রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

প্রিয় নবী (সা.)-এর আনন্দ-আলাপ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৭:৩৭ পিএম

জীবনের বাঁকে বাঁকে দেখা দেয় নানা প্রয়োজন; হাসি-কান্না আসে অবিরত। কেউ কোনোদিন কাঁদেনি বা হাসেনি, এমন মানুষের নজির নেই। জীবনের এই যান্ত্রিকতায় আমরা নানা গল্প ও হাস্য-রসিকতা করি। এর কোনোটা মিথ্যা আর কোনোটা সত্য; তা হয়তো কখনোই খেয়াল করা হয় না। বাস্তবভিত্তিক হাস্য-রসিকতা করলে শান্তির আবহে ভরে ওঠে জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত। প্রিয় নবী (সা.) নিজেও এমন হাস্য- রসিকতায় অংশ নিয়েছেন। শিখিয়েছেন সামাজিক নানা অসংগতি থেকে বাঁচার উপায়। আমরা অনেকেই হয়তো জানি, তিনি ছিলেন গুরুগম্ভীর প্রকৃতির। এ ধারণা ভুল। তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। ছিলেন মজার মানুষও। কাঠখোট্টা ছিলো না তার জীবনযাপন। নিজ পরিবার ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর সঙ্গে উত্তম ব্যবহারসহ বাস্তবভিত্তিক হাসি-ঠাট্টাও করতেন মাঝেমধ্যে। এর নমুনা পাওয়া যায় বিভিন্ন ইতিহাস ও হাদিসগ্রন্থে। শামায়েলে তিরমিজি শরিফে আছে- হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন- একবার সাহাবায়ে কেরাম অবাক হয়ে রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন-‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনিও আমাদের সঙ্গে হাস্য-রসিকতা করেন?’ জবাবে বললেন-‘আমি সত্যকে মিথ্যা বলি না (অর্থাৎ আমি হাস্য-রসিকতা করলেও তা সত্য ও বাস্তবভিত্তিক হয়, তাতে মিথ্যার লেশমাত্র থাকে না)।’

তাঁর আরও কিছু রসালাপ ও আনন্দঘন মুহূর্তের কথা তুলে ধরা হলো-
(এক) মদিনার এক নারী উম্মে আইমান। রাসুল (সা.)-এর এক সাহাবির স্ত্রী। রাসুল (সা.)-এর দরবারে এলেন। উদ্দেশ্য, স্বামীর আদেশ পালন। তাঁর স্বামী তাঁর মাধ্যমে রাসুল (সা.)-কে ডেকে আনতে পাঠিয়েছেন। সালাম দিয়ে সবিনয়ে তিনি বললেন-‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমার স্বামী আপনাকে সালাম জানিয়েছেন (ডেকেছেন)।’ তাঁর স্বামী সাহাবি হওয়ায় রাসুল (সা.) তাঁর স্বামীকে আগথেকে চিনতেন। এরপরও তিনি স্ত্রীলোকটির সঙ্গে রসালাপের ইচ্ছায় বললেন-‘তোমার স্বামী অমুক না! যার চোখ ঘোলাটে?’ স্ত্রীলোকটি বললেন-‘না তো! তাঁর চোখ তো ভালো।’ রাসুল (সা.) বললেন-‘নিঃসন্দেহে ঘোলাটে।’ স্ত্রীলোকটি এবার শপথ করে বললেন-‘জী না।’ রাসুল (সা.) বললেন-‘এমন কোনো লোক নেই, যার চোখে শুভ্ররেখা নেই। অর্থাৎ চোখের জ্বলন প্রতিটি মানুষেরই শুভ্র-কৃষ্ণ উভয়টা হয়ে থাকে।’ (এহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/১৩০০; মুজাহে নববি : ৩)।
(দুই) শিশু আবু উমায়ের, রাসুল (সা.)-এর এক সাহাবির সন্তান। লাল নামে সে ছোটো একটি প্রাণি পুষতো। লাল ছিলো খুব তেজি। আবু উমায়ের ওর সঙ্গে খেলা করতো। একদিনের কথা। সে লালের সঙ্গে খেলছিলো। হঠাৎ লাল মারা গেলো। তার মৃত্যুতে আবু উমায়ের খুব কাঁদলো; অনেক ব্যথিত হলো। রাসুল (সা.) তাদের বাসায় বেড়াতে গেলেন। তাকে দেখে হাস্যোজ্জল চেহারায় বললেন-‘উমায়ের! তোমার নুগায়ের (তেজিটি) কোথায়?’ (মুজাহে নববি : ৪)।
(তিন) ইসলামে তখনও পর্দা ফরজ হয়নি। হজরত আয়েশা (রা.) রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে বসা ছিলেন। জাহ্হাক বিন সুফিয়ান কালবি (রা.) ছিলেন রাসুল (সা.)-এর এক কালো চেহারার সাহাবি। তিনি রাসুল (সা.)-এর দরবারে এলেন; বাইয়াত গ্রহণ করবেন। খানিকপর বাইয়াত গ্রহণ করে বললেন-‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমার দুজন স্ত্রী। তাদের চেহারা হজরত আয়েশা (রা.)-এর চেয়েও ভালো। যদি আপনি বিয়ে করতে চান, তাহলে একজনকে তালাক দেবো।’ হজরত আয়েশা (রা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন-‘তোমার স্ত্রী ও তোমার মাঝে কার চেহারা ভালো? তোমার নাকি তোমার স্ত্রীর?’ জাহ্হাক (রা.) বললেন-‘আমার।’ রাসুল (সা.) তাদের প্রশ্নোত্তরে হাসলেন। কারণ এমন কালো চেহারাসত্ত্বেও জাহ্হাক (রা.) নিজেকে ভালো চেহারার অধিকারী ভাবছেন। (এহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/১৩০; মুজাহে নববি : ৩)।
(চার) একদিন রাসুল (সা.) হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে ছিলেন। তাঁর অপর পাশে বসা ছিলেন হজরত সাওদা (রা.)। হজরত আয়েশা (রা.) দুধের পায়েশ রান্না করলেন। এরপর হজরত সাওদা (রা.)-কে বললেন-‘একটুখানি খাবেন।’ হজরত সাওদা (রা.) বললেন-‘আমার খেতে মন চাচ্ছে না।’ হজরত আয়েশা (রা.) বললেন-‘খান, না হয় আপনার মুখে মেখে দেবো।’ হজরত সাওদা (রা.) বললেন-‘আমি খাবোই না।’ এরপর হজরত আয়েশা (রা.) পাত্র থেকে সামান্য পায়েশ নিয়ে তাঁর মুখে মেখে দিলেন। রাসুল (সা.) নিজের পা-দুটো সরিয়ে নিলেন; যেনো হজরত সাওদা (রা.) এর প্রতিশোধ নিতে পারেন। হজরত সাওদা (রা.) পাত্র থেকে পায়েশ নিয়ে হজরত আয়েশা (রা.)-এর মুখে মেখে দিলেন। রাসুল (সা.) তাঁদের এমন রসিকতায় খুব হাসলেন। (এহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/১২৯; মুজাহে নববি : ৫)।
(পাঁচ) হজরত হাসান (রা.) রাসুল (সা.)-এর নাতি। তিনি তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। হাসান তখন ছোটো শিশু। একবার রাসুল (সা.) তাঁকে কোলে নিয়ে বারবার জিহ্বা বের করছিলেন। হাসান (রা.) তা দেখে খুব খুশি হচ্ছিলেন। উয়ায়েনা বিন বদর ফাজারি (রা.) এ অনুপম স্নেহদৃশ্য দেখে বললেন-‘আমার ছেলে যুবক হয়েছে; দাঁড়ি গজিয়েছে। অথচ এ যাবৎ আমি তাকে কখনও স্নেহ করিনি; চুমুও দিইনি।’ রাসুল (সা.) বললেন-‘যে অন্যের প্রতি দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হবে না।’ (এহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/১৩০; মুজাহে নববি : ৮)।
(ছয়) হজরত আয়েশা (রা.) রাসুল (সা.)-এর সবচে’ কমবয়সী সহধর্মিনী। রাসুল (সা.) তাঁকে সবচে’ ভালোবাসতেন। তাঁর জন্য রাসুল (সা.)-এর ঘরে ভিন্ন একটি কুঠরি ছিলো। আয়েশা (রা.) সেখানে বান্ধবীদের নিয়ে খেলতেন। একবার একটি মজার ঘটনা ঘটলো। তাঁরা খেলছিলেন সেখানে। হঠাৎ রাসুল (সা.)-এর আগমনের ধ্বনি টের পেলেন সবাই। খেলা ছেড়ে বান্ধবীরা এদিক-ওদিক লুকোলেন। রাসুল (সা.) এসে সবার হাত ধরে ধরে আবার আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে খেলায় জুড়ে দিলেন। (মিশকাত শরিফ : ২৮০)।
(সাত) একবার রাসুল (সা.) সাহাবাদের লক্ষ্য করে বললেন- যে ব্যক্তি সবশেষে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে, আমি তার সম্বন্ধে জানি। সে মাটি ঘেঁষে ঘেঁষে সেখান থেকে বেরোবে। তাকে বলা হবে-‘জান্নাতে যাও।’ সে জান্নাতের সামনে গিয়ে দেখবে, জান্নাতিরা পুরো জায়গা দখল করে নিয়েছে। সে ফিরে এসে বলবে-‘হে আল্লাহ! জান্নাতের পুরো জায়গা তো দখল হয়ে আছে।’ বলা হবে-‘পার্থিব জীবনের কথা কি তোমার মনে আছে?’ সে বলবে-‘হ্যাঁ আছে।’ বলা হবে-‘আমার কাছে যা ইচ্ছে, চাইতে পারো।’ সে প্রয়োজনমতো চাইবে। বলা হবে-‘তোমার চাওয়া জিনিসসহ ১০টি দুনিয়াসম এক পৃথিবী তোমাকে দান করলাম।’ এ ব্যাপারটিকে সে নিছক তামাশা মনে করবে। বলবে-‘হে আল্লাহ! আপনি রাজাধিরাজ হয়েও আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?’ এ হাদিসটি বর্ণনা করে রাসুল (সা.) এতো হাসলেন যে, তাঁর দন্তপাটি দেখা গেলো। (শামায়েলে তিরমিজি : ১৫)।
(আট) একবার এক বৃদ্ধা রাসুল (সা.)-এর দরবারে এসে নিবেদন করলো-‘হুজুর! আল্লাহর কাছে আমার জন্য একটুখানি দোয়া করুন, যেনো আমি জান্নাতে যেতে পারি।’ রাসুল (সা.) বললেন-‘জান্নাতে তো কোনো বৃদ্ধা যাবে না!’ এ কথা শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে চলে যেতে লাগলো। রাসুল (সা.) সাহাবাদের ডেকে বললেন-‘তাকে জানিয়ে দাও, বৃদ্ধাবস্থায় সে জান্নাতে যাবে না; (বরং যুবতী হয়ে যাবে)। কারণ আল্লাহতায়ালা বলেছেন- আমি জান্নাতি নারীদেরকে বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি। আর তাদের করেছি চির কুমারী।’ (সুরা ওয়াকিয়া : ৩৫-৩৬; শামায়েলে তিরমিজি : ১৬; হায়াতুস সাহাবা : ২/৫৭৩)।
(নয়) রাসুল (সা.)-এর আদরের নাতি হজরত হাসান (রা.)। একবার রাসুল (সা.) সিজদারত ছিলেন। তাঁর পিঠে চড়েছিলেন তিনি। নিজে না নামা পর্যন্ত রাসুল (সা.) তাঁকে নামালেন না। কখনো বা রাসুল (সা.) নিজের পিঠে তাঁর চড়ে বসার সুবিধার্থে দুহাঁটুর মাঝে একটুখানি ফাঁকা রাখতেন; যেনো তিনি পায়ের এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন। (হায়াতুস সাহাবা : ২/৪৮১; মাজমাউজ জাওয়ায়িদ : ৯/২৯০)।
(দশ) এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে আরোহনোপযোগী একটি উট চাইলো। রাসুল (সা.) তাকে বললেন-‘আমি তোমাকে একটি উটনীর বাচ্চা দেবো।’ লোকটি আরজ করলো-ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি উটনীর বাচ্চা দিয়ে কী করবো? (আমার তো আরোহনোপযোগী উট দরকার)।’ রাসুল (সা.) বললেন-প্রতিটা উট তো কোনো কোনো উটনীর বাচ্চাই হয়।’ (শামায়েলে তিরমিজি : ১৬; মুসনাদে আহমদ : ৩/২৬৭; হায়াতুস সাহাবা : ২/৫৭১)। এ ধরনের আরও অনেক ঘটনাই প্রিয়তম রাসুল (সা.)-এর জীবনে ঘটেছে, যার বিবরণ হাদিস ও সিরাতের কিতাবে বিদ্যমান। রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শ হোক আমাদের চলার পথের পাথেয়।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মো. নজরুল ইসলাম ৬ মার্চ, ২০২২, ৮:৪১ পিএম says : 0
অসাধারণ
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন