শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

যাকাত দিলে সম্পদ বেড়ে যায় জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়

প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উবায়দুর রহমান খান নদভী : একজন বিত্তবান কোটি টাকায় গাড়ি কিনলেন, বাড়িঘর, জমি, ফ্ল্যাটের মালিক হলেন কিন্তু তার জীবন, সম্পদ ও গাড়ির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন না। তাহলে তিনি কি বুদ্ধিমানের কাজ করলেন? অবশ্যই না। কোনো নারী গা ভর্তি গহনা, দামি সাজসজ্জা আর জমাকৃত সম্পদ নিয়ে গর্বিত কিন্তু তিনি সম্পদের সুরক্ষা ও পবিত্রতার ব্যবস্থা করলেন না। তাহলে কি তাকে বুদ্ধিমতী বলা যাবে? কখনই না। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের এ সত্যটি মেনে নিতেই হবে যে, আমাদের জীবন, সুস্থতা, সম্পদ, মেধা ও জীবনী শক্তি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দান। যিনি দান করেন মূলত, তিনিই সবকিছুর মালিক। আমরা বান্দারা এসবের আমানতদার মাত্র। ইচ্ছে করলেই মালিক সব নিয়ে নিতে পারেন। তিনি এসব আমাদের ব্যবহার করতে দিয়ে কেবল বিশ্বাস ও আনুগত্যটুকুই কামনা করছেন। জীবন, দেহ, প্রাণ, মেধা, প্রতিভা, কর্মশক্তির কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বান্দার উপর ফরজ করেছেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। পবিত্র কোরআনে ৮৩ বার নামাজ আর ৩৩ বার যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এত বেশিবার অন্য কোনো ইবাদতের কথা বলা হয়নি। পাশাপাশি আল্লাহ বলেছেন যাকাত দেয়ার কথা। যাকাত হচ্ছে সম্পদের কৃতজ্ঞতা এবং পবিত্র করার পথ। অর্থ-বিত্ত, সহায়-সম্পত্তির আধিক্য মানুষের অন্তরকে নষ্ট বানিয়ে ফেলে। অধিক বিত্তে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ক্ষয় হয়ে যায়। কৃপণতা ও অমানবিকতা অন্তরে বাসা বাধে। সমাজ ও পরিবারে হিংসা-বিদ্বেষ শত্রুতা দেখা দেয়। অসহায় বঞ্চিত দরিদ্র শ্রেণীর মনে ক্ষোভ জন্মে। সন্ত্রাস চাঁদাবাজির অত্যাচার দিন দিন বাড়ে। বিত্তবানদের ঘরে দ্বীনদারির চর্চা না থাকলে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের ভেতর কঠোরতা, নিষ্ঠুরতা, হতাশা, মাদকাসক্তি ইত্যাদির প্রবণতা দেখা দেয়। এসব সমস্যা থেকে বিত্তবানকে নাজাত দেয়ার জন্য আল্লাহ যাকাত ফরজ করেছেন। যাকাত শব্দের অর্থই অন্তর ও সম্পদকে পবিত্র করা। জীবন ও সম্পদ বান্দাকে দান করে আল্লাহ তাকে সাময়িক মালিকানাও দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি অসহায় ভাগ্যবিড়ন্বিত বান্দাদের জন্য বিত্তবানদের সম্পদে অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বছর শেষে জমাকৃত সম্পদে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত। পশু ও ফসলের যাকাতের পরিমাণ ভিন্ন রকম।
যাকাত কোনো দয়া বা দান নয়। এটি কোনো ট্যাক্স বা জরিমানাও নয়। যাকাত বিত্তবানদের উপর সমাজের প্রতি নির্ধারিত দায়িত্ব, যা হিসাব করা ও প্রাপকের হাতে পৌঁছে দেয়া যাকাতদাতার উপর ফরজ। যাকাত দিলে ধনী-গরিবের আকাশ-পাতাল বৈষম্য থাকতে পারে না।
সুদ ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে যাকাত ও সাদাকাহভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। যাকাত না দিলে সম্পদ তথা জানমাল রক্ষার নিশ্চয়তা থাকে না। যাকাত দিলে এ সবের হেফাজত করার দাযিত্ব আল্লাহর। যাকাত না দিলে জমাকৃত সম্পদ ও সোনাদানা ভয়ানক সাপ বিছুর আকার নিয়ে পরকালে এই বিত্তশালীকে দংশন করবে। এসব তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সম্পদ গরম করে চেহারা ও দেহের নানা অংশে দাগ দেয়া হবে। (আল-কোরআন) আল্লাহর সিদ্ধান্ত এই যে, সুদ ও সুদের কামাই ধ্বংস হয়ে যাবে আর দান ও যাকাতের দ্বারা সম্পদ বাড়তে থাকবে। (আল-কোরআন) মহানবী (স.) বলেছেন, হজ গুনাহ ও দারিদ্র্যকে মুছে দেয়। যাকাত ও দান-খয়রাত বিপদ-আপদ রুখে দেয় (আল-হাদীস)। যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একটি মুদ্রা ব্যয় করে আল্লাহ তাকে কমপক্ষে এর দশগুণ, সত্তরগুণ অথবা সাতশ’ গুণ বিনিময় দেবেন। যাকে ইচ্ছা তিনি এরও বহুগুণ বেশি দান করেন (আল-কোরআন)। রমজান মাসে একটি ফরজের সওয়াব সত্তরটি ফরজের সমান করে দেয়া হয়। নফল কাজের সওয়াব দেয়া হয় ফরজের সমান (আল-হাদীস)। এজন্য অনেক বিত্তবান মুসলমান রমজান মাসেই তাদের যাকাত প্রদান করে ৭০ গুণ সওয়াব লাভের সুযোগ লাভ করেন।
যারা টাকা-পয়সা বিষয় সম্পত্তির যাকাত দিতে আগ্রহী নন তারা কি ভেবে দেখেছেন এ সম্পদই তার জন্য আজাবের বস্তু হবে? দুনিয়ার জীবনেও হবে অশান্তি, দ্বন্দ্ব-কলহ মানসিক অস্থিরতা ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলার কারণ। জীবন ও সম্পদহানির সম্ভাবনাতো পদে পদেই লেগে থাকবে। অথচ শতকরা মাত্র আড়াই ভাগ বছর শেষে একবার প্রাপকদের হাতে তুলে দিলেই তার সম্পদ পবিত্র হয়ে যাচ্ছে। জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে। আরো বাড়তি দয়া এই যে, নির্দিষ্ট দানের জন্য আবার সওয়াবও আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া হবে।
যাকাত দেয়ার আটটি খাতের কথা পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে। তার মধ্যে দরিদ্র, অসহায়, ঋণভারে জর্জরিত, বন্দী-ক্রীতদাস, বিপদগ্রস্ত মুসাফির, আল্লাহর পথে জিহাদরত সৈনিক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যাকাত শুরু করতে হবে নিজের দরিদ্র আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী ও সম্পর্কিত লোকজনকে দিয়ে।
হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে হজ করলে পরবর্তী জীবনে মানুষ আর অভাবগ্রস্ত হয় না। মহানবী (সা.) বলেছেন, গুনাহ এবং দারিদ্র এ দুটি জিনিস হজ দ্বারা বিলীন হয়ে যায়। যাকাতও এমনই। যাকাত দানকারীর অভাব থাকে না। সম্পদ ধ্বংস হয় না। নামাজ, রোজা, তিলাওয়াত, জিকির ও দানে অভ্যস্ত ব্যক্তি মারাত্মক রোগব্যাধি, বালা-মুজিবত বা পারিবারিক বিপর্যয় থেকে হেফাজতে থাকে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় হয়রানি থেকেও নেক আমল, তওবা, ইসতেগফার মানুষকে রক্ষা করে। যাকাত দিলে মানুষের সম্পদ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। যাকাতদাতা সব সময় ধনী ও বিত্তশালী থাকে। তার মালে বরকতও প্রবৃদ্ধি ঘটে।
এদেশে কিছু বিত্তশালী ব্যক্তির সুখ্যাতি আছে তাদের যাকাত ব্যবস্থাপনার জন্য। নিজ আত্মীয়স্বজন ও এলাকার মানুষকে তালিকাভুক্ত করে, গরিবদের সচ্ছল করে দেয়া, ঘরবাড়ি, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, বিয়েশাদি, বিদেশযাত্রা ইত্যাদির ব্যবস্থা তারা এমনভাবে করেছেন যে, ১৫/২০ বছর পর এ কর্মসূচি তারা অন্য এলাকায় সম্পসারণের সুযোগ পেয়েছেন। নিজ এলাকায় যাকাত নেয়ার মতো মানুষ আর নেই। আর এসব ব্যবসায়ী শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েও নিজ সমাজে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করছেন। মানুষের দোয়া ও ভালোবাসায় তারা সুস্থ আছেন, সুখে আছেন, নিশ্চিন্তে আছেন। যারা শোষণ, দুর্নীতি, কূটকৌশল ও লোক দেখানো বদান্যতার আশ্রয় নেয়, যারা অন্যায়ভাবে মানুষের জমি, সম্পদ ও অর্থ হাতিয়ে নেয় তারা শত উন্নতিতেও মনে সুখ পায় না। পরিবার ও পরিপার্শ্বে তারা প্রশান্তি ও নিরাপত্তা বোধ করে না। অনেকেই সুরক্ষিত গাড়ি বাড়ি ও সমাজেও মনের শংকায় ভোগে আর অস্ত্রধারী প্রহরীর সহায়তায় চলাফেরা করতে বাধ্য হয়। হালাল উপার্জন, অল্পে তুষ্টি, যাকাত, সাধারণ দান, খয়রাত, মানুষের প্রতি উদারতা ও বদান্যতা মানুষকে মুক্তি দেয়। সাহসী বানায়। সুখে রাখে।
অনেকে যাকাতের বিষয়ে ভুল ধারণায় আছেন। তারা মনে করেন যাকাত মানে দয়া ও দান। কিছু কম দামের শাড়ি (যার নামই রাখা হয়েছে যাকাতের শাড়ি) ঘোষণা দিয়ে দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ায়। অনেক সময় দেখা যায় যাকাত নিতে এসে ভিড়ে পদদলিত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। যাকাতদাতার মূর্খতা ও ভুল ব্যবস্থাপনার ফলেই এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। অথচ যাকাত দেয়ার জন্য আরো নিরাপদ ও বিজ্ঞচিত পন্থা রয়েছে। যাকাত প্রাপকদের হাতে অর্থ তুলে দিলে তারা তা দিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি যা দরকার করতে পারেন। শুধু শাড়ি নিয়ে তারা এর কোনোটাই করতে পারেন না। তা ছাড়া যাকাত বিতরণের এ পদ্ধতিও শরীয়তসম্মত নয়।
উন্নত দেশগুলোতে চ্যারিটির নামে মানুষ প্রচুর দান করে। অনেকেই সম্পত্তি জনকল্যাণমূলক কাজে উইল করে যায়। বড় বড় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের দিয়ে যাওয়া সম্পত্তি, অর্থ, বন্ড ইত্যাদি থেকেই পরিচালিত হয়। মুসলমান হওয়ায় আমাদের জন্য এ ধরনের কাজ আরো বেশি কাক্সিক্ষত। ফরজ যাকাত ছাড়াও জনকল্যাণে ঐচ্ছিক দান ইসলামে অধিক উৎসাহিত করা হয়। যাকে সাদাকাহ বা খায়রাত বলা হয়। বাংলাদেশে এখন প্রচুর লোক আছেন যারা বহু টাকা-পয়সা ও সম্পদের মালিক। দান করার মতো এমন পরিবেশও বাংলাদেশ ছাড়া অন্যত্র পাওয়া যাবে না। এদেশে যেসব বিত্তশালী পাঁচ দশ কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি অবলীলায় কিনতে পারেন। বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনে ফেলেন ৩০/৪০ কোটি টাকা খরচ করে। কোটি টাকার ঈদ বাজারের জন্য বিদেশে চলে যান। তারা যদি যাকাত নিয়মমতো প্রদান করেন। সাধারণ দান ও সহায়তা করেন। রোজাদারদের ইফতার করান। নিয়মতান্ত্রিকভাবে অভাবিদের সহায়তার উদ্যোগে গ্রহণ করেন। তাহলে এদেশের চেহারা অনেকটাই ভিন্নরূপ নিতে পারে।
এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ যাকাত, ফিতরা, দান-সাদাকাহ করেন বলেই সমাজে মারাত্মক সংকট দেখা দেয় না। বহু বিত্তবান আছেন যারা নিজেদের পরিচিত আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ, মুফতি ও ধর্মীয় মুরব্বীদের পরামর্শে সঠিকভাবে যাকাত প্রদান করেন। অনেক ব্যবসায়ীকে জানি যারা নিয়মিত যাকাত দেন। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এলাকার দরিদ্র ও অসহায়দের সারা বছর দেখাশোনা করেন, ঘরবাড়ি তৈরি করে দেন। ক্ষুদ্র বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেন। বেকারদের কর্মসংস্থা ও বিদেশ যাত্রার ব্যয় নির্বাহ করেন। এসব ব্যবসায়ী ও বিত্তবান সামাজিকভাবে খুবই শান্তিতে আছেন। ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের তাদের শৃঙ্খলা ও প্রশান্তি বিরাজ করে।
আমরা দেশের সব ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিত্তবানদের বলতে চাই, আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করে তার দেয়া সম্পদের হক আদায় করুন। দুনিয়া ও আখেরাতে তৃপ্তি শান্তি এবং মুক্তিলাভ নিশ্চিত করতে হিসাব করে যাকাত দিন। রমজানে যাকাত দিয়ে ৭০ গুণ বেশি সওয়াবের সুযোগ নিন। যাকাত ছাড়াও সাধারণ দান ও জনকল্যাণে ব্যয় করে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করুন। কারণ দুনিয়ার বাস্তবতার বিবেচনায় আপনার সামনে এখন দু’টি পথই খোলা আছে। এক. সময়ের ব্যবধানে সম্পদ আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে, দুই. অথবা আপনি সম্পদ রেখে খালি হাতে চলে যাবেন। যদি আপনি সম্পদের সদ্ব্যবহার করে যেতে পারেন তাহলে আপনার সম্পদ আপনার সাথেই থাকবে। যাকাত সম্পদ ও জানমালের নিরাপত্তা দেবে। সাদাকাহ বিপদ দূর করবে। যখন দুনিয়া থেকে চলে যাবো তখন এ দান-সাদাকাহ বিপদ দূর করবে। যখন দুনিয়া থেকে চলে যাবো তখন এ দান-সাদাকাহ ও যাকাতই আমাদের সঙ্গে যাবে। সম্পদ দিয়ে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ও মানবতার কল্যাণের চেয়ে উত্তম আর সুন্দর আর কোন কাজটিইবা করার আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মানসুর আহমেদ ২৯ জুন, ২০১৬, ১:০০ পিএম says : 0
আল্লাহ আমাদের সকলকে ঠিক মত যাকাত দেয়ার তৌফিক দান করুক।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন