পরিচয়ঃ হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) ১ রমজান ৪৭১ হিজরীতে ইরানের অন্তর্গত জিলান জেলার কাসপিয়ান সমূদ্র উপকূলের নাইদ নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। পিতার নাম হযরত আবু সালেহ মূছা জঙ্গী (রা) ও মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতিমা (রা)। ১১ রবিউস সানী ৫৬১ হিজরী রোজ সোমবার ইহকাল ত্যাগ করেন। ইরাকের বাগদাদ শহরে মাজার শরীফ রয়েছে। তিনি বড় পীর হিসেবে পরিচিত।
বাল্যকালঃ হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) বাল্যশিক্ষা মক্তবে শুরু হয়। প্রথম দিন মক্তবে গিয়ে দেখেন, অন্যান্য ছাত্রদের ভীড়ে বসার কোনো জায়গা নেই। হঠাৎ করে উপর থেকে গায়েবী আওয়াজ আসল, হে মক্তবের ছাত্ররা! আল্লাহর অলিকে তোমরা বসার স্থান করে দাও। অতঃপর মক্তবের ছাত্ররা চেপে বসল। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) এর বসার স্থান হয়ে গেল। মক্তবে প্রথম সবক নিতে গিয়ে অবাক করা কান্ড ঘটল ! হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) কে মক্তবের শিক্ষক যখন আউযু বিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ সবক দান করলেন। শিক্ষক কিছু বুঝে উঠার আগেই বালক হযরত আবদুল কাদের কাদের জিলানী (রা) কোরআন মাজীদের আঠারো পাড়া পর্যন্ত মুখস্ত বলে ফেললেন। এ দৃশ্য অবলোকন করে মক্তবের শিক্ষক আশ্চার্য্য হয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হে বালক! তুমি কিভাবে কোরআন মূখস্ত করেছো! আজ মক্তবে তোমার প্রথম দিন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) বলেন, আমি যখন মায়ের গর্ভে ছিলাম। আমার মা প্রতিদিন কোরআন পাঠ করতেন। মায়ের তোলোয়াত শুনে শুনে আঠারো পাড়া পর্যন্ত আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো।
ভ‚মিষ্ট হয়ে রোজা পালনঃ ২৯ শাবান। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় জিলানবাসীদের কেউ রমজানের চাঁদ দেখতে পায়নি। সকলে রোজা রাখা না রাখার বিষয়ে সংশয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। এমতবস্থায় রাতের শেষাংশে সুবহে সাদেকের পূর্বে ১ রমজান এ পৃথিবীতে শুভাগমণ করেন যূগের শ্রেষ্ট শিশু হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা)। জন্মের পর পর অবাক কান্ড ঘটিয়ে সকলের মধ্যে বিষ্ময় সৃষ্টি করে দিলেন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) ভ‚মিষ্ট হওয়ার পর পর সুবহে সাদেকের আগ মূহুর্ত পর্যন্ত মায়ের দুধ ও মধু পান করেন। সুবহে সাদেকের পর তাকে আর কিছু খাওয়ানো যায়নি। এ আশ্চার্যজনক খবর চারদিক ছড়িয়ে পড়লে সকলে বুঝতে পারেন মাহে রমজান শুরু হয়েছে।
ইলম ও ওয়াজ নসিহতঃ ৫২১ হিজরীর ১৬ শাওয়াল রোজ মঙ্গলবার হযরত রাসূল (সা) স্বপ্নযোগে বলেন, হে আবদুল কাদির! তুমি মানুষকে কেন আল্লাহর পথে আহবান করছো না। তুমি মানুষকে কেনো বঞ্চিত করছো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা) আমি তো কিছুই জানিনা। যদি ইরাকের লোকজন আমাকে তিরস্কার করে। তাৎক্ষনিক হযরত রাসূল (সা) বললেন, হে আবদুল কাদির তুমি মূখ খোল। হযরত রাসূল (সা) কিছু একটা পড়ে ছয় বার হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) এর মুখের মধ্যে ফুঁক দিলেন এবং হযরত রাসূল (সা) এর মূখের লালা আবদুল কাদের জিলানী (রা) মূখে লাগিয়ে দিলেন। অতঃপর হযরত রাসূল (সা) বললেন, মানুষকে হিকমত এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তোমার প্রভূর পথে মানুষকে আহŸান করো। (সূরা নাহলঃ ১২৫)। এ ঘটনার পর থেকে হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) মাহফিলের এমন তাসির হতো, প্রত্যেক মাহফিলে ২/৩ জন লোক প্রভূর ইশকে ফানা হয়ে মৃত্যুবরণ করতো।
সত্যবাদিতাঃ তৎকালিন সময়ে ইরাক ব্যাতিত ভালো পড়াশুনা ও ব্যাবসার সুযোগ ছিলো না। বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ পড়াশুনা ও ব্যাবসার জন্য ইরাকের বাগদাদ শহরে আসতো। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) পড়াশুনার উদ্দেশ্যে ব্যাবসায়িক কাফেলার সাথে বাগদাদ যাওয়ার পথে ডাকাত দলের কবলে পড়েন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) কে ডাকাত দলের সর্দার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সাথে কি আছে? তিনি বললেন, আমার নিকট ৪০টি স্বর্ণ মূদ্রা আছে। ডাকাত দলের সর্দার আশ্চার্যন্বিত হয়ে পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, হে যুবক! তুমি তো মিথ্যা কথা বলে আমার নিকট থেকে স্বর্ণ মুদ্রা লুকাতে পারতে। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) বললেন, আমার মা মিথ্যা কথা বলতে নিষেধ করেছেন। এ কথা শুনে ডাকাত দলের সর্দার বললেন, মায়ের আদেশ তুমি এভাবে পালন কর। নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহর আদেশ আরো যতেœর সাথে পালন করো। এ কথা বলে ডাকাত সর্দার আপসোস করতে থাকেন। হে বালক ! তুমি সাধারণ কোনো মানুষ না। হে বালক হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা)! তুমি আমাকে কলেমা পড়াও। ডাকাত দলের সর্দারের সাথে আরো ৬০ জন অশ্বারোহী ডাকাত ছিলেন। তারাও সঙ্গে সঙ্গে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলো।
নামাজ আদায়ঃ হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) একাধারে ৪০ বছর পর্যন্ত ইশার নামাজের অযু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। যৌবনের অধিকাংশ সময় নামাজের পাশাপাশি রোজা রেখে কাটিয়েছেন। নফল নামাজে সুরা ফাতেহার সাথে সূরা আর রহমান, সূরা মুজাম্মিল কিম্বা সুরা ইখলাস মিলিয়ে পড়তেন। যখনই চোখে ঘুম আসতো, তখন দেখে দেখে কোরআন তেলোয়াত করতেন।
তরিকার সাথে সম্পৃক্ততা: হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মানুষকে আল্লাহ ও রাসূল (সা) এর নির্দেশিত পথে দাওয়াত দিয়েছেন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) এর ইন্তেকালের পর, ভক্ত ও অনুসারীরা তাঁর আমল ও চরিত্রকে সমুন্নত রাখার লক্ষে কাদেরীয়া তরিকার সূচনা করেন। সে সময় থেকে কাদেরীয়া তরিকার প্রচলন শুরু হয়েছে।
গাউসূল আজম লকবঃ প্রত্যেক জামানায় ৩১৩ জন অলি আউলিয়া জমিনে বিদ্যমান থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) এর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ করে থাকেন। সূফি তত্তে¡র পরিভাষায় তাদেরকে আখইয়ার বলা হয়। ৩১৩ জন অলির মধ্যে ৪০ জন আবদাল, ৭ জনকে আবরার, ৫ জনকে আওতাদ, ৩ জন নকীব, ৪ জন নুজবা ও ১ জন গাউসূল আজম থাকেন। গাউসগণের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত তাকে গাউসূল আজম বলা হয়। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) গাউসূল আজম হিসেবে সূফি মহলে স্বীকৃত।
বেলায়েতের ব্যাপকতাঃ হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) রূহানী নির্দেশে সারা জাহানে দ্বীনের খেদমতে ৩৪২ জন আউলিয়া নিয়োজিত থাকেন। এরমধ্যে মক্কা-মদিনাতে ১৭ জন, ইরাকে ৬০জন, সিরিয়াতে ৩০ জন, মিশরে ২০ জন, পশ্চিমাদেশে ২৭ জন, পূর্বদেশীয় অঞ্চলে ২৩ জন, আবিসিনিয়াতে ১১ জন, ইয়াজুজ মাজুজের প্রাচীরাংশে ১৭ জন, লংকাতে ১৭ জন, কুহেকাফে ৪০ বাহরে মুহীতে ৪০ জন।
উপাধি সমূহ: হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) এর উপাধি সমূহ বিশ্বব্যাপী পরিচিত ও স্বীকৃত। আদর্শিক জীবন ও কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন লকব বা উপাধীতে ভূষিত হয়েছেন। যেমন- গাউসূল আজম, বড় পীর, মাহবুবে সোবহানী, গাউসে সামদানী, মহিউস সুন্নাহ, কুতুবে রাব্বানী, ইমামুল আউলিয়া, সৈয়দ, পীর, মীর, মহিউদ্দিন, কামিউল বিদায়াত, নূরে হক্কানী, পীরানে পীর, জিলানী, দস্তগীর ইত্যাদি।
শেষ কথা: প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় ১১ রবিউস সানি ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম পালিত হয়। এছাড়া প্রত্যেক চন্দ্র মাসের ১১ তারিখ কাদেরীয়া তরিকার অনুসারী ভক্ত আশেকগণ হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) এর ওফাতের তারিখে গেয়ারভী শরীফ পালন করেন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) আদর্শিক জীবনধারা থেকে শিক্ষা নেয়ার মতো অনেক কিছু রয়েছে। তাঁর জীবনের সামান্য অংশ যদি আমরা ব্যাক্তি জীবনে পালন করতে সক্ষম হই। তাহলে আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) সন্তোষ্টি অর্জন করতে পারবো। আল্লাহ আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে মহান আউলিয়া হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা) এর জীবনাদর্শ মেনে চলার তৌফিক দান করুক। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন