মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা

পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের দৌরাত্ম্য

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০০ এএম

পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের দৌরাত্ম্য ও সাধারণ মানুষের অসচেতনতার কারণে দেশের সড়ক মহাসড়কে ঘটেছে একের এক সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক ব্যবস্থাপনায় তৈরি হয়েছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। দুর্ঘটনায় রোধে রাজপথে নেমে এসেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী শুরু করেছিল টানা আন্দোলন।
উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয় বিভিন্ন পদক্ষেপ। সরব হয়েছিল পরিবহন মালিক সমিতিও। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আসে ১৭ নির্দেশনা। সংসদে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন। কিন্তু এতো কিছুর পরও কিছুটা শৃঙ্খলা আনা গেলেও তা টেকসই হয়নি। বরং প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ছোট-বড় একাধিক দুর্ঘটনা। সড়কে মৃত্যুর মিছিলই বলে দিচ্ছে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেনি।

গত শুক্রবার যশোরে প্রাইভেটকার বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ধাক্কা লেগে দুই বোনসহ তিনজন নিহত হয়। এই সময় শিশুসহ আরও তিনজন আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত একটার দিকে যশোর শহরের বিমান অফিস মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। একই দিনে রাজধানীতে বাসের ধাক্কায় মামা ভাগ্নে প্রাণ হারান। এছাড়ও শুক্রবার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের শান্তিরহাট সংযোগ সড়ক এলাকা শ্যামলী পরিবহন ও পটিয়ার একটি লোকাল বাসের মধ্যে দুই জন নিহত হয়। সা¤প্রতিক এসব সড়ক দুর্ঘটনা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে সারাদেশে গত বছর ৫,৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭,৮৫৫ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৩ হাজার ৩৩০ জন। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ১৮ দিন পর্যন্ত সারাদেশে দুর্ঘটনায় প্রায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ২৬০ জন যাত্রী।
গবেষকদের মতে, সড়কের সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গাড়ি, বেপরোয়া গতি ও ওভারটেকিংয়ের কারণেই দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ আদালত মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞার পরও সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে চলছে ফিটনেসবিহীন লক্কর ঝক্কর বাস, চলছে চালক হেলপারদের দৌরাত্ম্য। চালকদের সিগনাল না মানা, যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো, পাল্লা দিয়ে ছুটে চলার প্রবণতা এখনও বহাল আছে। ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করে হাত উঁচিয়ে গাড়ি থামিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার কোনোটাই বন্ধ হয়নি। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে সড়কে ওপর মাঝপথ দিয়ে চলাচল করা। এর সাথে ভাড়া নিয়ে জালিয়াতি, সিটিং ও বিরতিহীনের নামে প্রতারণাতো আছেই।

ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে সারাদেশে যেভাবে সাড়া পড়েছিল, এখন তার সবই ম্লান হওয়ার পথে। কাগজপত্রবিহীন গাড়ি না ধরার জন্য আবার আগের মতোই পুলিশের ওপর প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের চাপ অব্যাহত রয়েছে। তারপরেও কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে যাত্রীদের সচেতনতা মোটেও বাড়েনি। সব মিলে গণপরিবহনে আগের মতোই বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করছে। যা সাধারণ মানুষকে হতবাক ও হতাশ করেছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আইন প্রয়োগে গাফিলতি ও ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতি রোধ করতে না পারলে কোনোদিনই গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। বাসগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের জন্য অনেকাংশে মালিকরাই দায়ী। এমনটাই মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। কারণ মালিকরা প্রতিদিন বাসটি চুক্তিতে চালকদের হাতে ছেড়ে দেয়। ফলে চালকদের মাথায় সবসময় চুক্তির বাইরে আরো বেশি টাকা আয় করার চিন্তা থাকে। তিনি বলেন, সড়ক নেটওয়ার্ক ভালো না থাকায় ট্রাফিক সিগন্যালও কার্যকরী হয় না।

ঢাকা শহরে ২৭৯টি বাস রুট রয়েছে, একথা উল্লেখ করে অধ্যাপক রহমান বলেন, ঢাকার মতো ছোট একটি শহরে এতো বাস রুট থাকার প্রযয়োজন নেই। পুরো শহরকে বাস চলাচলের জন্য চার থেকে পাঁচটি রুটে ভাগ করে প্রতিটি রুটের জন্য একটি করে বাস কোম্পানি গঠন করা যেতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক রহমান। কোম্পানি গঠনের পদ্ধতি অনুসরণ করলে ছয় হাজার বাস দিয়ে আরো বেশি যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে এবং তখন সড়কে কিছু শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে অধ্যাপক রহমান উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, পরিবহন সেক্টরে কবে শৃঙ্খলা ফিরবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, চালকসহ পরিবহন শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মালিকপক্ষকে আমরা তাগিদ দিয়েছি। কিন্তু সেটা ঠিকমতো পালন করা হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।
সরেজমিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘুরে দেখা গেছে মহাসড়কে শুধু বেপরোয়া গাড়ি চালানোর পাশাপাশি অনির্ধারিত স্থানে ঘণ্টার পর ঘন্টা যানবাহন থামিয়ে চালকদের বিশ্রাম, “বে” বা বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের থামার নির্ধারিত স্থানে অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে তোলা, দ্রæতগতির যানবাহনের সাথে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অদক্ষ চালকদের গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতা, কিশোরদের চালকের আসনে বসানো ছাড়াও অপ্রাপ্ত স্কুল, কলেজগামী তরুণদের মোটরসাইকেল নিয়ে মহাসড়কে দ্রুতগতির যানবাহনের সাথে পাল্লাদিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেও প্রতিনিয়ত মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে।

তাছাড়া মহাসড়কের বেশ কিছুস্থানে ইউটার্ন নিষিদ্ধের পরও অবাধে গাড়ি উল্টো পথে ঘুরায় দ্রুতগতির যানবাহন চালকরা অনেক সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম বাজার, টেকনিকেল রাস্তার মাথা, মিয়াবাজার, সদর দক্ষিণের শুয়াগঞ্জ, হৈট্টাল চৌমুহনী, দয়াপুর, বেলতলী, আলেখারচর, ময়নামতি সেনানিবাস, কাবিলা, কোরপাইসহ বিভিন্নস্থানে উল্টোপথ দিয়ে প্রাইভেট, রিক্সা, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন শ্রেনির যানবাহন চলাচল করায় প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে চলাচল করছে মহাসড়কের হাজার হাজার যানবাহন।

মহাসড়কের পদুয়া বাজার বিশ্বরোডে রয়েল কোচ পরিবহনের যাত্রী তোফায়েল আহমেদ দৈনিক ইনকিলাবকে গতকাল বলেন, রাস্তায় নেমে সবাই রাজা। মূলত ট্রাফিক পুলিশ ও পরিবহন মালিকদের কারণে সড়ক থেকে শৃঙ্খলা বিদায় নিয়েছে। পথচারীরাও নিয়ম লঙ্ঘন করে। পুলিশ তৎপর হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকায় তিনটি রুটে চলাচল করে সরকারের এক সাবেক মন্ত্রীর পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানির বাস। সরকার দলীয় দুজন বর্তমান ও একজন সাবেক এমপির নিজ নামেই পরিবহন কোম্পানি আছে। এর বাইরে এমপি পরিবারের সদস্য, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সরকার-সমর্থক কাউন্সিলরসহ ২০ থেকে ২৫ জন নিজ নামে বা পরিবারের সদস্যদের নামে কোম্পানি করে বাস পরিচালনা করছেন।

পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাই, ছাত্রলীগের সাবেক একজন সাধারণ সম্পাদকের কোম্পানির অধীনেও বাস-মিনিবাস চলছে ঢাকায়। আছে একটি বিশেষ জেলার কিছু ব্যক্তির বাস কোম্পানিও। সাধারণ মালিকরা জানান, প্রভাবশালী এসব মালিকের বাসগুলোর চালক শ্রমিকরাও নিজেদেরকে প্রভাবশালীই মনে করে। বেপরোয়া চলাচলে তারা দ্বিধাবোধ করে না। ট্রাফিক পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর এসব প্রভাবশালী মহল কিছুদিনের জন্য নিস্ক্রিয় থাকলে এখন তারা আবার সক্রিয় হয়েছে। এ কারণে পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় দিতে বাধ্য হচ্ছে।

সড়কে শৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে হাইওয়ে পুলিশের পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, নিরাপদের সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরে সড়কে ট্রাফিকের অনেকটা কাজ হয়েছে। আমরা বেশিরভাগ ঠিক করতে পেরেছি। চালকরা আরো সচেতন হলে শৃঙ্খলাটা আরো দ্রুত ফিরতো। শুধু মামলা দিয়ে নয়, অন্যান্য সমস্যাও রয়েছে সেগুলো সমাধানের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরাতে কাজ অব্যাহত আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Nannu chowhan ১৯ জানুয়ারি, ২০২০, ৭:৫৩ এএম says : 0
Amar mone hoy eai shorok poribohone sringkhola firaia ante shorok poribohon o malik shomiti gulir boro kisu netake cross fire e hotta kora uchit karon earai poribohon khate orajogota beporoa gari chalia manush hottakarider shajar biruddhe andolon kore eai desher manushke o shorkarke jimmi kore felese, ayneo tader kisu kora jaina karon tara takar jore shorkari rajnitir moshnode boshe shob ayn olot palot kore dei,era khuni o khoner modod data...
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন