পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনকে বরণ করাই প্রকৃতি আর মানুষের চিরন্তন বাস্তবতা। পুরনো বছরের দুঃখ, কষ্ট, জীর্ণতার কুয়াশা সরিয়েই আসে নতুন দিনের নতুন বছরের সূর্য। নতুনের আবাহনে নেচে উঠে সবার হৃদয়-মন। নশ্বর এই পৃথিবীতে মানুষের জীবন সত্যিই অতি অল্প সময়ের। সংক্ষিপ্ত এই সময়ের ভেতরেও সৃষ্টিশীলতা এবং মানবতার কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে মানুষ অবিনশ্বর হতে পারে। পুরাতন বছর শেষে নতুন বছরের আগমন ঘটবে এটাই তো প্রকৃতি ও সৃষ্টির অপার লীলা। লীলাময় এই পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত সময়কে তবুও মানুষ দিন, মাস, বছরের কালিক সীমায় চিহ্নিত করতে চায়। নতুন বছরকে বরণ করতে চায়। শুধু চায়ই না, বর্ষ বরণের জন্য উদগ্রীব অপেক্ষায় থাকে তারা।
বর্ষ বরণের প্রাচীনতা ঐতিহ্যময়। আনুমানিক ৪০০০ বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ খ্রিস্টাব্দে মেসোপটেমীয় সভ্যতার বর্তমান ইরাকে, প্রথম বর্ষবরণ উৎসব চালু হয়েছিল। মেসোপটেমীয় সভ্যতার চারটি ভাগ রয়েছে, সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, আসিরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। বর্ষবরণ উৎসব প্রথম চালু করেন ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মানুষ। ব্যাপক জাঁকজমক আর আনন্দ উৎসবের সাথেই তারা পালন করতো নববর্ষ। তবে জানুয়ারির ১ তারিখে এটি পালন করা হতো না। তখন নববর্ষ পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে। বসন্তে প্রকৃতির নতুনরূপে জেগে উঠাকেই বছরের প্রথম দিন হিসেবে চিহ্নিত করতো তারা। চাঁদ দেখেই তারা তখন বর্ষ গণনা করতেন। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠতো, সেদিন থেকে উৎসব চলতো টানা ১১ দিন।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমকের সাথে নববর্ষ পালন শুরু করে রোমানরা। রোমের প্রথম সম্রাট রোমুলাস ৭৩৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রোমান ক্যালেন্ডার চালু করেন। রোমান ক্যালেন্ডার মতে নববর্ষ হতো ১ মার্চ। মাস ছিলো ১২টির পরিবর্তে ১০টি। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। রোমানদের প্রথম ক্যালেন্ডারের তারিখ ছিলো না। চাঁদের বৃদ্ধির ছবি দেখে তারা সময় চিহ্নিত করতো। চাঁদ ওঠার সময়কে বলা হতো ক্যালেন্ডস, পূর্ণ চাঁদকে ইডেস এবং অর্ধ চন্দ্রকে নুনেস। জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন করেন। তিনিই প্রথম ক্যালেন্ডস, ইডেস ও নুনেসের জায়গায় তারিখ নির্ধারণ করেন। ফলে বছরে মোট দিন হয় ৩৫৫। যেহেতু চাঁদের হিসাবে মাস গণনা করা হয়, ফলে মাস ২৯ দিনে দাঁড়ায়। ফলে বছরে ১০ দিন কম থেকে যায়। চাষিরা তাতে সমস্যায় পড়ে। তখন জুলিয়াস সিজার চাঁদের হিসাব না করে সূর্য দিয়ে হিসাব করে ৩৬৫ দিনে বছর নির্ধারণ করেন। জুলিয়াস সিজার মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ মোসাজিনিসকে ক্যালেন্ডার সংস্কারের নির্দেশ দেন। মোসাজিনিস প্রথম দেখতে পান পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। তখন তিনি উদ্ভাবন করেন যে, ৩৬৫ দিনে বছর হিসাব করলে এবং প্রতি চতুর্থ বছরে ৩৬৬ দিনে বছর হিসাব করলে আর কোনো সমস্যা হয় না। মোসাজিনিস অতিরিক্ত একদিন যুক্ত করে বছরটির নাম দেন লিপইয়ার। সম্রাট জুলিয়াস সিজারই প্রথম ৩৬৫ দিনে বছর এবং ১ জানুয়ারি নববর্ষ চালু করেন।
জুলিয়াস সিজার নির্ধারিত ক্যালেন্ডারেও কিছু সমস্যা ছিলো। এই সমস্যার সমাধানকল্পে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণের পরামর্শ নিয়ে ক্যালেন্ডারটির সংস্কার করেন। অবশেষে তার নামানুসারে ক্যালেন্ডারটির নামকরণ হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। তখন থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসেবে পালন হয়ে আসছে।
গ্রেট ব্রিটেনে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রচলিত হয় ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে। উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করে। যেহেতু ইংরেজরা আমাদের দেশে এই ক্যালেন্ডার চালু করে, তাই একে ইংরেজি ক্যালেন্ডার নামেও অভিহিত করা হয়। তাই আমরা দেখি, যেহেতু প্রাচীন রোমানদের হাতে এই ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি সেহেতু ইংরেজি বছরের বারটি মাসের নামও হয় রোমান দেবতা আর সম্রাটের নামানুসারে। যেমন: জানুয়ারি-রোমান দেবতা জানোস এর নামানুসারে। ফেব্রুয়ারি-ল্যাটিন শব্দ ফেব্রুয়া থেকে নেয়া, যার অর্থ পবিত্র। মার্চ-রোমান যুদ্ধ দেবতা মার্সের নামানুসারে। এপ্রিল-ল্যাটিন শব্দ এপ্রিলিস থেকে, যার অর্থ খোলা। মে-বসন্তের দেবী মায়াস এর নামানুসারে। জুলাই-রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে। আগস্ট-জুলিয়াস সিজারের পুত্র অগাস্টাস সিজারের নামানুসারে। সেপ্টেম্বর-রোমান সপ্তম সংখ্যা সেপ্টেম হতে। অক্টোবর-ল্যাটিন অষ্টম সংখ্যা অক্টো হতে। নভেম্বর-ল্যাটিন নবম সংখ্যা নভেম হতে। ডিসেম্বর-ল্যাটিন দশম সংখ্যা ডিসেম হতে নেয়া।
কালের গর্ভে হারিয়ে যায় প্রতিটা দিন, মাস, বছর। সেই সাথে দেয়ালে টানানো পুরাতন ক্যালেন্ডারকে হটিয়ে জায়গা করে নেয় নতুন বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪০ প্রকার ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু অদ্ভুদ ক্যালেন্ডার ও চালু আছে। যেমন: উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইথিওপিয়ার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছর পূর্ণ হয় ১৩ মাসে। মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া বা কপটিক ক্যালেন্ডারের মতো তাদের ক্যালেন্ডারের প্রতিটি মাস ৩০ দিনের হওয়ায়, বছরের ৫ বা ৬ দিন অতিরিক্ত থেকে যায়। আর সেখান থেকেই আসে ১৩তম মাসটি। ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বিপ্লবের আগ পর্যন্ত রাশিয়াতে নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণযোগ্য ছিলো না। এ কারণে ১৯০৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে রাশিয়ান দল ১২ দিন দেরীতে পৌঁছায়। আবার, ১৭৫২ সালে যখন ব্রিটেনে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করা হয় তখন জনসাধারণ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছিলো বছর থেকে ১১ দিন হারানোর কারণে।
বিশ্বজুড়ে জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করা হয়। থার্টি ফার্স্ট নাইটে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে মেতে উঠে সবাই। নববর্ষ উদযাপনের চোখ ধাধানো আয়োজন হয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অপেরা হাউজ, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ, ফ্রান্সের প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, চীনের হংকং, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে। আতসবাজি, বাহারি আলোর ঝলক, স্ট্রিট ড্যান্স, কনসার্টের মাধ্যমে উদযাপন করা হয় নববর্ষকে।
একটাই পৃথিবী, আর একটাই মানব জীবন। ছোট্ট এই জীবনে স্মৃতি এবং ভালোবাসার গভীরতা ব্যাপক। কেবল মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে আমাদের এই সংক্ষিপ্ত জীবন সার্থক হতে পারে। আজকে দেশে দেশে ধর্মের নামে মানুষকে বিভাজনের যে রাজনীতি শুরু করেছে কতিপয় স্বৈরাচারী শাসক, ক্ষমতার মোহে যেভাবে অন্ধ হয়ে আছে গুটিকয় অমানুষ শোষকের দল তাদের হাত থেকে মুক্তিপাক গণতন্ত্র ও মানবতা। বিভাজনের রাজনীতির ধ্বংসের উপর বেড়ে ওঠুক মানবতা ও সাম্যের নতুন পৃথিবী। নতুন বছর সবার জন্য শুভ হোক, শুভ হোক আগামীর সোনালী সূর্যোদয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন