বন্দরনগরী চট্টগ্রামের গুরুত্ব দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে। চট্টগ্রামকে ‘সিঙ্গাপুর সিটি’ করার স্বপ্নও দেখানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্বভার স্বয়ং গ্রহণ করার ঘোষণা আগেই দিয়েছেন একাধিকবার। প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক আগ্রহে চট্টগ্রাম মহানগরীর উন্নয়ন ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গত এক দশকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়েছেন বিভিন্ন খাত উপ-খাতওয়ারি। অথচ ৬৫ লাখ নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী নানামুখী দুর্ভোগ-যন্ত্রণা। সড়ক, রাস্তাঘাটের দুর্দশা, অপ্রতুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল, গণপরিবহন সঙ্কট ও লাগামছাড়া বিশৃঙ্খলা, খাল-ছরা-নালা-নর্দমা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী ও হালদা নদী বেদখল-দূষণ-ভরাট, পার্ক খেলার মাঠসহ সুস্থ চিত্ত বিনোদনের জায়গার অভাব, যত্রতত্র বাজার-মার্কেট, আবর্জনার ভাগাড় ইত্যাদি মিলে চট্টগ্রাম দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
শুধু তাই নয়। নামে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ বলা হলেও বাস্তবে কোনো একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় নেই চট্টগ্রামে। শিল্প, বিনিয়োগ, আমদানি-রফতানি, শিপিং, কাস্টমস, ইপিজেড ইত্যাদি ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন সংশ্লিষ্ট মামুলি কাজে সিদ্ধান্তের জন্যও ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী কিংবা শিল্পোদ্যোক্তাদের দৌড়িয়ে হয়রান হতে হয় রাজধানী ঢাকায়। এসব প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রামের কার্যালয়গুলো বাস্তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাহীন অর্থাৎ ভোঁতা করে রাখা হয়েছে। এ কারণে অনেক আগেই বহুজাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তল্পিতল্পা গুটিয়ে তাদের হেড অফিস ও কর্পোরেট অফিস ঢাকায় স্থানান্তর করে নিয়ে গেছে। বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তারা সপ্তাহে কিছুদিন ভাগ করে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অফিস করেন। অথবা ফ্লাইটে আপ-ডাউন করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন কোনমতে।
সবচেয়ে দৃশ্যমান দিক হচ্ছে সার্বিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে প্রাচ্যের রাণী খ্যাত অপরূপ প্রকৃতির নিটোল ঠিকানা চট্টগ্রাম মহানগরী এবং আশপাশের বিশাল এলাকা। ভূমিগ্রাসীদের হাতে বিরান হয়ে যাচ্ছে একের পর এক পাহাড় টিলা, বন-জঙ্গল, নদ-নদী, ঝরণা-হ্রদ, পুকুর-জলাশয়-দীঘি। চট্টগ্রামে নাগরিক ‘সেবা’ দানকারী সরকারি আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, ওয়াসা, স্বাস্থ্য বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ বিভাগসহ ২২ প্রতিষ্ঠান। এসব সরকারি সংস্থার মধ্যকার নেই কোনো সুষ্ঠু সমন্বয়। জবাবদিহিতাও অনুপস্থিত। এ অবস্থায় অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়নের পরিণতিতে নাগরিক দুর্ভোগ বাড়ছেই প্রতিনিয়ত।
দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অভিমুখে কাজের সন্ধানে জনস্রোত বেড়েই চলেছে। অথচ সেই তুলনায় বাড়ছে না আবাসন ও প্রয়োজনীয় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, সড়ক ও অলিগলি, পার্ক-বিনোদন, স্কুল কলেজ, মাদ্রাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা মিলে ন্যুনতম অপরিহার্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।
ইউএনডিপি, গৃহায়ন অধিদফতর, সিডিএ, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন জরিপ তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, দেশের বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম এ মহানগরীতে প্রতিনিয়ত ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে জনসংখ্যা। প্রতিবছর গড়ে যোগ হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ নবাগত মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর, শিল্প-কারখানা, পরিবহন, শিক্ষা, প্রশাসনিক সব কাজকর্মের গুরুত্ব ঘিরে চট্টগ্রাম মহানগর অভিমুখী জনস্রোত অব্যাহত রয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে জনসংখ্যার চাপ ও আবাসন চাহিদা বাড়ছে সমানতালে। জনসংখ্যার ভার এবং নাগরিক চাহিদার বিপরীতে পরিকল্পিত নগরায়ন জরুরি। অথচ বাস্তবে তা উপেক্ষিত। এলোপাতাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি ও হরেক রকমের স্থাপনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামের ভারসাম্যের প্রধান ধারক সারি সারি পাহাড়-টিলা কেটে ফেলে অবাধে চলছে ধ্বংসলীলা।
এর ফলে চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, পরিবেশ-প্রতিবেশগত বৈশিষ্ট্যাবলী হারিয়ে যাচ্ছে। পাহাড় বনাঞ্চল সাগর নদ-নদী উপত্যকা ও উপকূল মিলে পরিবেশ-প্রকৃতির ধারকগুলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অপরিণামদর্শী মানব আগ্রাসনে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে নিটোল প্রকৃতি। যথেচ্ছ বাড়িঘর ছড়িয়ে পড়ছে দোকান-পাট, গুদাম, কল-কারখানা, ওয়ার্কশপ, বাণিজ্য ও বিপণিকেন্দ্র। সবই হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। চট্টগ্রাম হারাচ্ছে তার আকর্ষণ। নগরজীবন হয়ে উঠেছে নাগরিক ভোগান্তিতে বেসামাল।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ বলেন, চট্টগ্রামের পরিকল্পিত ও দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন প্রয়োজন। এর জন্য নাগরিক সেবা ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ও প্রয়োজন। চট্টগ্রামের ভূ-প্রকৃতি সুরক্ষা করেই পরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো উপেক্ষা করা হলে তা আত্মঘাতী বিপর্যয় ডেকে আনবে। রেগুলেটরি ও সহায়ক ভূমিকা প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে। দরকার সুষ্ঠু জবাবদিহিতার।
ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝিতে এদেশের অন্যতম প্রাচীন পৌর শহর হিসেবে ১৮৬৩ সালের ২২ জুন ‘দি চিটাগাং মিউনিসিপ্যালটি’ সূচনা হয়। তখন মাত্র ৬ বর্গমাইল আয়তনের ৫টি ওয়ার্ড নিয়ে শহরটি প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ১৮৬৯ সালের আদম শুমারিতে চট্টগ্রাম শহরে জনসংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫৯৮ জন। দেড়শ’ বছর পর ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে লোকসংখ্যা প্রায় ৬৫ লাখে দাঁড়িয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন