বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ওয়াকফ জনকল্যাণ এবং কিছু প্রস্তাব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ১৭ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

এক
‘ওয়াকাফ’ অর্থ স্থির করা বা নির্ধারণ করা বা নিরোধ। ইংরেজীতে বুঝানো হয় মৎধহঃ ভড়ৎ ৎবষরমরড়ঁং ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব অর্থাৎ দীনি উদ্দেশ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান করাই ওয়াকাফ। ‘ওয়াকাফ বলিতে ইসলাম ধর্মীয় কোন ব্যক্তির দ্বারা স্থাবর কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি মুসলিম আইনে স্বীকৃত যেই কোন ধার্মিক, ধর্মসম্বন্ধীয় অথবা দাতব্য উদ্দেশ্যে চিরতরে উৎসর্গ করাকে বুঝাইবে এবং ইহাতে অমুসলমান ব্যক্তি কর্তৃক পূর্ব বর্ণিত উদ্দেশ্যে অপর যেই কোন দানকেও বুঝাইবে। তবে স্মরণাতীত কাল হতে জনকল্যাণে বা দীনি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এরূপ সম্পত্তিও আইনানুসারে ওয়াকফ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। ‘যদি কোন জমি স্মরণাতীতকাল হইতে ধর্মীয় ব্যাপারে ব্যবহৃত হইয়া আসিতে থাকে যথা মসজিদ কিংবা কবরস্থান, তাহা হইতে উহা উৎসর্গীকৃত করার কোন প্রমান না থাকিলেও উহাকে ব্যবহার দ্বারা ওয়াকফ হিসাবে ধার্য করা হইবে।
ইসলামে আল্লাহর পথে (বিভিন্ন খাতে) অকাতরে দান করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাতে ওয়াকফের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। ইসলামী আইন অনুসারে একজন ব্যক্তি তাঁর মৃত্যুর সময় রেখে যাওয়া সম্পত্তির ৩/১ অংশ জনকল্যাণ বা যে কোন দীনি উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য ওয়াকফ করতে পারেন। কিংবা এই পরিমান সম্পদ নির্দিষ্ট করে এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিকে দান করতে বলতে পারেন যাদের জন্য ইসলামে মীরাসের অংশ নির্দিষ্ট নেই। শেষোক্ত দানকে হেবা বলা হয়। ওয়াকফ বা হেবার মধ্যে কিছুটা সাদৃশ্য আছে। মৃত্যুর সময় ছাড়াও যেকোন সময় এরূপ দান করা যায়। মৃত্যুর পর বন্টনের জন্য অসিয়ত করলে এ দান ৩/১ অংশের বেশী করা যায় না। তবে অন্য সময় করলে আরো বেশী করা যেতে পারে। কিন্তু এত বেশী করা যাবে না যাতে মীরাসের অধিকারীদের ক্ষতিগ্রস্থ হবার আশংকা থাকে। এরূপ হলে ওয়াকফকারী বা ওয়াকিফ গোনাহগার হবেন। ওয়াকাফ করার ক্ষেত্রে সাধারণত নিরোধকৃত সম্পদের ব্যয়ের খাতগুলো বলে দেয়া হয়। কিন্তু হেবার ক্ষেত্রে সাধারণত খাত বলা হয় না। যাকে দান করা হয় তার স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছার উপর সব ছেড়ে দেয়া হয়।
ইসলামী ওয়াকফ আইনের ব্যাপক আলোচনা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তবে প্রাসঙ্গিকতার স্বার্থে ইসলামে ওয়াকফের গুরুত্ব সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা জরুরী মনে করছি। ইসলামে আল্লাহর পথে অর্থদান বিষয়টির বাস্তবায়নের জন্য দুইটি নীতি ও প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আখিরাতের চেতনা ও মানবীয় মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ এবং আইনগত প্রক্রিয়া পরিচালনা।
নবম হিজরী পর্যন্ত প্রথমোক্ত পলিসির চর্চার পর আইনগত প্রক্রিয়া জারী করা হয়। দানশীলতাকে আল-কুরআনে হেদায়েত প্রাপ্তির জন্য শর্ত হিসেবে বিবৃত করা হয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে দান না করা বা পরোপকার না করাকে জাহিলী বৈশিষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। গ. নবম হিজরীর পূর্বে মাক্কী ও মাদানী অসংখ্যা আয়াতে যাকাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অবশ্য তখন যাকাতের পরিমাণ নির্ধারিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে হাÑমীম আস সাজদার আয়াতদ্বয় (৬ ও ৭ নং) খুবই তাৎপর্যববহ। ‘ধ্বংস হয়েছে মুশরিকরা যারা যাকাত দেয়না’। প্রশ্ন হতে পারে যে মুশরিকরা কেন যাকাত দিবে? আসলে এখানে বুঝানো হয়েছে যে, যাকাত তথা আল্লাহর পথে অকাতরে অর্থব্যয় মুমিনদের বৈশিষ্ট; মুশরিকদের নয়। ওয়াকফ ইসলামের মানব কল্যাণ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মৃত্যুর পর বন্টনের ক্ষেত্রে সম্পদের ৩/১ অংশ পর্যন্ত ওয়াকফ করা যায়। কিছু হাদীসের ভিত্তিতে অনেক মুহাদ্দিস ও ফকীহ মানবকল্যাণ ও আত্মীয় স্বজনদের (যারা মীরাসের অধিকারী নয় তাদের ক্ষেত্রে) জন্য অসিয়ত করাকে ওয়াজিব মনে করেন।
হযরত আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী স.Ñকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার আম্মা হঠাৎ করে মারা যান। আমার মনে হয় কথা বলতে পারলে তিনি সদকা করতেন। আমি কি তার পক্ষ হতে সদকা আদায় করতে পারব? রসূলুল্লাহ স. বললেন, “হ্যাঁ, তুমি তার পক্ষ হতে সদকা আদায় কর।” সা’দ ইবনে ওয়াক্কাস বলেন, শেষ হজ্জের বছরে রসূলুল্লাহ স. আমাকে অনেকবার মক্কায় দেখতে এসেছেন। আমি ভীষণ অসুস্থ থাকায় তিনি দেখতে এসেছেন। আমি রসূলুল্লাহ স.Ñকে বললাম, আমার শুধু একটি মেয়ে আছে, আর কেউ নেই। আমার সম্পত্তি অঢেল। আমার অসুস্থতা বেড়ে যাচ্ছে। আমি কি আমার সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ দাতব্য কাজের জন্য অসিয়ত করে যাব? রসূলুল্লাহ স. বললেন, না। আমি বললাম, অর্ধেক? রসূলুল্লাহ স. বললেন, না। তারপর বললেন, তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে দাও। যতটুকুই দাও না কেন আল্লাহ তোমাকে পুরস্কার দিবেন। আর তোমার ওয়ারিসদের ভিখারী করে রেখে যেও না, সেটা ভালো নয়।
প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, রসূলের স. যুগেই আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলামের অমীয় ঝর্ণাধারা বাংলার প্রবেশ করেছে। তবে এখানে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয় ভারত সম্রাট কুতুবউদ্দীন আইবেকের সময়ে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির অভিযানের মাধ্যমে, ১২০৩ খৃস্টাব্দে। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চল রংপুর নামক রাজধানী স্থাপন করেন। তবে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল তাঁর শাসনের বাইরে ছিলো। এর শতাব্দীকালেরও বেশ পরে ১৩৩০ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদ তোগলোক শাহ পূর্বাঞ্চল জয় করেন এবং সাতগাও ও সোনরাগাঁও এ যথাক্রমে রাজধানী স্থাপন করেন। অতঃপর সোনারগাঁও এর স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮Ñ৪৯ খৃ.) চট্টগ্রাম জয় করেন। এভাবে পুরো বাংলাদেশ ইসলামের ছায়াতলে এসে যায়। তবে এর বহু পূর্বেই চট্টগ্রামে ইসলাম প্রবেশ করে। বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর ১৭৫৭ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ৫৫৪ বছরে ১০১ জন বা ততোধিক শাসক বাংলা শাসন করেন। এ সময়ে ওয়াকফ সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে এ অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি সাধন ও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিলো তার কিছু চিত্র আমরা পেশ করছি। ‘বাংলার সুলতানগণ বিদ্যাশিক্ষার প্রতি অধিকতর অনুরাগী ছিলেন এবং শিক্ষা প্রসারের জন্য তাঁরা সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম জমিদার, লাখেরাজদার, আয়মাদার প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত মুসলিম প্রধানগণ তাদের নিজ নিজ এলাকায় মক্তব, মাদরাসা কায়েম করতেন এবং এসবের ব্যয়ভার বহনের জন্যে প্রভূত ধনসম্পদ ও জমিদার দান করতেন। ‘বাংলার প্রথম সুলতান মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী এবং তিনি দিল্লী সম্রাট কুতুবউদ্দীন আইবেকের অনুকরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
‘ড. অফধস বলেন, রাজশাহী জেলার কসবা বাঘাতে বিয়াল্লিশটি গ্রাম দান করা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনসেবামূলক কাজের জন্য। (অফধস, ংবপড়হফ ৎবঢ়ড়ৎঃ, চ.৩৭)। কসবা বাঘার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব ছাত্র পড়াশুনা করতো তাদের যাবতীয় খরচপত্রাদি যথা-বাসস্থান, আহার, পোষাক পরিচ্ছদ, বই পুস্তক, খাতাÑপেন্সিল, কালিÑকলম, প্রসাধন প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বহন করা হতো।’ ‘গোলাম হোসেন তাঁর ইতিহাসে বর্ণনা করেছেন যে, মুর্শীদখুলী খাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বীরভূমের আসাদুল্লাহ নামক জনৈক জমিদার তাঁর আয়ের অর্ধাংশ জ্ঞানী ব্যক্তিদের ভরণপোষণ এবং অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতেন।’
‘ধনবান সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে এ প্রথাও বিদ্যমান ছিলো যে, তাঁরা উপযুক্ত গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে তাদের সন্তানাদির বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। দরিদ্র ছাত্রগণও বিনা পয়সায় তাদের নিকট শিক্ষা লাভ করতে পারতো। পান্ডুয়াতে এ নিয়ম প্রচলিত ছিলো যে, মুসলিম ভূস্বামীগণ তাঁদের নিজেদের খরচে প্রতিবেশী দরিদ্র ছাত্রদের বিদ্যাশিক্ষার জন্যে শিক্ষক নিযুক্ত করতেন। এমন কোন বিত্তশালী ভূস্বামী অথবা গ্রামপ্রধান ছিলেন না, যিনি উক্ত উদ্দেশ্যের জন্যে কোন শিক্ষক নিযুক্ত করেননি।’ ‘প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমুদয় ব্যয়ভার একজন ব্যক্তি বহন করতেন, সরাসরিভাবে অথবা দান, ওয়াকফ বা ট্রাস্টের মাধ্যমে।’ ‘ড. অফধস এর রিপোর্টে এ কথাও সুস্পষ্টরূপে জানা যায় যে, সেকালে অতি সুলভে এমনকি বলতে গেলে বিনে পয়সার শিক্ষা লাভ করা যেতো।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Iqbal ১৮ জানুয়ারি, ২০২০, ১০:০০ এএম says : 0
আর্টিকেলের শিরোনাম দেখে পড়তে এসেছিলাম, এবিষয়ে জানার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন। কিন্তু হায়! সঠিক সম্পাদনার অভাবে লেখাটি গুরুত্বহীন হয়ে গেল; বানান ভুল, নামে ভুল, মনে হচ্ছে কোন বাক্যের পর কোন বাক্য আসবে তাও দেখা হয় নি ঠিকমত। তাই কিছু অংশ পড়ার পর, আর বাকিটা পড়ার আগ্রহ পেলাম না।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন