শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাসযোগ্য সমাজ ও টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্র ও সুশাসন

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

অতিমাত্রায় কার্বণ নিঃসরণের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ও পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে বাসযোগ্যতা ক্রমে হুমকির মুখে পড়ছে। পৃথিবীব্যাপী নানাভাবে, নানা মাত্রায় পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ড চলছে। অপরিকল্পিত কৃষি, সেচ প্রকল্প, নদী শাসন, বড় বড় ড্যাম নির্মাণ, পানি প্রত্যাহার, মাত্রাতিরিক্ত ফসিল জ্বালানির ব্যবহার, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন, নদী ও জলাশয় দখল-ভরাট থেকে শুরু করে নাগরিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা থেকে শুরু করে উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে চলছে পরিবেশ, জলবায়ু ও জনস্বাস্থ্য বিধ্বংসী তৎপরতা। পানি, মাটি, বায়ু দূষণের সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য, নিঃস্বাশ ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। আমরা সারা বিশ্বের পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের চিন্তা করছি বটে, তবে এই দূষণ ও নিরাপত্তাহীনতার মাত্রাটি দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশে প্রকট আকার ধারণ করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ কোনো শিল্পোন্নত দেশ নয়। এখানে প্রতিদিন মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয় না। দেশের জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান এখনো কৃষির চেয়ে বেশি নয়। বাংলাদেশ মরুভূমির দেশ নয়। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের শত শত নদী বাহিত পলিমাটিতে সুজলা-সুফলা সবুজ দেশ। বাংলাদেশ কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধ-সংঘাতে বিধ্বস্ত নয়। তাহলে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর মরুভূমি বা যুদ্ধবিধ্বস্ত নিরাপত্তাহীন শহরগুলোর চেয়েও অনিরাপদ হয়ে উঠল কেন? এখনকার নতুন প্রজন্ম এই প্রশ্ন করছে। গত ৫ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় স্থান পাচ্ছে। গত বছর বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান ছিল ১৩৭ নম্বরে। লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে প্রকাশিত জরিপে বিশ্বের বাসযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থানে ছিল অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, দ্বিতীয় স্থানে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, এরপর মেলবোর্ন, জাপানের ওসাকা ও কানাডার ক্যালগরি, ভ্যাঙ্কুভার ও টরেন্টো। অন্যদিকে তালিকায় সর্বনি¤œ স্থানে থাকা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার পরে আছে নাইজেরিয়ার লাগোস এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। দামেস্ক কেন বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে তা অজানা নয়। আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চলে অবস্থিত নাইজেরিয়ার প্রধান শহর লাগোসের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৭ হাজার জন। সেখানে ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ৪৭ হাজার জন। মেট্টোপলিম ও মেট্টোপলিটান এরিয়ার আয়তনের হিসেবে লাগোস ঢাকার চেয়ে অনেক বড়। দ্রত বর্ধনশীল অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র লাগোস নাইজেরিয়ার প্রধান সমুদ্র বন্দর, পাশাপাশি এটি তাদের শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্র। অন্যদিকে দেশের সমুদ্র বন্দর ও বাণিজ্যিক রাজধানী থেকে অনেক দূরে এবং অবস্থিত অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ সিটি ঢাকার চারপাশে নদ-নদী, দেশের সব প্রান্তের সাথে সুগম যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার পরও কেন ঢাকা বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট শহরের তালিকায় স্থান পাচ্ছে তা বুঝা নগরবিদ ও পরিবেশবাদীদের জন্য কষ্টকর নয়। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতি, অপরিকল্পিত ও কেন্দ্রীভূত নগরায়ন, শিল্পায়ন, আবাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান, প্রশাসনিক বিন্যাসের কারণে ঢাকাকেন্দ্রিক জনবিস্ফোরণ ও সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা একসময়ের মনোরম-সম্ভাবনাময় ঢাকা নগরীকে রিক্সার নগরী, ভিক্ষুকের নগরী ও যানজটের নগরীতে পরিণত করেছে। সারাদেশের বেকার, কর্মহীন, নদীভাঙ্গনে নিঃস্ব এবং সাম্প্রতিক স্বচ্ছল মধ্যবিত্তরা সন্তানদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার অন্বেষায় প্রতিদিন ঢাকায় বসতি গাড়ছে। ফলে রেললাইনের পাসের বস্তি থেকে শুরু করে শহরের প্রান্তিক ও অভিজাত এলাকায় জনসংখ্যা ও আবাসনের ঘনত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

ঢাকায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, ক্রমবর্ধমান যানজট, নাগরিক সংকট, দূষণ ও নিরাপত্তাহীনতা দেশের সামগ্রিক অবস্থা থেকে কোনো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সামনে রেখে প্রথমতঃ বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রফতানিমুখী রেডিমেড গার্মেন্টস কারখানার উপর দাঁড়িয়ে যে অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল, অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে তার মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল রাজধানী ঢাকা শহর। নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাস্তু বিশারদরা সেই আশির দশক থেকেই ঢাকার শিল্পায়ন, শিক্ষায়তন ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উপর জোর দিয়ে আসলেও কোনো সরকারই তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এ কারণেই সারাদেশের শিক্ষিত বেকার, কর্মহীন দরিদ্র মানুষ, মধ্যবিত্ত ও নব্যধনী সম্প্রদায় ঢাকাকেই তাদের কাক্সিক্ষত বাসস্থান ও ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়। সীমিত রাস্তা, আবাসন ব্যবস্থা, ইউটিলিটি সার্ভিসের উপর ক্রমবর্ধমান এই মানুষের চাপে ঢাকার নাগরিক জীবনের গতিশীলতা ভেঙ্গে পড়েছে। ভেঙ্গে পড়া এই জনপদে নদী, পার্ক, খাল, জলাভূমি ও উন্মুক্ত স্থানগুলোর উপর দখলদারিত্ব কায়েম করে দিব্যি আয়েশি জীবন যাপনের রসদ জমাচ্ছে একশ্রেণির লুটেরা মানুষ। ব্যাংক থেকে পাঁচ-দশ হাজার টাকা কৃষি ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পারায় দেশের হাজার হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়, সারা জীবন সৎ জীবন যাপন করেও তাদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। অন্যদিকে নদী, বিল, খাল, রেলওয়ে, বনভূমিসহ সরকারি সংস্থার জমি দখল, ব্যাংকের আমানত, শেয়ার বাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে দেশের অর্থনীতি ফোকলা করে দেয়ার পরও এসব অভিযুক্তদের বিচার হয় না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের রাজধানী শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। রাজধানীর সাথে পাল্লা দিয়ে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের হাওয়া দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা শহরেও লেগেছে। এর ফলে জমির মূল্যবৃদ্ধি ও দখলদারিত্বের পরিধি সারাদেশেই বিস্তৃত হয়েছে। এভাবে রাজধানী থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে পুরো দেশই দখলে-দূষণে বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করেছে। স্টেপ অব গ্লোবাল এয়ার রিপোর্ট-২০১৯ এর আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে দূষিত বায়ুর দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। বায়ু দূষণে স্বাস্থ্য সমস্যা ও মৃত্যু হারের দিক থেকেও বাংলাদেশ অন্যতম। এ ক্ষেত্রে অঞ্চল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া শীর্ষে রয়েছে। এরপর রয়েছে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু অঞ্চলের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে ভারতের দিল্লি, পাকিস্তানের করাচি ও চীনের বেইজিং শীর্ষ স্থানে থাকলেও শুধু ঢাকা শহরই নয় পুরো বাংলাদেশের বায়ুর মান জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুসারে বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ু সেবন করছে। দেশের সব মানুষের দূষিত বায়ুতে বসবাসের এই বাস্তবতা কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। এটি মানব সৃষ্ট সংকট। দখলদারিত্ব বন্ধ করে আইনের শাসন, জবাবদিহি ও সুষ্ঠ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব নয়। আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভুটান তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। যেখানে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে বাতাস ভয়ঙ্কর রকম দূষিত হয়ে পড়েছে, সেখানে ভুটানের বাতাস ও পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উন্নত ও স্বাস্থ্য সম্মত বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। গতানুগতিক ও তথাকথিত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এড়িয়ে নিজেদের জন্য নিজেদের মতো উন্নয়ন মানদন্ড নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভুটান বিশ্বের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

উন্নয়নের গতানুগতিক সংজ্ঞা ও ধারণা থেকে অনেক আগেই বিশ্ব নেতারা সরে এসেছেন। ভুটানের জিএনএইচ(গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) ধারণা এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। সত্তরের দশকের শুরুতে সারাবিশ্ব যখন পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তখন দক্ষিণ এশিয়ার অতি দরিদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটানের রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক নিজ দেশে জিএনএইচ ধারণা তুলে ধরেন। তিনি তথাকথিত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার বাইরে থেকে দেশের মানুষের সামগ্রিক নিরাপত্তা, সুখী জীবন যাপন ও পরিবেশগত সুরক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জিডিপি ও জিএনপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটাই হচ্ছে জিএনএইচ ধারণার মূল কথা। ভুটানের রাজারা এই নীতি ধরে রেখে নিজেদেরকে গতানুগতিক প্রতিযোগিতার বাইরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এ কারণেই ভুটানের জনগণ অনেক উন্নত রাষ্ট্রের নাগরিকদের চেয়েও সুখী এবং ভুটানের বাতাস শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর চাইতে অনেক বেশি নির্মল ও দূষণমুক্ত। গত কয়েক দশকে উন্নয়নের গতানুগতিক ধারণায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এক সময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এমডিজি বা সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ সেসব লক্ষ্যমাত্রার অনেক কিছুই বাস্তবায়নে কৃতিত্বের দাবি করছি। কিন্তু সে সব উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়ন কৌশল কতটা উন্নয়ন আর কতটা পরিবেশগত ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার বিষয়। গতানুগতিক উন্নয়ন ধারণা ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা বিশ্বকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ কারণে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) ২০১৫ সালে এসডিজি বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল তুলে ধরে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭টি সূচকে উন্নয়নের মান অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে পরিবেশগত নিরাপত্তা, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা এবং আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ সুন্দর বাসস্থান ও দেশ গড়ে তোলাই এসডিজি’র মূল লক্ষ্য। দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব, সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ (গুড হেল্থ এন্ড ওয়েলবিইং), মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা, লৈঙ্গিক বৈষম্য দূরকরণ, নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা, সুলভে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতের যোগান (ক্লিন এনার্জি), কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়ন-উদ্ভাবন ও অবকাঠামো উন্নয়ন, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন, টেকসই নগর ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ ও সামঞ্জস্য বিধান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ, জলজ প্রাণ ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ, ভূমি-ভূপ্রকৃতি ও ইকোসিস্টেম রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, শান্তি-ন্যায়বিচার ও প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা এবং এসব লক্ষ্য অর্জনে পারস্পরিক অংশিদারিত্ব নিশ্চিত করা। টেকসই উন্নয়নের এই ১৭টি লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ও প্রতিবন্ধকতাগুলো সহজেই দৃশ্যমান। যদিও ইউএনডিপির টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাই শেষ কথা নয়। আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের সব সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় রেখেই আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে আমাদের সর্বাধিক কল্যাণ নিহিত।

আমাদের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে একদিকে বেøইম গেম, অন্যদিকে উন্নয়নের নানাবিধ উপযোগ-উপসর্গ বর্ণিত হচ্ছে। দেশ উন্নয়নের মহাসরণিতে এগিয়ে যাচ্ছে, এমন পারসেপশন তৈরির বহুবিধ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, পাশাপাশি বিচারহীনতা, অবক্ষয়-বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা, নিরাপত্তাহীনতা, দখল-লুণ্ঠন, অর্থপাচার ও সর্বগ্রাসী দূষণের সর্বাত্মক তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও দূষণ-দখল, দুর্নীতি ও সামাজিক-রাজনৈতিক অনাচার অবিচার অতীতের সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নারী ও শিশুরাও ধর্ষণ এবং পৈশাচিক হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক মতভিন্নতা প্রকাশের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একজন আরেকজনের দ্বারা প্রকাশ্য আক্রান্ত, নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের শিকারে পরিণত হচ্ছে। এক শ্রেণির শিক্ষককে শিক্ষা দানের চেয়ে রাজনৈতিক তেলবাজি ও ধান্দা ফিকিরে বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা টর্চার সেল ও লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তুলেছে। খুন-ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, র‌্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের যেনতেনভাবে নির্যাতন করাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সীমান্ত পথে মাদকের অবাধ অনুপ্রবেশ এবং বিদেশি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে অবাধ আকাশ সংস্কৃতি এবং ইন্টারনেটে ধর্ম বিদ্বেষী মূল্যবোধ, অশ্লীলতা ও পর্নগ্রাফিতে নতুন প্রজন্মকে আসক্ত করে তোলার অনুকূল পরিবেশ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও ধর্ষণের মতো অপরাধের বিস্তার ঘটাচ্ছে। শ্রেণি-পেশা, দলমত নির্বিশেষে পুরো সমাজই এই সামাজিক মহামারীতে আক্রান্ত হলেও একটি শ্রেণি নিজেদের আইন, বিচার, জবাবদিহি ও ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে বলে মনে করার কারণে নানা অপরাধের সাথে তাদের নাম উঠে আসছে। ঢাকার চারপাশের সবগুলো নদীর পানি দূষণের সব মাত্রা অতিক্রম করেছে। বুয়েটে আবরার হত্যাকান্ড, ক্যাসিনো কান্ড, ডাকসু ভবনে ঢুকে ভিপি নুরুল হক নুরের উপর হামলা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিন-চার সন্তানের মা, ছাত্রী, শিশু ধর্ষণের সাথে জড়িত যাদের নাম উঠে আসছে তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় ও পদ পদবী ধারণ করছে। কোনো বিচ্ছিন্ন অভিযান বা পুলিশি ব্যবস্থায় এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমাদের বহুমুখী সামাজিক-রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যার একটাই একটাই ধন্বন্তরী সমাধান, তা হচ্ছে সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। উন্নয়নশীল বিশ্বের সর্বোচ্চ ফোরাম ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট) কর্তৃক গুড গবার্নেন্স বা সুশাসনের যে প্যারামিটার তুলে ধরা হয়েছে তা হচ্ছে: ১. ল্যাজিটিমেসি অব গবার্মেন্ট বা সরকারের বৈধতা, ২. অ্যাকাউন্টিবিলিটি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড অফিসিয়াল এলিমেন্টস অব গর্ভনমেন্ট বা সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, ৩. নীতি নির্ধারণ ও কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের দক্ষতা নিশ্চিত করা এবং ৪. মানবাধিকার এবং আইনের শাসন সমুন্নত করা। সুশাসনের প্যারামিটার নির্ধারণে বিশ্বব্যাংকের মানদন্ডে ওইসিডি নির্ধারিত সুচকগুলোসহ আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা এসেছে। সেখানে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে সুশাসনের এক নম্বর শর্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সমাজের সব মত ও পথের মানুষের মতামত ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই কেবল সরকারের ক্ষমতায়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীন ও শক্তিশালী জুডিসিয়ারি এবং জনপ্রশাসন ও আমলাতান্ত্রিক কর্মকান্ডের স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করতে সিভিল সোসাইটি তথা সব স্তরের প্রতিনিধিত্বশীল নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা, অংশগ্রহণ ও মতামত গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতের নাগরিকদের জন্য উন্নত, বাসযোগ্য সমাজ বিনির্মাণে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইনের শাসন নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। আমরা এমন সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে চলেছি, যখন দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিচার ব্যবস্থা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, জননিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাধাগ্রস্ত। বছরের শুরুতেই রাজধানীর দুই অংশের সিটি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো আবারো পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে। যদিও এ পরীক্ষা ইতোমধ্যেই নানাভাবে অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। বিরোধীদলের একজন মেয়র প্রার্থী ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগ তুলেছেন। ইতোমধ্যে বেশকিছু কাউন্সিলর প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রভাব খাটিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার এবং প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীকে অপহরণ করে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনার খবর ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। গত এক দশকে নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতির পাশাপাশি অবক্ষয়, দূষণ, হুমকি ও নিরাপত্তাহীনতা দৃশ্যমান হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নির্বাচন ও প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন, সুশাসন ও বাসযোগ্য নগরী ও রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এবারের ঢাকা সিটি নির্বাচনে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখতে চায় দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন