শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসা বাণিজ্য

বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে বাধার সম্মুখীন নারী উদ্যোক্তারা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০২০, ৮:৪৫ পিএম

বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় নারী উদ্যোক্তারা বেশি বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য ও নারীর সুনির্দিষ্ট প্রতিবন্ধকতাগুলো খুঁজে বের করতে গবেষণা পরিচালনা করেছে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)। রোববার (১৯ জানুয়ারি) রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ‘চ্যালেঞ্জেস অব ট্রেডিং অ্যাক্রস বর্ডারস ফেসিং দ্য উইমেন ট্রেডারস অব বাংলাদেশ: রিসেন্ট ফাইন্ডিংস অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস অডিট, মডার্নাইজেশন অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের সদস্য খন্দকার মুহাম্মদ আমিনুর রহমান। ডিএফআইডি বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট এডভাইজার মাশফিক ইবনে আকবর এতে বক্তব্য রাখেন। সূচনা বক্তব্য রাখেন আইএফসির প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিস্ট নুসরাত নাহিদ ববি।

বিল্ডের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি ও রফতানি সংক্রান্ত সনদ সংগ্রহ ও নবায়ন করতে পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় নারী উদ্যোক্তাদের বেশি ব্যয় বহন করতে হয়। বেশিরভাগ নারী উদোক্তাই নিজে অথবা তাদের কর্মীদের মাধ্যমে সনদ সংগ্রহ করেন। নিজে বা কর্মীদেও মাধ্যমে সনদ সংগ্রহে ব্যর্থ হলে তারা আইনজীবী বা পেশাদার প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা গ্রহণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে পুরুষ উদ্যোক্তারা সাধারণত দালালের শরণাপন্ন হন। ঋণপত্র (এলসি), নগদ সুবিধা ও জিএসপি সনদ পেতে নারী উদ্যোক্তাদের সাধারণত পুরুষের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়।

প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে বিল্ডের গবেষণা প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ আনা হয়। এতে যেসব সুপারিশ আনা হয় তার মধ্যে রয়েছে, সনদপ্রাপ্ত এবং যোগত্য সম্পন্ন আইনজীবী ও পেশাদারদের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা ও এসএমইদের সেবা প্রদান করা, নারীদের জন্য এলসি খোলার প্রক্রিয়া সহজ করা, নগদ সুবিধা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ করা, সক্ষমতা তৈরি, প্রচ্ছন্ন ব্যয় (হিডেনচার্জ) বন্ধ করা, লিড টাইম কমানো, সিজনাল ফিন্যান্সিং ত্বরান্বিত করা, নারী উদ্যোক্তাদের গ্যারান্টরের সংখ্যা কমানো, নারীদের জন্য সক্রিয় হেল্প ডেস্ক চালু করা, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেও কাছ থেকে সহযোগিতামূলক আচরণ, বন্ড লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ করা, এইচএস কোড সংক্রান্ত সমস্যা দূর করতে নতুন এইচএস কোড চালু করা ও কাস্টম কর্মকর্তাদের জ্ঞানস্বল্পতার বিষয়টিকে বিবেচনায় নেয়া।

স্বাগত বক্তব্যে বিল্ডের প্রধান নির্বাহী ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও অর্থনীতিতে নারীদের অবদান বাড়ানো পয়োজন। অন্যদিকে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে অনানুষ্ঠানিক খাতে নারীদের অবদান সবচেয়ে বেশি, যা কিনা প্রায় ৯২ শতাংশ। অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়াতে হলে নারী শ্রমশক্তিকে ফরমালাইজ করতে হবে।

সূচনা বক্তব্যে আইএফসির প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিস্ট নুসরাত নাহিদ ববি বলেন, বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী নারীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় বিশেষ হেল্প ডেস্ক থাকলেও সেগুলোতে হালনাগাদ তথ্য তেমন পাওয়া যায় না। বিল্ড এবং আইএফসি যৌথভাবে নারী উদ্যোক্তাদের সমস্যাগুরো চিহ্নিত ও সেগুলোর সমাধানের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে ইচ্ছুক। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে বিভাগীয় পর্যায়েও এ ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে এনবিআরের কাস্টমস অডিট, মডার্নাইজেশন অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের সদস্য খন্দকার মুহাম্মদ আমিনুর রহমান বলেন, দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের চাওয়া অনুযায়ী হয়তো বাড়ছে না। যেসব জায়গায় নারী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ রয়েছে আমাদের উচিত সেসব দিকে নজর দেয়া এবং তাদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদান করা। বিল্ড পরিচালিত সার্ভে প্রতিবেদনে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতার বথা উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইনডো (এনএসডব্লিউ) চালু করলে এসব সমস্যা পুুরোপুরি দূর হয়ে যাবে। কেননা এর মাধ্যমে ৩৯টি বিভাগে অবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করবে। বর্তমানে নারী উদ্যোক্তারা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন পেপারলেস এনভায়রনমেন্টে এগুলি একদমই থাকবে না।

তিনি বলেন, নারীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন ই-পেমেন্ট চালু হলে এগুলো পুরোপুরি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু ই-পেমেন্ট জনপ্রিয় করা খ্বুই কঠিন কাজ। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ই-পেমেন্টে আগ্রহী হলেও ছোটখাট আমদানিকারকরা ই-পেমেন্টে যেতে চাচ্ছে না। চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে চালু হতে যাচ্ছে প্রি-অ্যারাইভাল প্রসিডিউর (পিএপি)। এটি চালু হয়ে গেলে মাল এসে পোর্টে পৌঁছানোর আগেই রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সম্পন্ন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সময় অনেক বেঁচে যাবে। কাস্টমসে ১২-১৫ শতাংশ পণ্যের নিরীক্ষা কোনোভাবেই কাঙ্খিত নয়। এটাকে ২-৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।

ডিএফআইডি বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট এডভাইজার মাশফিক ইবনে আকবর বলেন, বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করা জরুরি। তিনি অবহিত করেন, নন-ট্র্যাডিশনাল খাতের সনদের মানের বিষয়ে আমাদের আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

প্যানেল আলোচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শরীফা খান বলেন, আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষ কোনো তফাৎ রাখা হয়নি। তারপরও কেনো নারীদের বিভিন্ন সনদ পেতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কারণ তাদের কাছে সবসময় পর্যাপ্ত ও হালনাগাদ তথ্য থাকে না। তিনি অবহিত করেন যে, আরজেএসসি বর্তমানে সম্পূর্ণ অটোমেশনে চলে গেছে। যার সুফল উদ্যোক্তারা সহজে পেতে পারেন। নারীদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন বেশি ব্যয় বহন করতে হয় তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সবার জন্য সমান ব্যয় হবে, এটিই স্বাভাবিক হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে মালামাল গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত প্রতিটি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে নারীদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি অবহিত করেন যে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অথোরাইজেশন পাওযার ক্ষেত্রে যাতে সমস্যা না হয় সেজন্য সচিবালয়ে ঢোকার মুখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে নারী উদ্যোক্তারা সচিবালয়ে না ঢুকেও এ অথোরাইজেশন পেতে পারে।

সিসিআইঅ্যান্ডই কার্যালয়ের চিফ কন্ট্রোলার প্রাণেশ রঞ্জন সূত্রধর বলেন, ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে আমরা ম্যানুয়াল পদ্ধতি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। আইএফসির সহযোগিতায় আমরা এখন অনলাইনে সনদ প্রদান করছি। ম্যানুয়ালে যেখানে সনদ পেতে তিন দিন লাগতো, সেখানে এক ঘন্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সনদ প্রদান করা হচ্ছে। নবায়নের ক্ষেত্রে সময় আরো কম লাগছে। এছাড়া সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় যেসব কাগজপত্রের প্রয়োজন ছিল সেগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সনদপ্রাপ্তির ধাপগুলোও কমিয়ে আনা হয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বন্দর) আবদুস সাত্তার শেখ বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নারীরা বন্দরগুলোতে কি কি বাধার সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো লিপিবদ্ধ করে আমাদের কাছে দেয়া হলে আমরা সমাধানের যথাযথ চেষ্টা করবো।

মুক্ত আলোচনা শেষে গ্রুপ ডিসকাশনে অংশগ্রহণকারীরা কনসাইনমেন্ট ক্লিয়ারেন্স প্রসিডিউরস, অবটেইনিং লাইসেন্স/ পারমিটস/ সার্টিফিকেটস, একেসেস টু ইনফরমেশন ও আইসিটি স্কিল শীর্ষক চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তাদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা সুনির্দিষ্টভাবে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন সেগুলো তুলে ধরে তার সমাধানের জন্য সুপারিশ করেন।

এনবিবারের কমিশনারের হোসেন আহমেদ বলেন, বিএসটিআই’র ল্যাব উদ্যোক্তাদের পরিপূর্ণ সমাধান দিতে পারে না। ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের বিভিন্ন ল্যাবরেটরির থেকে পণ্যের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। এসব পরীক্ষায় এ একেক ল্যাবরেটরিতে একেক রকম ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়া এইচএস কোডের ক্ষেত্রেও আমাদের বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।

অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের উদ্দেশে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিল্ডের সিইও ফেরদৌস আরা বেগম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন