শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ঘুষ গ্রহণ কয়লা-ক্যাসিনো

ফিরে দেখা ২০১৯ : ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় দুদক

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

সারা বছর সভা-সেমিনার, প্রশিক্ষণ, গণশুনানি এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিরোধে সুপারিশ প্রণয়ন নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে সরকারি সিদ্ধান্তে ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান শুরু হলে সেটি অনুসরণে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে মাঠে নামে দুদকও। ক্যাসিনোকান্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে বছরের শেষ দিকে দুদককে দেখা গেছে ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারের চেষ্টায়। তবে প্রকৃত দুর্নীতিবাজ এবং রাঘব বোয়ালদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখায় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান কিছু বিতর্কেরও জন্ম দেয়।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে আলোচিত ব্যক্তি শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে স্পর্শ না করা, এসপি মিজানের কাছ থেকে দুদক পরিচালকের ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ, ৩৩ মামলায় নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালমের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার পর হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তির ঘটনায় দুদকের ভাবমর্যাদা ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে দুদকের বর্তমান নেতৃত্বের সমালোচনা করে পদ ছেড়ে চলে যাওয়ার দাবি তুলেছেন সরকারদলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ। কমিশনের হৃত এ ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা লক্ষ করা গেছে ২০১৯ সালের শেষ দিকটায়। বিদায়ী বছরে নানা কারণে গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয় দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটি।

বার্ষিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, কমিশনের বর্তমান নেতৃত্ব দুর্নীতি দমনের চেয়ে প্রতিরোধ কার্যক্রমকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। বাড়িয়েছে অভিযান পরিচালনার সংখ্যা। তবে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বিদায়ী বছর অভিযোগ অনুসন্ধান এবং মামলা রুজুর সংখ্যা ছিল বেশি। স্বাস্থ্য খাতে পুকুর চুরির অনুসন্ধান চালায় দুদক। পরে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গায়েব হওয়ার ঘটনায় মামলা করেছে দুদক। এ মামলায় চার্জশিটও দেয়া হয়েছে।

ক্যাসিনোকান্ড, ফরিদপুর পর্দাকান্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, মামলা, তদন্ত কার্যক্রমে প্রশংসা কুড়িয়েছে দুদক। পক্ষান্তরে অনুসন্ধান-তদন্তের নামে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, মধ্যম পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের হয়রানি সমালোচনার জন্ম দেয়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হয়রানির অভিযোগও ওঠে দুদকের বিরুদ্ধে।
সাধারণ মানুষের আস্থা সৃষ্টিতে কাজ করে দুদক। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ‘১০৬’ হটলাইনে শত শত অভিযোগ গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে সারা দেশে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে। দুর্নীতির উৎস বন্ধে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সুপারিশ বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগ দেয়। ফাঁদ পেতে ঘুষখোর ধরাসহ প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

বছরের মাঝামাঝি সময় র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হঠাৎই ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান শুরু করে। অভিযানে যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, ঠিকাদার জি কে শামীমসহ বর্তমান জাতীয় সংসদের চার এমপি, গণপূর্তের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৮৭ জনের তালিকা নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালাচ্ছে দুদক। অবৈধ ক্যাসিনোর মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ‘শুদ্ধি অভিযান’-এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই ১৮টি মামলা করেছে দুদক।

বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল ফরিদপুর হাসপাতালের পর্দাকান্ড ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশকান্ড। ইতোমধ্যে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আলোচিত পর্দাসহ ১৬৬ চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয় দুদক। কক্সবাজার, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা ও রংপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও ওষুধ ক্রয়ে শত শত কোটি টাকা লোপাটে এ পর্যন্ত ৯টি মামলা হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নিচারসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী কেনাকাটায় লুটপাটের ঘটনায় গণপূর্তের ১১ প্রকৌশলী ও ২ ঠিকাদারসহ ১৩ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে।

প্রতারণা, জালিয়াতি, সরকারি সম্পদ আত্মসাতসহ বিভিন্ন দুর্নীতির ঘটনায় তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনায় সক্রিয় ছিল দুদকের ‘এনফোর্সমেন্ট ইউনিট’। রাজধানী থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রায় নিত্যদিনই চলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তাৎক্ষণিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এসব অভিযানে। বিআরটিএ, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ ভবন, পল্লী বিদ্যুৎ, বিমানবন্দর, জেলখানা, সিভিল সার্জন, ওয়াসা, হজ এজেন্সি, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), শিক্ষা ভবন, বিভিন্ন হাসপাতাল, সিএজি, বিএসটিআই, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলেছে কয়েক শ’ অভিযান।

প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সংস্থাটি ৯৮০টি অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় ৭৬ জনকে। অভিযানের পর অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ১০৩টি অনুসন্ধান শুরু হয়। এর মধ্যে ইতোমধ্যে ৬টি মামলা দায়ের হয়। দুদকের ‘১০৬’ হটলাইনের টেলিফোন রিসিভে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বছরটি কেটেছে দারুণ ব্যস্ততায়। টোল ফ্রি এই হটলাইনে এসেছে হাজার হাজার অভিযোগ। গত নভেম্বর পর্যন্ত ৩৩ লাখের বেশি ফোন কলে এসেছে বিভিন্ন অভিযোগ। টেলিফোনে অভিযোগ আসে ৯৬ হাজার ৩১৪টি। যদিও এসব অভিযোগের মধ্য থেকে মাত্র ১০৩টি অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়। ৮২৫টি অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে চিঠি দেয় দুদক।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮ সালের তুলনায় এ বছর অভিযোগ, মামলা ও চার্জশিটের সংখ্যা তুলনামূলক বেড়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ বেড়েছে অন্তত ৯ হাজার ৮৭৬টি। বিদায়ী বছরে ২২ হাজার ১০৩টির মতো অভিযোগ জমা হয়। ২০১৮ সালের একই সময়ে অভিযোগ জমা হয়েছিল ১২ হাজার ২২৭টি।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দুদকে মামলা ও আদালতে চার্জশিট দাখিল হয় যথাক্রমে ৩১৯টি ও ২৯৮টি। যেখানে ২০১৮ সালের মামলা ও চার্জশিট দাখিল হয় ২১৬টি ও ২৩৬টি। মামলা ও চার্জশিট বেড়েছে যথাক্রমে ১০৩টি ও ৬২টি। একইসঙ্গে কমেছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের হার। বিদায়ী বছর এফআরটি দেয়া হয়েছে ৮৪টি। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফাঁদের মাধ্যমে ঘুষসহ গ্রেফতার করা হয় ২২ জনকে।

দুদকের বিধি সংশোধনী হয় ২০১৯ সালে। এর ফলে গত ২৩ জুনের পর থেকে নিজ দপ্তরেই মামলা দায়ের করছে সংস্থাটি। সরাসরি বিশেষ জজ আদালতে চার্জশিট দাখিল এবং ব্যাংক হিসাব ও কর নথি সংগ্রহে বাড়তি ক্ষমতাসহ বেশ কয়েকটি নতুন বিধানে দুদকের কার্যক্রমে গতি আসে। যদিও এই বিধির আওতায় চলমান কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করে ইতোমধ্যেই রিট হয়েছে। পৃথক গোয়েন্দা ইউনিট গঠন, গবেষণা সেল, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট গঠনসহ দুদকের কার্যক্রমের আওতা বাড়াতে ১০৭৩ জন নতুন জনবল নিয়োগ করছে দুদক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন