শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিএনপির ব্যর্থতার বছর

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১০:০৭ পিএম

‘মনিং শো’জ দ্যা ডে’ হলো বিএনপির ভাগ্যলিপি। ২০১৯ সালে বিএনপির প্রথম দিন শুরু হয়েছিল জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গান ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার/ ও কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা/ ও কি পাখির কূজন নাকি হাহাকার’ এর মতোই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ভোটের বাক্স ভরে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ফলাফল নিশ্চিত করার পর ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতার মুখের দিকে তাকিয়ে দিন পাড় করেছে দলটির নীতি নির্ধারকরা। অতপর দিল্লির সাউথ ব্লক কিছু করে কিনা সেদিকে তাকিয়ে সময় কাটিয়ে দেয় কয়েক দিন। দেশ-বিদেশের মানুষকে অবাক করে ৭ এমপির শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। তারপর থেকে তৃর্ণমূলের নেতারা বেগম জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচির চাপ দিয়েছে; কিন্তু দলটির নীতি নির্ধারকরা নিজেরা কিছু না করে ‘বঙ্গবন্ধুর চশমায়’ রাজনীতি দেখা ড. কামাল হোসেনের মুখাপেক্ষি থেকেই বছর পাড় করে দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে জনসমর্থিত জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলটি এখন কার্যত প্যারালাইজ রোগীর মতোই রুগ্ন হয়ে গেছে। ৩০ ডিসেম্বর রাজপথে পুলিশের বেধড়ক পিটুনির মধ্যেও বামদলগুলো ‘কালো দিবস’ পালন করেছে; অথচ কর্মসূচি দিয়ে তা বাতিল করেছে বিএনপি। তবে তৃর্ণমূলের শক্তি দলটির বড় অর্জন। হাজার হাজার মামলার মুখে দলটি দ্বিখ-িত করার চেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়েছে। নানান কৌশল, ফর্মূলা এবং কখনো লোভ ও কখনো ভয়ভীতি দেখিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মাইন্যাস করার চেস্টা রুখে দিয়েছেন দলের নেতারা। এর মধ্য দিয়ে কারাবন্দি বেগম জিয়া ও তরুণ নেতা তারেক রহমানের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধ্বস পরাজয়ের পর ব্যর্থতা ও হতাশাজনক একটি বছর পার করেছে বিএনপি। দলের নির্বাচিত এমপিদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এবং সংসদে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আবারও যোগদান করা, সংসদে যোগ দিয়ে বিএনপির এমপিদের ফ্ল্যাট, বাড়ি-গাড়ি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত থাকা, বেগম খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্বকে বিতর্কিত করার চেষ্টা, মুক্তি আন্দোলন নিয়ে হম্বি-তাম্বি-ফাঁকা বুলি, সভা-সেমিনার ছাড়া কার্যকর কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থতার কারণেই সিনিয়র নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ মধ্যম সারি ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দেশে দায়িত্বে থাকা সিনিয়র নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, পরষ্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কথা ও কাজের সাথে মিল না থাকায় বছরটি বিএনপির জন্য ব্যর্থতায় ভরা বলে মনে করেন তারা।

সবকিছুতেই মুক্তির অজুহাত: নেতাকর্মীদের অন্ধকারে রেখে বছরজুড়েই একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপি নেতারা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে শুরু করে এমপিদের শপথ গ্রহণ সব কিছুতেই দেখানো হয় খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অজুহাত। সেটিতে সফল না হয়ে মুক্তির জন্য আদালতের দিয়ে তাকিয়ে থাকা এবং প্রতিটি সভা-সমাবেশে কঠোর আন্দোলনের আশ্বাসের ফাঁকা বুলি দিয়েছেন নেতারা।

বিএনপি নেতাকর্মীরা জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ বলেছিলেন বিএনপি নেতারা। নেতাকর্মীরা আশায় বুক বেঁধে ছিলেন বেগম জিয়া মুক্ত হবেন। নির্বাচন শেষে বিএনপির এমপিদের সংসদে যোগ দেয়াকেও আন্দোলনের অংশ বলায় এবারও নেতাকর্মীরা ভেবেছিলেন বেগম জিয়াকে মুক্তির শর্তেই হয়তো এমপিরা শপথ গ্রহণ করছেন। রাজনৈতিক অঙ্গণেও গুঞ্জন ছিল-বিএনপির এমপিরা সংসদে গেলে আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন। কিন্তু এমপিদের শপথের পরেও বেগম জিয়ার মুক্তি না হওয়ায় হতাশ নেতা-কর্মীরা। তবে এজন্য এমপিদেরকেই দায়ী করছেন বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা। তারা বলছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তিতে দলীয় এমপিদের শপথকে সরকারের সাথে দরকষাকষিতে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেগম জিয়ার মুক্তির চেয়ে ব্যক্তিগত ও সরকারি সুযোগ-সুবিধাই এমপিদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। সে কারণে এমপিরা শপথ নিলেও খালেদা জিয়ার আর মুক্তি মেলেনি। এখনো উপ-নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ সবকিছুতেই বলা হচ্ছে মুক্তি আন্দোলনের অংশ।

 

আন্দোলনের ফাঁকা বুলি: ২০১৮ সালের ৮ ফ্রেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে আসছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। মানববন্ধন, প্রতীকী অনশন, লিফলেট বিতরণ, বিভাগীয় সমাবেশ, ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে তাঁর মুক্তির দাবি জানানো হয়। আর সমাবেশগুলোতে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য দ্রুত কঠোর কর্মসূচিসহ নানা বুলি ছেড়েছেন নেতারা। কর্মীরাও বেগম জিয়াকে মুক্ত করার জন্যে জীবন-বাজী রেখে অংশ নিয়েছেন প্রতিটি কর্মসূচিতে। কিন্তু বছরজুড়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির আশায় বুক বেঁধে থাকলেও নেতারা তাদের হতাশা উপহার দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রাজপথের কঠোর কর্মসূচি দিতে বছরজুড়ে বিএনপির হাইকমান্ডের ওপর তৃণমূলের চাপ অব্যাহত থাকলেও সেটিকে পাত্তা না দিয়ে ঝিমুনি কর্মসূচিতেই বছর পার করেছেন তারা। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রকাশ্যে কর্মীদের তীর্যক মন্তব্যের শিকার হতে হয়। আর বছরের শেষদিকে এসে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ হওয়ায় আইনি প্রক্রিয়ায় তার মুক্তির আশা ছেড়েই দিয়েছেন দলটির নীতি-নির্ধারকরা। ফলে কারাগারেই থাকতে হচ্ছে বেগম জিয়াকে। বছরের শেষদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন ইস্যুতে দলের মধ্যে বিভক্তি তীব্র রূপ নেয়। স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সরকারবিরোধী কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দলীয় এমপিদের পদত্যাগের আহ্বান জানান। কিন্তু পরদিনই চট্টগ্রাম-৮ আসনে আবু সুফিয়ানকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি

নির্বাচিতদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা: গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে যায় বিএনপি। নির্বাচনে বিএনপির ছয়টিসহ মোট আটটি আসন পায় ঐক্যফ্রন্ট। কারচুপির অভিযোগ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানায় বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট। একইসঙ্গে সংসদে না যাওয়াসহ এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় তারা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-নির্বাচন এবং ১০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পূর্ণ বর্জন করে বিএনপি। শুধু তাই নয়, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচনী কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হওয়ার দায়ে তৃণমূলের কয়েকশ’ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। এরই মধ্যে দল ও জোটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ৭ মার্চ গণফোরামে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও ২ এপ্রিল মোকাব্বির খান এবং ২৫ এপ্রিল বিএনপির জাহিদুর রহমান শপথ নেন। বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে এই তিন এমপিকে ‘রাজনৈতিক বেঈমান’ আখ্যা দেওয়া হয়। দুইজনকে দল ও জোট থেকে বহিষ্কার করা হয়। একজনকে দেওয়া হয় ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ। এমন প্রেক্ষাপটে ২৯ এপ্রিল এসে ইউটার্ন নেয় বিএনপি। ওইদিন সংসদে গিয়ে শপথ নেন বিএনপির চার এমপি। রাত ৯টায় গুলশান কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শপথ নিয়েছেন বিএনপির এমপিরা। তবে বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত হলেও শপথ নেননি মির্জা ফখরুল। বিএনপি মহাসচিবের ছেড়ে দেওয়া বগুড়া-৬ আসনে উপ-নির্বাচন হয় ২৪ জুন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরেক দফা ইউটার্ন নেয় বিএনপি। জিএম সিরাজকে দেওয়া হয় দলীয় মনোনয়ন। তিনি বিজয়ী হয়ে শপথ গ্রহণ করেন।

শপথ গ্রহণের পর বিএনপির এমপিরা দাবি করেছিলেন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ এবং সংসদে তার মুক্তির দাবি জানাতেই শপথ নিয়েছেন তারা। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর বিএনপির এমপিরা ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি-গাড়ী, সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে ব্যস্ত থাকা আর কোন কাজই করতে পারেনি। উল্টো বিএনপির সংরক্ষিত মহিলা এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা প্লটের জন্য আবেদন করে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন। পরে সমালোচনার মুখে তিনি তার আবেদন প্রত্যাহারও করে নেন। এছাড়া বেগম জিয়ার আপোষহীন নেত্রী হিসেবে নেতাকর্মীসহ সারাদেশের মানুষের মাঝে সমাদৃত হয়ে আসলেও তার সেই আপোষহীন নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপির ৭ এমপি একত্রিত হয়ে অপতৎপরতা চালিয়েছেন। প্যারোলে মুক্তি নিতে না চাইলেও বেগম জিয়াকে রাজী করানোর জন্য দুই দফায় তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তবে এমপিদের এই প্রস্তাবে রাজী হননি বিএনপি প্রধান।

১০ কাঠার প্লট চেয়ে একঘরে রুমিন: আগস্টের শেষ দিকে এমপি হিসেবে ১০ কাঠার প্লট চেয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন বিএনপির সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তাকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হলে তিনি সরকারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকারও অঙ্গীকার করেন আবেদনে। বিষয়টি প্রকাশ হলে দলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। একপর্যায়ে রুমিন তার প্লটের আবেদন প্রত্যাহার করেন। এ ঘটনার পর থেকে প্রায় একঘরে হয়ে পড়েন তিনি।

নেতৃত্ব জিয়া পরিবারের হাতেই: বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই গুঞ্জন ছিল বিএনপির একটি অংশ তাকে মুক্ত করতে চান না। বেগম জিয়াকে জেলে রেখে এবং তারেক রহমানকে বিদেশে রেখে দলের নেতৃত্ব কব্জায় নিয়ে ‘উপভোগ’ করতে চায় এই অংশটির সুবিধাবাদী নেতারা। তারা নিজেদের বলয় গড়ে তুলে, নিজেদের মতো করে বিএনপিকে পরিচালিত করতে চেয়েছেন। আর সেই সন্দেহের ডালপালা ছড়াতে থাকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হাতে প্রদান, নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির পরও পলাশির প্রান্তরে যুদ্ধে মীর জাফরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকায় দৃশ্য দেখে। গণভবনে সংলাপের পর কোনো অর্জন ছাড়াই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ সন্দেহের জন্ম দেয়। কোন শর্ত আদায় না করেই খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে (বিএনপি নেতাদের কথা অনুয়ায়ি) ভাড়াটে নেতার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। সেই নির্বাচনের পর প্রতিটি কাজেই খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের দোহাই দিয়ে তা নেতাকর্মীদের কাছে হালাল করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করেন সিনিয়র কিছু নেতা। নির্বাচনের সময় থেকে শুরু করে এখনো সেই অংশটি বিএনপিতে ভাঙন ও বেগম জিয়া, তারেক রহমান তথা জিয়া পরিবারের নেতৃত্বকে দুর্বল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে আসছেন। তাদেরই একটি অংশ বেগম জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করে তার আপোষহীন নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিদেশে পাঠানোর চক্রান্তও করছেন। স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, দলের সিনিয়র একাধিক নেতা আন্দোলন বিমুখ। তারা চায় না খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন হোক। এই নেতারা সরকারের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রেখেও চলছেন। বিগত নির্বাচনের সময় প্রার্থী মনোনয়নে দলের স্বার্থের চেয়ে ব্যাক্তি স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি জানান, সিনিয়র কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী ও বেঈমানরা বছরজুড়ে ‘আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা’ দেয়ার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। বরং কারাগার থেকেই খালেদা জিয়ার নির্দেশনা এবং লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিটি কমিটি গঠন, স্থানীয় সরকার থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তারেক রহমানের নির্দেশে প্রার্থী চূড়ান্ত করায় নিয়ন্ত্রণ এখনো জিয়া পরিবারের হাতে। নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদলের কমিটি গঠনে তারেক রহমান যে সিদ্ধান্ত দেন তা দলের সর্বমহলে প্রশংসিতত হয়েছে। চরম দুর্দিনে বিগত দিনে বের হয়ে যাওয়া কিছু নেতা দলে ফিরে এসেছেন। মামলা মাথায় নিয়ে জেলা উপজেলা পর্যায়ের নেতারা সক্রিয় হয়েছেন।

শেষ হয়নি দল পুনর্গঠন: ২০১৯ সালের শুরু থেকেই দল পুনর্গঠনের যে প্রক্রিয়া বিএনপি শুরু হরেছিল তা কবে নাগাদ শেষ হবে তা অনিশ্চিত। বছর শেষে ২৫টি আহ্বায়ক কমিটি গঠন এবং মাত্র ৯টি কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেছে। চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), কৃষক দল, মৎসজীবী দল, তাঁতি দল, ইঞ্জিনিয়ারদের সংগঠন অ্যাবসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের আহ্বায়ক কমিটি করে দ্রুততর সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশ থাকলেও ড্যাব ছাড়া কোন সংগঠনটি মানেনি সে নির্দেশনা। বারবার তাগাদা দিয়েও পূর্ণাঙ্গ হয়নি মেয়াদোত্তীর্ণ স্বেচ্ছাসেবক ও যুবদলের কমিটি। জোড়াতালি আর ঢিমেতালে অঙ্গসংগঠনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা। ফলে নির্বাচনের এক বছর পার হতে চললেও দলটিকে আন্দোলনমুখী করা যায়নি।

নির্বাচন নিয়ে ইউটার্ন: জাতীয় নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এজন্য ঢাকা উত্তর সিটির উপ-নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করে দলটি। এরপরও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তৃণমূল নেতাদের গণহারে বহিষ্কার করা হয়। অন্যদিকে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ- এই দ্বি-চারিতা মেনে নিতে পারছিলেন না তৃণমূল নেতারা। এমন প্রেক্ষাপটে ৬ জুলাই স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বিএনপি এখন থেকে সব নির্বাচনে অংশ নেবে। এরপর ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত রংপুর-৩ উপ-নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এ আসনটিতে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন রিটা রহমান। আসন্ন চট্টগ্রাম-৮ উপ-নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে বিএনপি। ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় এই বলে যে, গণতন্ত্র চর্চার ন্যূনতম সুযোগটুকু গ্রহণ করতে চায় বিএনপি। এদিকে সংসদে যোগদান ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বহিষ্কারাদেশও পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি। এছাড়া দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেয়ায় বহিষ্কার হওয়া ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের এমপি জাহিদুর রহমানকে দলে ফিরিয়ে নিয়েছে বিএনপি। গত আগস্টে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

হাইকোর্টের সামনে একঝলক আন্দোলন: বছরের শেষদিকে এসে সভা-সমাবেশ করতে আর পুলিশি অনুমতি না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির হাইকমান্ড। তবে পুলিশকে কর্মসূচির বিষয়টি অবহিত করবে তারা। বিভিন্ন সভা-সেমিনার থেকে দলের এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এর অংশ হিসেবে পুলিশের অনুমতি ছাড়াই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গত নভেম্বরে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে হাইকোর্টের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বিএনপি। কর্মসূচি থেকে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর হয়। বহুদিন পর রাজপথে স্বরূপে দেখা যায় বিএনপিকে। এ ঘটনায় বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে পুলিশের এমন কঠোর মনোভাবের কারণে অবস্থান পরিবর্তন করে বিএনপি

ভারত ইস্যুতে নিরবতা: ভারতে ফেনী নদীর পানি প্রদান, উপকূলীয় এলাকায় পর্যবেক্ষণের জন্য রাডার স্থাপনের অনুমতি, সমুদ্র বন্দর ব্যবহারসহ বেশ কয়েকটি চুক্তি করেছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়, প্রতিবাদ করতে গিয়ে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ খুন হন। তবে এই ইস্যুতে বিএনপি কার্যকর কোন ভূমিকা রাখেনি। এছাড়া সীমান্তে হত্যা, তিস্তার পানি, ট্রানজিট, কাশ্মির ইস্যুতে কোন কথাই বলতে চায়নি দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। আবার মধ্য সারির যারা ভারতপ্রীতির সমালোচনা করেছেন তাদেরকে শুনতে হয়েছে বকা ঝকাও। বিষয়টি নিয়ে অনেকে বিএনপির কাছে ভারতে ভাসুরের (গ্রাম্য প্রবাদ-ভাসুরের নাম মুখে নিতে নেই) স্থানেও বসানোর অভিযোগ করেন। একইভাবে নগারিক পঞ্জি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়েও প্রথম দিকে নিরবতা পালন করে দলটি। তবে যখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিএনপিকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য অভিযুক্ত করে এরপরই দলটি এর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলা শুরু করে।

তারেক রহমানের নির্দেশেও হয়নি যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি: যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে গতিশীল করতে তিন বছর আগে আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির নেতাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটির গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। তিন বছরেও সেই কমিটি করতে না পারায় গত অক্টোবরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০ ও ২৫ অক্টোবরের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের আল্টিমেটাম দেন। কিন্তু সেই সময়সীমা দুই মাস অতিক্রম করলেও এখনো তা করতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

২৮ বছর পর সরাসরি ভোটে ছাত্রদলের নেতা নির্বাচন: প্রায় ২৮ বছর পর সরাসরি ভোটে ছাত্রদলের সভাপতি নির্বাচিত হন ফজলুর রহমান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক হন ইকবাল হোসেন শ্যামল।

ঐক্যফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্য সফল হয়নি মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এটি গঠন করা হয়েছিল তা অর্জিত হয়নি। আর আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের হার্ড লাইনের কারণে বিএনপি কঠোর কর্মসূচিতে যায়নি।

স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি কর্মসূচির মধ্যেই রয়েছে। এখন এক দফার আন্দোলনে যাবে।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিতেই আমরা আন্দোলনের কথা বলছি। কর্মীরা প্রস্তুত হয়ে আছে। কিন্তু আমরা নেতারা রাজপথে নামছি না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
** হতদরিদ্র দিনমজুর কহে ** ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৭:৫৭ এএম says : 0
২০১৯বিদয় বেলা কাদিঁও না আর,বাজাইওনা করুন সুর।যত ই মুছবে আখিঁ,ব্যাথাতো হবেনা দুর।। হাসি দিয়ে লুকাও তোমার জীবনের সকল বেদনা,আজ ও তবে হেসে যাও,বিদয় বেলা কেদঁনা।।সকল ব্যার্থতা থেকে শিক্খা গ্রহন করা উচিৎ।।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন