শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

নেপথ্য কারণ উদ্ঘাটনে কমিশন গঠনের সুপারিশ

পিলখানা হত্যাকান্ডের হাইকোর্টের রায় প্রকাশ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রæয়ারি তৎকালিন বিডিআর পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকান্ডের ‘নেপথ কারণ’ উদঘাটন করে জাতির সামনে প্রকাশের সুপারিশ করেছেন হাইকোর্ট। প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের মুখোশ উন্মোচনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি এ সুপাশি করা হয়। গতকাল বুধবার আলোচিত ‘পিলখানা হত্যাকান্ড’র হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয। প্রকাশিত রায়ে এ সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়। রায়ে সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নবগঠিত সরকারের জন্য বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবেও দেখানো হয়েছে। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী ও সশস্ত্র বাহিনীরও প্রশংসা করা হয়।

পিলখানা হত্যা মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠা এ পূর্ণাঙ্গ রায় ( ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর) প্রকাশ করেন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ হাইকোর্ট বেঞ্চ। অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার। রায়ে এক বিচারপতি ‘জনস্বার্থে সরকারকে আইনানুগভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তদন্ত কমিশন গঠন এবং কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ রায়কে দেশের বিচার বিভাগীয় ইতিহাসের সর্ববৃহৎ রায় হিসেবে গণ্য করা হয়। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসামির ফাঁসির আদেশ এসেছে এ মামলার রায়ে।

রায়ে উল্লেখ করা হয়, ‘৫৭ সেনা অফিসারসহ ৭৪ ব্যক্তির হত্যাকান্ড কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়’। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্ত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিবেচনায় পিলখানা হত্যা মামলাটি রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফৌজদারি মামলা। প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধান সম্মতভাবে আইনের শাসন সমুন্নত রাখা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় এ মামলায় দেয়া রায়কে প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ভবিষ্যতের জন্য একটি নির্মোহ দৃষ্টান্ত হিসেবে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।

১১ দফা নির্দেশনা : রায়ে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে, ১. (ক) বাংলাদেশ রাইফেলসের নিরাপত্তাবিষয়ক ইউনিট জঝট বিজিবির মেধাবি, সৎ ও চৌকস সদস্যের সমন্বয়ে নুতনভাবে ঢেলে সাজানো। ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে দায়িত্বে অবহেলার জন্য ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। (খ) ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ রাইফেলসের মহাপরিচালকের দরবারে সশস্ত্র আক্রমণ এবং পিলখানায় মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনার পূর্বাভাস সংগ্রহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাসহ দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। ২. (ক) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৪/০২/২০০৯ তারিখে পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলসের কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেছেন, অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা বাহিনী ও নিরাপত্তাকর্মীদের বাহ্যিক তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও ভেতরে অন্ত:সার শূন্যতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এ বিষযে সংশ্লিষ্টদের অধিকতর সতর্ক করা।

(খ) বিডিআরে তীব্র অসন্তোষ এবং প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাসহ কমান্ডিং অফিসারদের নজরে আসা সত্তে¡ও তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ না নিয়ে না নিয়ে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ভবিষ্যতের জন্য সংশ্লিষ্টদের মনোযোগী ও সতর্ক হওয়া। ৩. (ক) মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মেধাবী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দক্ষ, ত্বরিৎ ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী, উপযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিজিবির মহাপরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাকে প্রেষণে নিয়োগের কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া। (খ) বিজিবির অফিসারসহ সব পদের সদস্যদের মানবিক গুণাবলি, দায়িত্ব কর্তব্য, বিভাগীয় আইন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কিত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ। ৪. (ক) সামরিক/বেসামরিক সব শ্রেণির কর্মকর্তাদের ব্রিটিশ আমলের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে সবাইকে সেবার মানসিকতা নিয়ে দেশপ্রেমের সঙ্গে কাজ করার প্রশিক্ষণ দেয়া। (খ) ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রামে পেশা, পদবি, সামাজিক পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সংবিধানে উল্লিখিত মূলনীতি অনুসরণ করে সবার প্রতি মানবিক আচরণ ও সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতায় বাহিনীকে গড়ে তোলার নির্দেশনা রয়েছে।

রায় প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আজ রায়টা সই করে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রচার করা হয়েছে। তিনজন বিচারপতি ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। কিন্তু তিনজনেই আলাদা আলাদা রায় দিয়েছেন।’
পিলখানার ওই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ১৫২ বিডিআর সদস্যকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় দেন বিচারিক আদালত। ওই রায়ের ডেথ রেফারেন্স এবং আপিলের ওপর হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন।

এটর্নি জেনারেল জানান, রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনজন মারা গেছেন। যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে ১৮৫ জনকে। এর ভেতরে একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। ১৩ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে ২ জনকে। ১৫৭ জনকে ১০ বছর কারাদন্ড, এর মধ্যে ২ জন ইন্তেকাল করেছেন।১৩ জনকে ৭ বছর, ১৪ জনকে৩ বছর এবং ১ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে দুজনকে। মোট ৫৫২ জনকে সাজা এবং ২৮৩ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে রায়ে। কারাবন্দী অবস্থায় ইন্তেকাল করেছন ১৪ জন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্টের রায়ে যারা খালাস পেয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে আপিল করবো। ফৌজদারি মামলা একমাসের মধ্যে আপিল করার সুযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, রায়ে প্রখ্যাত দার্শনিক, আইনবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানী, দন্ডবিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের গবেষণায় অপরাধী, অপরাধের ধরণ ও কারণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে প্রদত্ত মতবাদ বিশ্লেষণ রয়েছে। তিন বিচারপতির সমন্বিত বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর পর পর দুদিনে এ রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্ট রায়ে ১৩৯ জন আসামিকে মৃত্যুদন্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ২০০ জনকে বিভিন্ন মমেয়াদে কারাদন্ড দেন। এ রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালতের দেয়া রায়ের অনুমোদন প্রক্রিয়া চূড়ান্তুভাবে সম্পন্ন হলো। বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি মো. শওকত হোসেন মূল রায় লিখেছেন। তিনি প্রায় সাড়ে ১১ হাজার পৃষ্ঠার রায় লিখে বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতির কাছে পাঠান। এরপর বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী পৃথকভাবে তার অংশ লেখেন। তিনিও প্রায় ১৬ হাজার পৃষ্ঠা লেখেন। এই দুই বিচারপতির সম্মিলিত রায় প্রায় ২৮ হাজার পৃষ্ঠা। পরে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার লিখেছেন ১১শ পৃষ্ঠা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন