শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি

টিআইবির সিপিআই-২০১৯ প্রকাশ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড। আর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির দেশ হিসেবে উঠে এসেছে সোমালিয়ার নাম। বৈশ্বির দুর্নীতি এনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম। যা আগের চেয়ে উন্নতি। গতকাল সিপিআই ২০১৯ বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয় মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ সময় বলা হয় বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০১৯ এ সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থানের এক ধাপ উন্নতি হয়েছে। তবে স্কোর ২৬ অপরিবর্তিত রয়েছে। বৈশ্বিক গড় স্কোরের ৪৩ তুলনায় এবারও বাংলাদেশের স্কোর যেমন অনেক কম, তেমনি গতবারের মতই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থানে থাকায় দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এখনো উদ্বেগজনক।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম প্রমূখ।

বৈশ্বিক দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৯ সালের সিপিআই অনুযায়ী ৮৭ স্কোর পেয়ে যৌথভাবে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড। ৮৬ স্কোর পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড এবং ৮৫ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থানে যৌথভাবে রয়েছে সিংগাপুর, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড। আর সর্বনিম্ন ৯ স্কোর পেয়ে গতবারের মত এবারও তালিকার সর্বনিন্মে অবস্থান করছে সোমালিয়া। ১২ স্কোর নিয়ে নিন্মক্রম অনুযায়ী দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দক্ষিণ সুদান এবং ১৩ স্কোর পেয়ে তালিকার তৃতীয় সর্বনিন্মে আছে হিসেবে সিরিয়া।

সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে জানানো হয়, ২০১৯ সালের সিপিআই অনুযায়ী বৈশি^ক দুর্নীতি পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এবারের বৈশি^ক গড় স্কোর ৪৩ হলেও সূচকে অন্তর্ভুক্ত ১৮০টি দেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দেশই ৫০ এর কম স্কোর পেয়েছে। এর মধ্যে ৬০টি দেশের স্কোরের উন্নতি হলেও এবার স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে ৫২টি এবং উদ্বেগজনকভাবে স্কোর কমেছে ৬৮টি দেশের। এবারের সিপিআই অনুযায়ী ৬৮ স্কোর এবং সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী গতবারের মতই ২৫তম অবস্থান নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান। এর পরের অবস্থানে ৪১ স্কোর নিয়ে গতবারের তুলনায় দুই ধাপ অবনতি হয়ে ৮০তম স্থানে রয়েছে ভারত। এরপরে শ্রীলংকা ৩৮ স্কোর পেলেও ৪ ধাপ পিছিয়ে ৯৩তম অবস্থানে রয়েছে। ৩২ স্কোর পেয়ে তিন ধাপ পিছিয়ে ১২০তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান অন্যদিকে; ২০১৮ এর তুলনায় ২ পয়েন্ট কম ২৯ স্কোর পেয়ে ৬ ধাপ পিছিয়ে ১৩০তম অবস্থানে নেমে গিয়েছে মালদ্বীপ। এরপর ২০১৮ এর সমান স্কোর ২৬ পয়েন্ট নিয়ে ১৪৬তম অবস্থানে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের পরে ১৬ স্কোর পেয়ে সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী ১৭৩তম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ সিপিআই সূচক অনুয়ায়ী ২০১২ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর মধ্যে সপ্তমবারের মত এবারও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের সিপিআই-এর নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৪তম অবস্থানে ছিল।

নির্ণয়ন পদ্ধতির ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষতা ও সূচকের সহজীকরণের জন্য টিআই ২০১২ সাল থেকে নতুন স্কেল ব্যবহার শুরু করে। ১৯৯৫ সাল থেকে ব্যবহৃত ০-১০ এর স্কেলের পরিবর্তে দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ২০১২ সাল থেকে ০-১০০ এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে স্কেলের ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়। যে দেশগুলো সূচকে অন্তর্ভুক্ত নয় তাদের সম্পর্কে এ সূচকে কোনো মন্তব্য করা হয় না। সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশই এখন পর্যন্ত সিপিআই-এ শতভাগ স্কোর পায়নি। অর্থাৎ, দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বনিম্ন এমন দেশগুলোতেও কম মাত্রায় হলেও দুর্নীতি বিরাজ করে।

২০১৯ সালে ০-১০০ স্কেলে গতবারের সমান ২৬ স্কোর পেয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম; যা ২০১৮ এর তুলনায় ১ ধাপ উন্নতি এবং সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী ১৪৬তম; যা ২০১৮ এর তুলনায় ৩ ধাপ উন্নতি। এবার সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থানের খানিকটা উন্নতি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবি’র গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআই- এ প্রেরণ করা হয়না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতই টিআইবিও দুর্নীতির ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র। সিপিআই ২০১৯ এর জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গতবারের মতই তথ্যসূত্র হিসেবে ৮টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলো হলো: বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে,গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস্, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস এবং ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্র্যাসি প্রজেক্ট ডেটাসেট এর রিপোর্ট।

সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, সিপিআই সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে অনেক সময় ‘বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত বা বাংলাদেশের অধিবাসীরা সবাই দুর্নীতি করে’ এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। যদিও দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ- সর্বোপরি, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায়, তথাপি বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না।

এসময় অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ব্যবহার হচ্ছে কোথায়, কার ভোগে যাচ্ছে, সেটা সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কী না তা দেখতে হবে। দুর্নীতি না থাকলে আমাদের আরো উন্নতি হতো। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে এটা যেমন সত্য ও গৌরবের; তেমনি এই অগ্রগতি আরো তরান্বিত হতো, আরো সুষম ও টেকসইভাবে হতে পারতো যদি আমরা কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্কোর আরো ভালো প্রত্যাশা ছিল উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, অভিযানকে কেন্দ্র করে প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। বাস্তবে কথিত ‘গডফাদার’দের বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে এক ধরনের শঙ্কা, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের ঘাটতি, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শুদ্ধাচারের ঘাটতি বিশেষ করে রাজনৈতিক অর্থায়নে শুদ্ধাচার ও স্বচ্ছতার ঘাটতি, অর্থপাচার ও ব্যাংকিংখাতে দুর্নীতির ক্ষেত্রে আলোচিত মূল হোতাদের বিচারের আওতায় আনতে না পারার কারণে সূচকে আমাদের অবস্থান আরো ভালো হয়নি। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মত ও তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি সকল অন্তরায় যতদিন অব্যাহত থাকবে ততদিন দুর্নীতি বিকশিত হবে, এটাই স্বাভাবিক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন