বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মুসলিম দেশগুলোর অভিন্ন মুদ্রা চালু করতে হবে

মো. মাছউদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৩ এএম

বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই একটি নতুন বিন্যাসের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাণিজ্য সুরক্ষা ও সম্প্রসারণের নানা কৌশল দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন মেতে উঠেছে বাণিজ্যযুদ্ধে, অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী বহুপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর পুনর্বিন্যাস হতে দেখা যাচ্ছে। বড় শক্তিগুলোর এই লড়াই ও পুনর্বিন্যাসের মধ্যেই আর্জেন্টিনা ও তুরস্কের মতো দেশগুলো যাচ্ছে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে।

বিশ্বের বড় অর্থনীতির ১০ টি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এশিয়ার তিন ও ইউরোপের চার দেশ এ তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য নিয়ে এসব দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ওপর ভিত্তি করে এ তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদন মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ১৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব অর্থনীতির ২৪ দশমিক তিন শতাংশ অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশটি। দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। দেশটির জিডিপির আকার ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্ব অর্থনীতির ১৪ দশমিক আট শতাংশ দেশটির দখলে। আর ৫ দশমিক চার ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি নিয়ে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান। বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ছয় শতাংশ দেশটির দখলে। তালিকায় পরবর্তী তিনটি বড় অর্থনীতির দেশ ইউরোপের। এর মধ্যে জার্মানির অবস্থান চতুর্থ। দেশটির জিডিপির আকার ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এর পরে তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে থাকা বৃটেনের জিডিপি ২দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা ফ্রান্সের জিডিপি ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তালিকায় ভারতের অবস্থান সপ্তম। দেশটির জিডিপির আকার ২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার। আর অষ্টম অবস্থানে থাকা ইতালির জিডিপি ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে নবম অবস্থানে ব্রাজিল ও ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে তালিকায় দশম অবস্থানে রয়েছে কানাডা। তালিকায় তিন থেকে দশ নম্বরে থাকা দেশগুলোর একত্রে জিডিপির চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি বড়।

মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধই এর অন্যতম কারণ। দেশ দুটি একে অন্যকে ঘায়েল করতে শুল্ক আরোপের পন্থা নিয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৮ বার সুদহার বাড়িয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। ফলে বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। চীনের মুদ্রা ইউয়ানের মূল্য অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ৯ শতাংশ কমেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মুদ্রানীতি শিথিল করেছে চীন। তবে এরপরও যদি চীনের মুদ্রার দাম পড়ে যায়, তাহলে এশিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলো চীন। তাই যদি চীনের মুদ্রার মান কমে, তাহলে তা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মুদ্রার ওপর চাপ ফেলে। এতে ওই সব দেশের পণ্য চীনা পণ্যের চেয়ে দামি হয়ে পড়ে। আর এটাই ঝুঁকির বিষয়।

কারণটা হলো, ২০১৮ সালের শেষ দিকে এসে বিশ্ব অর্থনীতি যেন হঠাৎ করেই উল্টো বাঁক নিয়েছে। সারা বিশ্বের সব কটি শেয়ারবাজার দ্বিতীয়বারের মতো বড় ধরণের বিপর্যয় দেখেছে। ধীর প্রবৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর মুদ্রানীতিকে এর কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মুদ্রানীতিতে বারবার সুদের হার বাড়ানোর কারণে বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে শক্তিশালী হচ্ছে মার্কিন ডলার। এর প্রভাবে অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিতে একটা বড় চাপ পড়ছে। যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ডলারের ঋণ বেশি, তাদের ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে আসলে ঝুঁকিতে রয়েছে কারা? বিভিন্ন বিশ্লেষণে তুরস্ক ও আর্জেন্টিনার কথা বলা হচ্ছে। তুরস্কের মুদ্রার দাম কমেছে ব্যাপক। স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। অন্যদিকে ৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে আর্জেন্টিনা। ঝুঁকিপূর্ণ দেশের কাতারে প্রথমেই রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। আইএমএফ মনে করছে, কেবল ইউরোপ বা লাতিন দেশ নয়, ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে এশিয়ার দেশগুলোও। বিশেষ করে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো। সম্প্রতি এই দুটি দেশের মুদ্রার মান কমেছে রেকর্ড পরিমাণ। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে দুর্বলতা থাকলেও বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ওই সব দেশ, যারা ইতিমধ্যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বিশ্বের শক্তিগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বাজার ও প্রভাববলয় বৃদ্ধির নতুন সমীকরণ শুরু হয়েছে, যা বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব ও সংকট মোকাবিলায় বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। বাণিজ্যের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে চলমান এ দ্বন্দ্বের রাশ বিশ্বনেতারা টেনে ধরতে না পারলে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রা রুপি ও ইউয়ানে বাণিজ্যিক লেনদেন করতে রাজি হয়েছে পাকিস্তান ও চীন। জং পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বেইজিং সফরকালে দুই দেশ পাকিস্তানি রুপি ও চীনা ইউয়ানে ব্যবসা করতে রাজি হয়েছে। এর আগে বাণিজ্যিক লেনদেনে ডলার ব্যবহার করতো দুই দেশ। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেব তৈয়ব এরদোগান ডলারের আধিপত্য খর্ব করার আন্দোলন শুরু করেন। তুর্কি প্রেসিডেন্টের উদ্যোগকে সমর্থন দেয় রাশিয়া। ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে চীন, রাশিয়া ও তুরস্ক লড়ছে। এই তিন পক্ষের সঙ্গে এবার যোগ দিলো রাশিয়া। ভারতও সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে রুপি-রুবলে লেনদেনের ঘোষণা দিয়েছে। ইউরোপও ডলারের আধিপত্য বিলোপ করতে চায়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের চীন সফরের বড় সাফল্যের একটি হলো দুই সর্ব মওসুমের বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করার চুক্তি বাস্তবায়নের ঘোষণা। চীন ও পাকিস্তানের এই চুক্তির ফলে পাকিস্তানে ডলারের দাম কমে যাবে। বর্তমানে ১৫০ পাকিস্তানি রুপির বিনিময়ে এক ডলার পাওয়া যায়।

মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে চীন তার প্রত্যাশিত পেট্রো-ইউয়ান মুদ্রার প্রচলন শুরু করেছে। চীন বর্তমান বিশ্বে তেলের বৃহত্তম ভোক্তা। ইউয়ান এখন মার্কিন ডলারের অবমূল্যায়নকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। চীন সৌদি আরবকে পেট্রোডলারের লেনদেন থেকে সরে আসতে উদ্বুদ্ধ করবে। এর পরিবর্তে পেট্রো-ইউয়ানে তেলের ট্রেডিং শুরু করতে চায়। গেল ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন পেট্রো-ইউয়ানের পক্ষে অবস্থান নেন। ব্রিকস কয়েক বছর ধরে আলোচনা করছে সীমিতসংখ্যক রিজার্ভ মুদ্রার আধিপত্য বিস্তার কীভাবে রোধ করা যায়। এ সুযোগে যদি সৌদি আরব, কুয়েত, ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ মুসলিম দেশগুলো ইসলামী মুদ্রা বা ভিন্ন মুদ্রা চালু করে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে যাবে। তবে নিজেদের মধ্যে ঐক্য সংহতি ও শক্তির সূচনা হবে, যেটি হবে আগামী প্রজন্মের জন্য মাইলফলক।

রাশিয়া ও তুরস্ক এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে, ডলারের বদলে তারা নিজ নিজ মুদ্রাতে বাণিজ্য চালাতে আগ্রহী। যদি এ দুই দেশ অন্যদেরও এ ব্যাপারে রাজি করাতে পারে, তাহলে ডলারের আধিপত্য স্পষ্টতই অনেক কমে আসবে। তবে যতদিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত আস্থায় থাকবে, ততদিন ডলার সবচেয়ে শক্তিশালী থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অস্ট্রেলিয়ান ডলারও ইউয়ানের সঙ্গে বিনিময় করা যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে চীন তার নিজস্ব মুদ্রাকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চীনের লক্ষ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে নিজেদের ইউয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করা। ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করছে এমন ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান এখন মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ইউরো মুদ্রায় লেনদেন করার উদ্যোগ নিয়েছে। ডলারে লেনদেন থেকে সরে আসার পদক্ষেপ এটাই প্রথম নয়। আরও বেশ কয়েকটি দেশ মার্কিন ডলারে আন্তর্জাতিক লেনদেন থেকে সরে আসার কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।

সম্প্রতি দৈনিক ইনকিলাবসহ অন্যান্য জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে জানা যায়, ইরানের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে অভিন্ন এক মুদ্রা ব্যবহারের ইরানি প্রস্তাবে রাজি হয়েছে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। ইরানের বার্তা সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি কুয়ালালামপুর শীর্ষ সম্মেলনে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর অভিন্ন ডিজিটাল বাজার গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তাতে সমর্থন দিয়েছেন। মাহাথির বলেছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শিকার দেশগুলো ডলার ব্যবহার করলে তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে; তাই আমরা এক্ষেত্রে নিজস্ব মুদ্রা বা অভিন্ন মুদ্রা ব্যবহার করতে পারি। ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে মালয়েশিয়া মুসলিম এই দেশটির বিশাল বাজারে শরিক হতে পারছে না বলে মাহাথির সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সাথে এক বৈঠকে মাহাথির বলেছেন, মার্কিন চাপের মোকাবেলায় ইরানের সরকার ও জনগণের প্রতিরোধ মালয়েশিয়ার উপর প্রভাব ফেলেছে। এখন সময় আসছে সা¤্রাজ্যবাদী অর্থনীতি রুখতে আমাদেরকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে আগ্রামী প্রজন্ম আমাদেরকে অপরাধীর কাঠগরায় দাঁড় করাবে।

লেখক: সেক্রেটারী, সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড কমিউনিটি ডেভেলোপমেন্ট (সিআরসিডি)

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন