মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ভারতজুড়ে ‘নো এনআরসি’

মহসিন আলী রাজু | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম


বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের বিস্ময়কর নির্বাচনী ফলফলের পরপরই প্রতিবেশি ভারতের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় সদম্ভ প্রত্যাবর্তন হয় বিজেপির। নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গেও কোনোক্রমে বিজেপির বিজয়রথ আটকাতে পারলেও বেশ ঝুঁকির মুখে পড়ে যান তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বঙ্গোপাধ্যায় ও তার দল তৃণমূল কংগ্রেস।

ভারতের জাতীয় নির্বাচনের পরপরই ভারতসহ বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক ও মুক্ত চিন্তার মানুষ চিন্তায় পড়ে যায় এই ভেবে যে, বিশ্বে গণতন্ত্রাত্রিক মূল্যবোধই আসলে হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে কিনা?

গণতান্ত্রিক ভারতে নরেন্দ্র মোদি এবং গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভয়াল উত্থানের সাথে যে নগ্ন মুসলিম বিরোধিতার বিষয়টি সরাসরি জড়িত সে ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ নেই। আলোচ্য লেখার শিরোনামের গভীরে যেতে চাইলে তাকাতে হবে ভারতের ইতিহাসের একটু পেছনের দিকে। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি অনুসরণ করে ভারতের ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশরা বেশ সফল হয়েছিল। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯০০ খিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশরা মুসলিম শাসনামলের প্রত্যাবর্তনের জুজু ঝুলিয়ে ওই সময়ের ভারতে সবদিক থেকে এগিয়ে নেয় হিন্দু জনগোষ্ঠীকে। তবে এক পর্যায়ে শিক্ষিত ও সচেতন হিন্দু জনগোষ্ঠীর লোকেরাও ভারত থেকে ব্রিটিশদের বিদায় করার তৎপরতায় জড়িয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে ব্রিটিশরা পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিকে নজর দেয়।

এবার তারা মুসলিম স্কলার শ্রেণীর লোকজনকে ব্যবহার শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে মুসলিমদের এগিয়ে নিতে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করে পূর্ব বাংলা এবং আসামকে নিয়ে নতুন রাজ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গঠন করে। এ অংশের রাজধানী করা হয় ঢাকাকে। একই সময়ে কংগ্রেসের বিপরীতে প্রতিষ্ঠা হয় মুসলিম লীগ। গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এসব ঘটনা ঘিরে ভারতজুড়েই অতঃপর একধরনের মুসলিম জাগরণ পরিলক্ষিত হয়।

তবে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটিশদের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি ক্ষয়ে প্রাকৃতিক নিয়মেই নিঃশেষ হয়ে যায়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ভারতকে আরও বহুদিন ঔপনিবেশিক বেড়াজালে আবদ্ধ রাখার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসে তাদের। ’৪৭ সালের মধ্যেই ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে হয় ব্রিটিশদের।

তবে বিদায়লগ্নেও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে ভারতকে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান এ দুই নামে ভাগ করে যায় তারা। এই বিভক্তির ফলে ভারতের পূর্ব প্রান্তের তৎকালীন পূর্ব বাংলা (পরে পূর্ব পাকিস্তান এবং আরও পরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ) থেকে পশ্চিমে পাকিস্তানভুক্ত পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধু পর্যন্ত এলাকার মাঝখানে প্রায় ১২শ’ কিলোমিটার অংশজুড়ে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী পড়ে যায় চরম বেকায়দায়। ওই এলাকায় বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনেকেই নিজের বাপদাদার ভিটেমাটি ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে গিয়ে নেটিভ শ্রেণীর পাকিস্তানী জনগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়। আবার যারা ভারতেই থেকে যায় ভারতীয় হিন্দু জনগোষ্ঠীর কাছেও তারা হয়ে ওঠে চক্ষুশূল!

অন্যদিকে হিন্দু জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত হায়দারাবাদ মুসলমান শাসকের অধীনে থাকলেও খুব সহজেই ভারতীয়রা ছলে-বলে-কৌশলে স্বাধীন থাকার চেষ্টাকারী রাজ্যটি সৈন্য পাঠিয়ে দখলে নিয়ে নেয়। এই দখল প্রচেষ্টা রুখে দিতে গিয়ে হাজার মুসলমানকে প্রাণ দিতে হয় প্রথমে ভারতীয় সৈন্য ও পরে হিন্দু দাঙ্গাবাজ ও লুটেরাদের হাতে। হায়দারাবাদ রাজ্যটির সীমানার সাথে পাকিস্তানের সীমানার সংশ্লিষ্টতা না থাকায় এক্ষেত্রে পাকিস্তান কিছুই করতে পারেনি। জাতিসংঘও এক্ষেত্রে বিস্ময়কর নিরবতা প্রদর্শন করে।

এরপরই শুরু হয় আরেকটি সমস্যা ও গুরুতর সঙ্কট। গত ৭২ বছর ধরে যে সঙ্কটের সুরাহা-তো হয়ইনি বরং ধিকিধিকি জ্বলা আগুন এখন অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করেছে। অর্থাৎ পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বদিকে তাদের সীমান্ত সংলগ্ন ভু-স্বর্গ কাশ্মীরের কথা বলা হচ্ছে এখানে।

১৯৪৮ থেকে ২০২০ এ দীর্ঘ ৭২ বছরে ভারতের সকল শাসক গোষ্ঠীই পাকিস্তান জুজু, কাশ্মীর ইস্যু ব্যবহার করে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি অনুসরণ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভোট নিয়েছে। তবে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে বিজেপির সদম্ভ বিচরণ শুরুর পর পাকিস্তান জুজু, কাশ্মীর ইস্যুর সাথে সাথে এখন যোগ হয়েছে ভারতকে মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধমুক্ত করে একেবারে পরিপূর্ণ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস। ভারতের প্রতিবেশী দেশ চির বৈরি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ভাষায় ভারতের বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসলে ভারতের হিটলার। জার্মানীর সরকার প্রধান বা ফ্যুয়েরার হিটলার যেমন জার্মানীতে বসবাসকারী সব ইহুদিকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদিও মুসলমানদের ক্ষেত্রে ঠিক তাই করতে চাইছেন।

চলতি বছরের আগস্টের শুরুতেই বিজেপি সরকার যখন ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন রাজ্য কাশ্মীরে দফায় দফায় আর্মি ডেপ্লয়েড করতে থাকে তখনই সবাই চমকে ওঠে। তবে সকলের চমক ও বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই কাশ্মীরকে দেয়া বিশেষ মর্যাদার ধারাগুলো পার্লামেন্টে ভোটাভুটির মাধ্যমে রদ করে দেয়া হয়। অদম্য কাশ্মীরিরা যেন প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্য কাশ্মীরের ৭৫ লাখ মানুষের বিপরীতে ওই রাজ্যে এখন ভারতের ৯ লাখ মিলিটারি ও প্যারা মিলিটারি মোতায়েন রাখা হয়েছে। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখে গোটা পৃথিবীর সাথে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে কাশ্মীরিদের। আয়তন ও জনসংখ্যা অনুপাতে কাশ্মীর রাজ্যের মিলিটারি ডিপ্লয়মেন্ট-এর সংখ্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

তবে এতো কিছুর পরও ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর কিন্তু ক্ষোভের আগুনে জলছে। কাশ্মীরে বিপুল সংখ্যায় আর্মি ডেপ্লয়েডের খরচ, মুসলিম দেশগুলোর সাথে দূরত্ব তৈরি, পর্যটক হ্রাস, রফতানী খাতে বিপর্যয় ইত্যাদি কারণে ভারতের অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। মাঝে মাঝেই পাকিস্তানী হানায় ভারতীয় সৈন্য হতাহতের ঘটনায় লাখ লাখ সেনা সদস্যের পরিবারে নেমে এসেছে হতাশা ও ক্ষোভ। ক্রমশঃ সবাই বুঝতে পারছে, শুধু ধর্মচিন্তা নয় বরং ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতা পাকাপোক্ত করাসহ শাসকদের ব্যর্থতা নিয়ে কেউ যেন প্রশ্ন না তুলে সেজন্যেই চমক হিসেবে ‘সিএএ’ এবং ‘এনআরসি’ কার্যকর করার চেষ্টায় আছে বিজেপি।

ভারতে আজ শুধু ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরই জ্বলছে না, সিএএ বা এনআরসি ইস্যুতে ফুঁসছে গোটা ভারত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পৌরাণিক যুগের চিন্তায় আচ্ছন্ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহদের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বঙ্গোপাধ্যায় ‘নো এনআরসি, নো সিএএ, রোটি, কাপড়া ও মাকান’ এর যে সেøাগান তুলে মাঠে নেমেছেন, তাতে জনসমর্থন আছে বলেই মনে হচ্ছে। ভারতজুড়েই বিজেপির পৌরানিক শাসন কল্পনা বিলাসের বিরুদ্ধে মমতা-রাহুলদের রোটি কাপড়া মাকানের সেøাগান ও আন্দোলন যদি সফল হয় তাতেই ভারতের রক্ষা এটা সুচিন্তক মানুষের অভিমত।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
Ziared Rahman ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৫৯ এএম says : 0
বাংলাদেশ সরকারের উছিত খুব দ্রুত ভারতের ভিসা বন্ধ করা, সেই সাথে বাংলাদেশে যেসব ভারতীয় আছে তাদের ভারত পাঠানো, ভারতের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করা, এবং আন্তর্জাতিক ভাবে ভারত কে চাপ দেওয়া যাতে করে ভারতে মুসলিমদের উপর অত্যাচার না করতে পারে। মুসলিম দেশ গুলা এক হয়ে ভারত কে বাঁশ দেওয়া।
Total Reply(0)
Azim Uddin ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:০০ এএম says : 0
মোদি ইচ্ছে করলে ভারতের জাতীয় নেতা হতে পারতো। কিন্তু তা না হয়ে সে রাবণই হল। হিন্দুত্ব বাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে খোদ হিন্দুদেরই তোপের মুখে পড়ল। কারণ, সে মনে করেছিল বাকি সব হিন্দু ও তার মতো চা বিক্রেতা। হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডা কাজে লাগিয়ে সে একটা অপরিচিত ও অখ্যাত দলকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিয়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু দেশের বৃহত্তম সংখ্যালুগু মানুষকে বাদ দিয়ে গান্ধীর ভারত হতে যে পারেনা, তা কিন্তু এরই মধ্যে আমজনতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসু ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় না বসলেও উপমহাদেশের মানুষের হৃদয়ে পাকাপোক্ত ভাবে বসে গেছে।
Total Reply(0)
Ahmed Rakib Ahsan ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:০০ এএম says : 0
বাংলাদেশ যে ফ্রিতে রোড ট্রানজিট ও ফেনী নদীর পানি দেওয়া বন্ধ করা উচিত।
Total Reply(0)
Helal Ahmad ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:০০ এএম says : 0
শুভ কামনা তাদের জন্য। এই আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকারহারা মানুষেরা অধিকার ফিরে পাক।
Total Reply(0)
Rais Uddin ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:০১ এএম says : 0
ভারতীয় উপমহাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকতে চলেছেন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী। দেখা যাক প্রতিবাদীরা কী করতে পারেন।
Total Reply(0)
Golam Safayat ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১:০১ এএম says : 0
আমি গর্বিত উল্লেখিত আন্দোলনের চিত্রে আমিও একজন নগণ্য ভারতীয় হয়ে উপস্তিত রয়েছি। এটা আমাদের স্বাধীনতার লড়াই। সংবিধান বাঁচানোর লড়াই। সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে আমরা ভারতের এক ছিলাম আছি থাকবো। এই কালা আইন যতদিন না প্রত্যাহার হচ্ছে আন্দোলন চলছে চলবে..
Total Reply(0)
mainuddinmolla ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৮:১১ এএম says : 0
কালা আইন বাতিল না হওয়া পযন্ত এই আন্দোলন চোলছে চোলবে।।।।।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন