শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

বান্দার গুনাহ মাফের রাত লাইলাতুল কদর

প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আসাদুজ্জামান আসাদ
রমজান মাস। ক্ষমার মাস। এ মাসে লাইলাতুল কদর বা একটি মহিমান্বিত রাত রয়েছে। যে রাতটি হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয় আমি লাইলাতুল কদরের রাতে কোরআন নাজিল করেছি। তুমি কি জানো লাইলাতুল কদর কি। লাইলাতুল কদর হচ্ছে হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম মাস’। ‘লাইলাতুল কদর’ বাক্যটির মধ্যে দু’টি শব্দ রয়েছে। লাইলাতুল শব্দটির শাব্দিক অর্থ রাত বা রজনী। আর কদর শব্দটির অর্থ হচ্ছে- মহাত্মা বা সম্মান, তাক্বদীরের রাত। শরীয়তের পরিভাষায় লাইলাতুল কদর শব্দের অর্থ হলো মহাত্মা বা সম্মানের রাত, তাক্বদীরের রাত। তবে প্রসিদ্ধ আলেমগণ লাইলাতুল কদরের কয়েকটি নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন- লাইলাতুল হুকুম, লাইলাতুল ক্বাদা, লাইলাতুম মুবারাকা, লাইলাতুল মাগফিরাহ, লাইলাতুল রহমান, লাইলাতুল জায়িযাহ ইত্যাদি। তাই মোমিন বান্দাদের জন্য এ রাতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্য ম-িত বটে।
লাইলাতুল কদর সম্পর্কে হযরত উবাদা বিন সামেত (রা.) বর্ণনা করেন, বিশ্ব নবী (সা.) বলেছেন, ‘লাইলাতুল ক্বদর এর নিদর্শন হচ্ছে, রাতটি পরিষ্কার ও উজ্জ্বল হবে। মনে হবে যেন, উজ্জ্বল, নীরব ও ঠা-া চাঁদ উদ্ভাসিত হয়েছে। এ রাতে অধিক গরম অথবা অধিক ঠা-া হবে না। সকালের সূর্য হবে মৃদু ধূসর আলো বিশিষ্ট’। অন্তরে প্রশান্তি ও মুমিনের জীবনে বিশেষ প্রফুল্লতা আসবে। রাতে আবহাওয়া ভারসাম্যপূর্ণ হবে। লাইলাতুল কদর এমন একটি রাত, যে রাতে আল্লাহ বান্দার গুনাহসমূহ মাফ করেন। মোমিন মুসলমানদের জানতে হবে লাইলাতুল কদরের রাত কোনটি। এ রাতটি অত্যন্ত মূলবান একটি রাত। এ রাত মোমিন মুসলমানদের খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্ব নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার কাছ থেকে লাইলাতুল কদর এর নির্দিষ্ট দিন তারিখ সর্ম্পকিত জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। হতে পারে এতে তোমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে’। হজরত আয়শা (রা) বলেন, বিশ্ব নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে শবে কদরকে অন্বেষণ কর’। হজরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, বিশ্ব নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হলো, এমতাবস্থায় আমার পরিবারের কেউ আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিল। আর আমি লাইলাতুল কদরকে ভুলে গেলাম। সুতুরাং তোমরা শেষ দশকে তা তালাশ কর’। বিশ্ব নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর’। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, বিশ্ব নবী (সা.) বলেন, ‘লাইলাতুল কদর হলো রমজানের ২৭ তারিখ অথবা ২৯ তারিখ’। তিনি (সা.) আরো বলেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর। হতে পারে-২৯, ২৭ এবং ২৫ তারিখে’। বিশ্ব নবী (সা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশকের ৫ম(২৫) ৩রা (২৩) দিনে লাইলাতুল কদর হয়ে থাকে’। এমনিভাবে বিশ্ব নবী (সা.) লাইলাতুল কদর সর্ম্পকে অনেক কথাই বলেছেন। রমজান মাসের শেষের দশকের বেজোড় তারিখে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতে হবে।
লাইলাতুল কদরের রাতে নেয়ামতের অফুরন্ত ভা-ার থাকে। অথচ আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা পার্থিব জগত নিয়ে মুগ্ধ। প্রতি বছর এ নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হাদিসে এসেছে ‘আল্লাহ বলেন, হে ফেরেস্তাগণ এ রাতে আমল কারী, যখন তার আমল পূর্ণ করবে, তার প্রতিদান কী হবে? ফেরেস্তাগণ উত্তরে বলেন, তাদের প্রতিদান পূর্ণ করে দিন। আল্লাহ বলেন, তোমরা সাক্ষী থাক আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম’। বিশ্ব নবী (সা.) বলেন, ‘যখন শবে ক্বদর আসে তখন জিব্রাইল (আ.) ফেরেস্তাদের একটি বিরাট দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। তারা প্রত্যেকে ঐ বান্দার জন্য দোয়া করতে থাকেন, যারা দাঁড়িয়ে অথবা বসে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকেন’। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘রমজান মাসে সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম একটি রজনী রয়েছে, যে ব্যক্তি এ রাতে নেকী হতে বঞ্চিত থাকবে সে সর্বহারা হবে’। লাইলাতুল কদর ঘুমানোর রাত নয়। লাইলাতুল কদরে বিশ্ব নবী (সা.) কী কী আমল করতেন তা জানার প্রয়োজন। হযরত আয়শা (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) যখন রমজানের শেষ দশকে প্রবেশ করতেন, তখন নিজে লুঙ্গি শক্ত ভাবে বেঁধে নিতেন। রাত জাগ্রত থাকতেন এবং নিজ পরিবারকে জাগিয়ে দিতেন’। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি “লাইলাতুল কদর আসলে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, হে আমার বান্দা, আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমার সম্মান মর্যাদার কসম আজ তোমার আখেরাতের জন্য যা কিছু প্রার্থনা করবে আমি তোমাদের তাই প্রদান করব। আর তোমাদের দুনিয়ার জন্য যা কিছু প্রার্থনা করবে সে দিকেই আমি দৃষ্টি দিব। আমার সম্মানের কসম, তোমাদের পাপ সমূহ গোপন রাখা হবে, যেহেতু তোমরা আমাকে মহা পর্যক্ষেক হিসাবে গ্রহণ করেছ। আমার সম্মানের কসম আসহাবুল হুদুদ এর সামনে তোমাদেরকে ক্ষমাহ করা হলো। তোমরা আমাকে সন্তুষ্ট করেছ আমি তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট। অতঃপর ফেরেস্তাগণ উল্লাস করতে থাকেন আর এ উম্মতকে মহান আল্লাহ যা দিয়েছেন তার জন্য ক্ষমাহ প্রার্থনা করতে থাকেন”। সাহাবায়ে কিরামদের অনুসরণ করে মোমিন বান্দার উচিৎ হবে- আল্লাহর দরবারে আরাধনা করা, ইবাদত করা, কোরআন তেলাওয়া ও তাফসীর পাঠ, জিকির, তাসবিহ তাহলিল, দরূদ শরীফ পাঠ এবং ইস্তেগফার পাঠ করে সারা রাত কাটিয়ে দেয়া। পার্থিব জীবনের সব সমস্যা সমাধানের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে হবে। হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
আমরা মানুষ। সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করি। আমরা লাইলাতুল কদরের রাতে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানমালা করে থাকি। এ সব অনুষ্ঠানে ভিআইপি ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করি। অনুষ্ঠানমালা রেডিও টিভি, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করি। ইবাদতের পরির্বতে অনুষ্ঠানমালা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আফসোস তাদের জন্য যারা এরূপ কাজ কর্ম নিয়ে রাত অতিবাহিত করেন। তারা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুর্ভাগা। লাইলাতুল কদরের রাত, সবার প্রতি ফজিলত বা নেয়ামত বর্ষিত করেন না; যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার ফজিলত বর্ষিত করেন তারাই ভাগ্যবান। বিশ্ব নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরের রাতে জামাআতের সাথে মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করল সে লাইলাতুল কদরের একটি অংশ পেল’। হজরত ইবন মুসায়্যিব (রা.) বলেন, বিশ্ব নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ইশার জামাআতে উপস্থিত হলো সে এ রাতের একটি অংশ পেল’। হজরত আনাস (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ইশা ও ফজরের নামাজ জামাআতের সাথে আদায় করল সে লাইলাতুল কদরের পূর্ণাঙ্গ অংশ পেল’। লাইলাতুল কদরের রাতে যে সব বান্দা আল্লাহর নেয়ামত ও রহমত থেকে বঞ্চিত হবেন, তাদের ব্যাপারে বিশ্ব নবী অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, বিশ্ব নবী (সা.) বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদর এলে প্রত্যেক মুমিন পুরুষ ও মহিলার উপর ফেরেস্তাগণ সালাম প্রেরণ করেন। কিন্তু মদ পানকারী, শুকুরের গোস্ত ভক্ষণকারী এবং জাফরানের সুগন্ধি ব্যবহারকারী বা জাফরান দ্বারা শরীরকে রঞ্জিতকারীগণ এ সালাম থেকে বঞ্চিত থাকবেন’। বিশ্ব নবী (সা.) বলেছেন, ‘পিতা মাতার অবাধ্য সন্তান, আত্মীয়তার সর্ম্পক ছিন্নকারী ও বিদ্বেষীদের প্রতি ফেরেস্তাগণ সালাম প্রেরণ করেন না।’ এরা সর্বদাই আল্লাহর নেয়ামত ও রহমত থেকে বঞ্চিত থাকেন। যদি তারা আল্লাহর দরবারে তওবা করেন, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমাহ করতে পারেন।
পরিশেষে বলতে চাই যে, লাইলাতুল কদর একটি সম্মানিত রাত। এ রাতে মহান প্রভু বান্দার যাবতীয় গুনাহ সমূহ ক্ষমাহ করে থাকেন। তাই প্রত্যেক বান্দার উচিৎ লাইলাতুল কদরের রাত জেগে আন্তরিকতার সাথে তার ইবাদত ও দোয়া করা। দোয়া কবুলের জন্য শর্ত হচ্ছে হালাল খাবার ভক্ষণ করা। তাই খাবার সময় হালাল-হারাম যাচাই করে চলা প্রয়োজন। লাইলাতুল কদর সবার ভাগ্যে প্রতিফলিত হোক। আমিন।
ষ লেখক : গ্রন্থকার ও সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন