এক
গতকাল সন্ধ্যায় টিএসসিসিতে বন্ধুরা মিলে গল্প করছিলাম। আলোচনা হচ্ছিল দেশ-বিদেশে চলমান নানা ইস্যু নিয়ে। তন্মধ্যে একজন হাসির ছলে বলে উঠল, একদিন যে আমাকে এমন সংবাদপত্র উপহার দিতে পারবে যেখানে দূর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার খবর থাকবেনা; তাকে আমি পেট পুরে চাইনিজ খাওয়াব। কথাটি শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম। পরক্ষণেই কথাটি মনের গহীনে চিন্তার রেখাপাত আঁকলো। হাসির ছলে কথাটি বললেও বাক্যটির গভীরতা ছিল ব্যাপক। সত্যিই তো তাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা হাতে নিলেই মনের ভেতর অজানা শঙ্কা কাজ করে; লাল কালির শিরোনামে না জানি আজ কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার খবর পড়তে হয়! আমরা তো নিজেদের উন্নত সভ্যতার মানুষ দাবি করি। তাহলে কেন প্রতিনিয়ত দূর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ, খুন, ধর্ষণ, হানাহানির ঘটনায় আরেকজনের মূল্যবান জীবন থমকে যাচ্ছে?
দুঃখজনক হলেও সত্য এজন্যই বোধহয় সাম্প্রতিক সময়ে সমাজে একটি প্রবাদ প্রচলিত হয়েছে যে ‘আমাদের দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলেও মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি’। অবাককর বিষয় সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর সিংহভাগ অংশকে নানা অপকর্মে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকতে দেখা যায়। প্রশ্ন হতে পারে শিক্ষিত সমাজের মধ্যেও কেন এই অপরাধপ্রবণতা? একটু খেয়াল করলে আমরা ক্ষেত্রভেদে অপরাধমাত্রার বিভিন্নতা দেখতে পাই। গ্রামাঞ্চলে দৃষ্টি দিলে জমি-জমা নিয়ে দ্ব›দ্ব, এলাকায় মড়ল-মাতবরের আধিপত্য বিস্তার, দুই গ্রামের ঠুনকো কিংবা পূর্ব বিরোধের জেরে সংঘর্ষ লেগে থাকে। ধীরে ধীরে শহরাঞ্চলে দৃষ্টি দিলে বাহারি রঙের অপরাধের ধরন দেখতে পাওয়া যায়। পথে পথে পরিবহন শ্রমিকদের বিভিন্ন সমিতি ও ইউনিয়নের নামে চাঁদাবাজি, সরকারি অফিস ও দপ্তর সমূহে অবাধে ঘুষ লেনদেন, বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরকারদলীয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার প্রভাব, সরকারি স্থাপনা নির্মাণে শুভঙ্করের ফাঁকি, সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যে ভেজাল, ব্যবসা বাণিজ্যে প্রতারণা, ডাক্তারদের রোগ বাণিজ্যসহ সমাজে ঘটিত অপরাধকর্মের উদাহরণ লিখে শেষ করা যাবে না। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেরও অবস্থা ভয়ানক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার্থীদের নায্য অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো যেন কেউ নেই! ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবী করলে প্রশাসন যেন তাৎক্ষনিক শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে! পদোন্নতি ও প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্ব পাবার লোভ আর রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির জন্য শিক্ষকরাও নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা নানা ইস্যু ও নায্য অধিকার আদায়ে আন্দোলন করলে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের বাধায় তা সফলতার মুখ দেখতে পায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা স্বাধীন মত প্রকাশ করবে, মুক্ত জ্ঞান চর্চা করবে, গবেষণা করবে, ছাত্র-জনতার নায্য অধিকার আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে এটিই কাম্য। কিন্তু প্রতিটি ক্যাম্পাসে মত প্রকাশের অধিকার যেন খর্ব করা হয়েছে। ছাত্ররাজনীতির অতীত গৌরবাজ্জ্বল ইতিহাস ভুলে যেন প্রতিপক্ষকে শারীরিকভাবে ঘায়েল করায় যেন বর্তমান ছাত্ররাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে পড়েছে। পড়ালেখা ছেড়ে মন চলে গেছে টেন্ডারে, চাঁদাবাজিতে।
শিক্ষার মূলত তিনটি দিক রয়েছে। ঐঁসধহ াধষঁবং, ঝড়পরধষ াধষঁবং ধহফ ওফবড়ষড়মরপধষ/জবষরমরড়ঁং াধষঁবং. অর্থ্যাৎ মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ এবং আদর্শিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধ। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম দুটি গুণ শিক্ষা দেওয়া হলেও আদর্শিক বা ধর্মীয় শিক্ষাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়না। একপ্রকার ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পার করে দেওয়া হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাতেও একই অবস্থা। গত ২৬ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ আয়োজিত মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী এক সমাবেশে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ সুপার বলেন, পূর্বে ছেলে মেয়েদের কোরআন শিক্ষা দেওয়া হতো। ফলে ধর্মীয় চেতনায় প্রতিটি শিশু উজ্জীবিত হতো এবং সমাজে অপরাধমাত্রা কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে অভিভাবকরা ধর্মশিক্ষা সম্পর্কে অবচেতন। এতে সমাজে অপরাধপ্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষকরা মন্তব্য করেছেন, উচ্চ শিক্ষার সাথে সাথে নৈতিক বা ধর্মীয় শিক্ষার যদি সংমিশ্রণ না ঘটানো যায় তবে সেই শিক্ষা অপূর্ণ রয়ে যায়। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মেই ন্যায়কে ন্যায় এবং অন্যায়কে অন্যায় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মানুষের মনে যদি ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত থাকে তবে বিবেকও জাগ্রত থাকে। কারণ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ধর্মেই পুনরুত্থান বা শেষ বিচারের কথা বলা হয়েছে। মানুষের মনে যদি সেই বিচারের ভয় জাগ্রত থাকে, তবে তার দ্বারা কোনও অপরাধকর্ম করা সম্ভব হয়না; অপরাধকর্মের চিন্তা মাথায় আসলেই সে সর্বদা বিবেকের দংশনে তাড়িতে হতে থাকে। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে- মানুষ তোমরা কি ভেবেছ তোমাদের এমনিতেই সৃষ্টি করা হয়েছে, অথচ তোমাদের কোনো হিসাব নেওয়া হবে না?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন