শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জাতির বিকাশে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

চিকিৎসাশাস্ত্রমতে, বিষণ্নতা একটি রোগ। অন্যান্য নিন্দনীয় অভ্যাসের মতই মিথ্যা বলা একটি অভ্যাস। মানুষ অভ্যাসের দাস, এ কথার প্রমাণও যুগ যুগ ধরে পরীক্ষিত। মিথ্যা বলা যেন মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ মামলা-মোকদ্দমা মিথ্যা সাব্যস্ত হয় বাদী কর্তৃক মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার কারণে। বাদী, বিবাদী, সাক্ষী সকলেই যখন মিথ্যার আশ্রয় নেয় তখন সত্যকে খুঁজে বের করে সঠিক বিচারিক সিদ্ধান্ত দেওয়া জটিল থেকে জটিলতর হয়ে পড়ে। বিচার ব্যবস্থায় আস্থাহীনতা শুধু বাদী-বিবাদীর মিথ্যার জন্য নয়, তাতে সংশ্লিষ্টদের পরশ্রীকাতরতাও দায়ী। বর্তমানে আইনী ব্যাখ্যা ও আইন প্রয়োগ হয় বিচারকদের চাকরি যাদের উপর নির্ভরশীল তাদের মন মর্জি মেজাজের উপরে। পরশ্রীকাতরতা মানুষের কর্মে ফুটে উঠে, যা দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। পরশ্রীকাতরতা বলতে কী বুঝায়? এটা কি জাতিগত, শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য না ব্যক্তিগত বিষয়? পরশ্রীকাতরতা বিষণœতার মত একটি রোগ, যা সম্পূর্ণরূপে মানসিক সমস্যা। তবে পরশ্রীকাতরতা ও পরস্ত্রীকাতরতা এক বিষয় নয়। বর্তমানে সমাজে বিশেষ করে উঁচু তলার ভদ্র সমাজে পরস্ত্রীকাতরতার প্রভাব অনেক বেশি, যা ধর্মহীন সমাজ ও আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। ধর্মহীনতার নামে আধুনিকতা ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু তথাকথিত ভদ্র সমাজ ধর্মকেই কুসংস্কার মনে করে বিধায় পরস্ত্রীকাতরতার প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলছে।

পরাশ্রয় (Dependence on others), পরাশ্রয়ী বা পরাশ্রিত (Protected by other) শব্দ থেকে পরশ্রীকাতরতার উৎপত্তি। আক্ষরিক বা অভিধানিক অর্থে পরশ্রীকাতরতার অর্থ যাই হোক না কেন, বিবেক যেখানে বন্দি হয়ে যায় সেখান থেকেই পরশ্রীকাতরতার উৎপত্তি। সত্যকে সত্য বলে প্রকাশ না করা বা কোনভাবে সত্যকে এড়িয়ে চলা অথবা প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে নিজ অবস্থানকে ঠিক রাখা বা উপরস্থদের অনুকম্পা পাওয়ার জন্য অন্যায় বা মিথ্যাকে সমর্থন দেয়ার মন মানসিকতাই পরশ্রীকাতরতা। অন্যদিকে নিজ বিবেককে ফাঁকি দিয়ে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মিথ্যা ও অন্যায়ের ¯্রােতের টানে গা-ভাসিয়ে দেয়া থেকেই পরশ্রীকাতরতার উৎপত্তি। পৃথিবীতে প্রায় সকল জীবজন্তুর মেরুদন্ড রয়েছে। মানুষও মেরুদন্ডের উপর ভিত্তি করেই নিজ দেহকে সচল রাখে। পৃথিবীতে অনেক জীব জন্তু রয়েছে, যাদের মেরুদন্ড নাই, বুকের উপর ভর দিয়ে চলে। যেমন- সাপ (সর্প), কেঁচো, কুচলিয়া জাতীয় প্রাণী। কিন্তু সমাজে এমন মানুষ রয়েছে যারা মেরুদন্ডহীন মানুষ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। অর্থ, বিত্ত, সম্পদ, বংশমর্যাদা, শিক্ষা-দীক্ষায় শীর্ষ স্থানে অবস্থান করেও উঁচু তলার অনেক মানুষের ললাটে মেরুদন্ডহীনের তকমা লেগে আছে, যা সমাজের মানুষের পক্ষ থেকে এ তকমা উপহার হিসেবে প্রদত্ত। যে মানুষ কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করে, কিন্তু কর্তার ইচ্ছা যদি নীতি বা আদর্শ ও বিবেকবহির্ভূত হয় তারপরও নির্বিচারে সম্পাদন করে, তখন সমাজ বা গণমানুষ মেরুদন্ডহীন বলে তাকে অখ্যায়িত করে। এ মেরুদন্ডহীনতাকে উপর তলার মানুষ আরো উপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে। নিজ বিবেকের কাছে যাদের জবাবদিহিতা নাই তারই মেরুদন্ডহীন হতে পারে। মেরুদন্ডহীন হওয়া বা না হওয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষা, বিশাল সম্পদ, খ্যাতি ও মর্যাদা কোনো কিছুই প্রতিবন্ধক নয়, যদি নিজ নিজ বিবেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, খাদ্যে ভেজালের কারণে বাংলাদেশে ক্যান্সারসহ জটিল রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল কারা দেয়? বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রে এতো ভেজাল নাই এবং এতো ঔষধ বিক্রি হয় না। অধিকন্তু ঔষধের মধ্যেও ভেজাল এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ঔষধ বাংলাদেশের মানুষই বিক্রি করছে। অথচ এ বিবেকবর্জিত ব্যবসা থেকে যারা অধিক হারে মুনাফা অর্জন করছে, তারা লোক দেখানো ধর্মকর্মেও এগিয়ে থাকে। একবার হজ্জ করা বাধ্যতামূলক থাকলেও সুযোগ পেলেই হজ্জ করে, মসজিদ, মাদ্রাসায় দান করে। যাদের বিবেক নাই তারাই যে কোনো অপরাধ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এ ধরনের ভুরি ভুরি উপমা দেয়া যাবে, যেখানে বিবেকবর্জিত মানুষেরা ঘৃণ্য অপরাধকেও অপরাধ বলে মনে করে না। কিন্তু বিভিভাবে সমাজে তারাই উচ্চ আসনে অলংকৃত হয়ে আছেন। এর পিছনের কারণও বিবেকবর্জিত সমাজ ও বিবেকবর্জিত সামাজিক অবক্ষয়।

পরশ্রীকাতর হওয়ার জন্য ধরাবাঁধা কোনো সীমারেখা নাই। পূর্বেই বলেছি, এ বিষয়টি ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তবে অনুভব করা যায়, অবশ্য প্রাথমিক স্তরে নয় বরং কয়েক ধাপ অতিক্রম করার পর চোখে পড়ে। এ অবস্থা বা পরশ্রীকাতরতার দৃষ্টিভঙ্গি একজন গ্রাম্য পুলিশ থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত থাকতে পারে। অন্যদিকে খেটে খাওয়া দিন মজুর, যার নুন আনতে পানতা ফুরায়, সে ব্যক্তিও বিবেকসম্প বা মেরুদন্ডসম্প মানুষ হতে পারে। এটা নির্ভর করে একটি নির্লোভ মন-মানসিকতার উপরে।

একজন মানুষ গুণ ও দোষে প্রভাবিত। সে প্রভাবের দায় অনেক সময়ই অন্যকে বহন করতে হয়। এভাবেই কোন ব্যক্তির বিবেকহীন কর্মের কারণে গোটা সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র বির্পযস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু লাভবান হয় সে ব্যক্তি নিজে। অন্যদিকে বিবেকসম্প কাজের জন্য অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হয় জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্র। সত্য কথা বলতে যেয়ে, সাদাকে সাদা বা কালোকে কালো বলতে যেয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল নয়। সত্য, নৈতিকতা ও আর্দশের পক্ষে থাকা একটি অভ্যাসের বিষয় এবং অভাবের তাড়নায় বা প্রলোভনে নিজ বিবেক বিক্রি করে নাই, এমন ঘটনাও রয়েছে। তবে বিবেক বিক্রেতার সংখ্যাই অনেক বেশি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, যারা প্রফেশনাল বুদ্ধিজীবী, তাদের অধিকাংশই পরশ্রীকাতর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা হক কথা না বলে চামচাগিরি করে। আমরা মনে করি যে, প্রফেশনাল বুদ্ধিজীবীরা স্বরূপ পাল্টিয়েছে। যে কথা বললে ক্ষমতাসীনরা খুশি হয়, বুদ্ধিজীবীরা সে কথাই বলছে। বিনিময়ে তারা পাচ্ছে সুখে থাকার নিশ্চয়তা এবং তাদের কারণে জাতি আজ বিভিভাবে বিভক্ত, সকল বিষয়েই তাদের জিরো টলারেন্স রয়েছে, কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রের পক্ষে বা গণমানুষের অধিকার আদায়ের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো ভ‚মিকা নাই। বৃটিশরা ভারত দখল করার পূর্বে ভারতবাসীদের মধ্যে দালাল সৃষ্টি করেছে, অনুরূপ বাংলাদেশিদের মধ্যেও পাকিস্তানের সমর্থক ছিল, যারা রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া বা স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দেয় নাই। এখন বাংলাদেশের শাসনকর্তারা পরশ্রীকাতরতা সম্প বুদ্ধিজীবিদের ক্রয় করেই দেশকে বিরাজনীতিকরণসহ প্রকৃত গণতন্ত্রকে হরণ করে সৃষ্টি করেছে প্রতিদ্ব›িদ্বতাবিহীন নির্বাচনী সংস্কৃতি। এর জন্য পরশ্রীকাতরতাই দায়ী। পরশ্রীকাতরতা বর্তমানে একটি জাতীয় ব্যাধি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখা বিভি প্রবন্ধে, বাঙালি চরিত্রকে নি¤œরূপে চিত্রায়িত করেছেন:
‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না, আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভ‚রিপরিমাণ করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রæটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহবল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’ (সূত্র: চারিত্র পূজা, বিদ্যাসাগর চরিত)

‘আমরা না পড়িয়া পন্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ধাঁ করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট আমাদের রসনার অদ্ভুত রাসায়নিক প্রভাবে জগতে যে তুমুল বিপ্লব উপস্থিত হইতে আমরা তাহারই জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছি, সমস্ত জগৎও সেইদিকে সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া আছে।’ (সূত্র: স্বদেশ ও সমাজ, চিঠিপত্র-৪)

‘আমরা এগোই না, অনুসরণ করি, কাজ করি না, পরামর্শ দিব, দাঙ্গাহাঙ্গামাতে নাই, কিন্তু মকদ্দমা মামলা ও দলাদলিতে আছি। অর্থাৎ হাঙ্গামের অপেক্ষা হুজ্জতটা আমাদের কাছে যুক্তিসিদ্ধ মনে হয়।’ (সূত্র: স্বদেশ ও সমাজ, চিঠিপত্র-৫)

‘আমরা দলাদলি ঈর্ষা ক্ষুদ্রতায় জীর্ণ। আমরা একত্র হইতে পারি না, পরস্পরকে বিশ্বাস করি না, আপনাদের মধ্যে কাহারও নেতৃত্ব স্বীকার করিতে চাহি না।’ (সূত্র: রাজা প্রজা, ইংরেজ ও ভারতবাসী)

উক্ত অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণের উপায় এখনই বের করতে হবে। তবে বাঙালির অনেক গৌরবোজ্জ্বল ভ‚মিকাও রয়েছে যেমন, ভাষাআন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি। মনস্থির করতে হবে, আমাদের জাতিসত্ত¡া কোন পন্থায় এবং কীভাবে গৌরবোজ্জ্বল হবে। জাতিসত্ত¡া বিনির্মাণে একটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছা একান্ত জরুরি এবং এখনই সময়।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন