে উৎপাদিত খাদ্য মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফলে মানুষ প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত খাদ্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এদিকে নজর দিতে হবে। হালাল মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্বব্যাপীই। বিশেষ করে মুসলিম দেশে ও মুসলমানদের মধ্যে। বেঙ্গল গোটের কদর তো সারাবিশ্বেই। হালাল মাংস রফতানির দিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য দরকার প্রয়োজনীয় আধুনিক কসাইখানা ও মাংস ফ্রিজিং করার ব্যবস্থা। সর্বোপরি কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি পণ্যেরই অধিক ফলনশীল বীজ ব্যবহার করার জন্য কৃষককে সর্বদা পরামর্শ দেওয়া দরকার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৪:৪৮ পিএম says : 0
What ever you mentioned in your article is 100% correct but our Government is 100% corrupt... also general mass is also corrupt, they don't love our beloved country.. Majority are selfish.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন