শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

‘জঙ্গির অর্থদাতা’ অপবাদে খুন!

আবু মুছার সাথে নবীও হাওয়া

প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম ব্যুরো : ‘জঙ্গির অর্থদাতা’ এমন অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে। মূল হোতা কামরুল সিকদার ওরফে আবু মুছা হত্যা মিশনের অপর সদস্যদের কাছে মিতুকে জঙ্গির অর্থদাতা হিসেবে উপস্থাপন করে। এদিকে পুলিশের দাবি অনুযায়ী আলোচিত এ হত্যা মামলার প্রধান আসামি মুছা এখন হাওয়া। সেইসাথে গায়েব হত্যা মিশনের অপর সদস্য নবীও।
অপরদিকে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবিরোধী সফল অভিযানের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে কেন এমন অপবাদ-তা খতিয়ে দেখলেই হত্যাকা-ের মূল রহস্য উদ্ঘাটন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। হত্যার নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে পুলিশের কোনো কোনো কর্মকর্তা এমন ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করলেও যারা খুন করেছে তারা বলছে ভিন্ন কথা। মোটা অংকের টাকা কিংবা অন্য কোনো প্রলোভন নয়, মিতু জঙ্গিদের অর্থদাতা তাই তাকে সরিয়ে দিতে হবে এমন পরিকল্পনা ছিল খুনিদের।
কিলিং স্কোয়াডের দুই সদস্যের জবানবন্দিতে এমন তথ্য বের হয়ে এসেছে। হত্যাকা-ের মূল হোতা কামরুল শিকদার ওরফে আবু মুছা কিলিং স্কোয়াড সদস্যদের বলেন, ওই মহিলা জঙ্গির অর্থদাতা, তাকে খুন করতে হবে। খুনি চক্রের কোনো সদস্যই মিতুকে চিনতো না। তার পরিচয়ও তাদের কাছে অজানা ছিল।
মুছা খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠে যে, মিতুকে খুন করতে না পারলে উল্টো তাদের (কিলারদের) খুন করারও হুমকি দেয় সে।  
মিতু হত্যা মামলায় গ্রেফতার ওয়াসিম তার জবানবন্দিতে স্বীকার করে ঘটনার বেশ কয়েক দিন আগে তারা জিইসি এলাকায় বাবুল আক্তারের বাসার আশপাশের এলাকা ঘুরে আসে। সেদিন সকাল ছয়টায় তারা জিইসি মোড়ে যায়। তারা দেখে এক নারী একটি বাচ্চাকে স্কুলগাড়িতে তুলে দিয়ে চলে যাচ্ছেন। তখন মুছা তাকে বলেন, ‘ওই দেখ, মহিলা (মাহমুদা) জঙ্গির অর্থদাতা। সে সারা ওয়ার্ল্ডে যায়।’ পরে তারা কালামিয়া বাজারে চলে আসে। ঘটনার চার/পাঁচ দিন আগে মুছা নবীকে বলেন, ‘ওই মহিলাকে মারতে পারবি?’ নবী রাজি হয়।
ওয়াসিম ও আনোয়ার তাদের জবানবন্দিতে আরও বলেছে খুন করার আগ পর্যন্ত মুছা ছাড়া আসামিদের আর কেউ মাহমুদার পরিচয় জানত না। হত্যাকা-ের পর টেলিভিশন দেখে মাহমুদার পরিচয় জানতে পারে তারা। খুনের পর বাসায় যাওয়ার পর ওয়াসিম টেলিভিশনের খবরে দেখতে পায় যে, নারীকে তারা খুন করেছে, তিনি পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গে মুছাকে ফোন করে ওয়াসিম। তখন মুছা ফোনে ধমক দিয়ে বলেন, ‘চুপ থাক। বেশি কথা বললে তোকেও মার্ডার কেইসে ঢুকাইয়া দিব।’ দুই আসামির জবানবন্দি অনুযায়ী, তারা কিছুই জানতো না, মিতুকেও চিনতো না। সবকিছু জানে মুছা। তারা মুছার নির্দেশ পালন করেছে মাত্র। মাহমুদার খুনে অংশ নেওয়া সবাইকে মুছা হুমকিও দেয় কাউকে কিছু না বলার জন্য। জবানবন্দিতে ওয়াসিম স্বীকার করে, ‘আমাদের ভয় দেখায় মুছা, কাউকে বললে বা ওই নারীকে না মারলে মেরে ফেলবে।’ আনোয়ার জবানবন্দিতে আরও জানায়, খুনের পর রক্তাক্ত লাশ রাস্তায় পড়ে থাকার দৃশ্য দেখে তার মায়া হয়, কিছুটা খারাপও লাগে।
৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় নগরীর জিইসি মোড়ের অদূরে ও আর নিজাম রোডে গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। হত্যাকা-ের পর তার স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে এই মামলার আসামি ওয়াসিম, আনোয়ার, অস্ত্র সরবরাহকারী ভোলা ও তার সহযোগী মনিরকে গ্রেফতার করে। এখনো পলাতক রয়েছে হত্যাকা-ে অংশ নেওয়া মুছাসহ পাঁচ আসামি।
মুছা-নবী গায়েব
দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এ মামলার মূল হোতা মুছা ও তার সহযোগী নবী গায়েব হয়ে গেছে। দু’জনের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেছে। মুছার স্ত্রী পান্না আকতারের অভিযোগ, ২২ জুন নগরীর বন্দর থানার বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তিনি আরও জানান, পুলিশ মুছাকে ধরার জন্য তাদের বাসায় যখন যায় তখন পুলিশের সাথে ছিল মুছার বন্ধু নবী। তখন মুছা বাসায় ছিল না। পান্নার ফোন থেকে নবী মুছার সাথে কথা বলে তাকে বাসায় ডেকে আনে। এরপর পুলিশ মুছা ও নবীকে নিয়ে যায়। তবে পুলিশ এ দু’জনকে গ্রেফতারের কথা বরাবরই অস্বীকার করেছে। পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার বলছেন, মুছা ও নবীকে তারা গ্রেফতার করেননি। ফলে এ দু’জনের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অনেকের ধারণা মিতু হত্যা মামলার আসল রহস্য চাপা দিতেই মূল হোতা মুছা ও তার সহযোগীকে গায়েব করা হয়েছে।
মামলার আইও বলছেন, মুছাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে হত্যাকা-ে জড়িত কালু, রাশেদ, নবীকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। মুছাকে আটকের পর গুম করা হয়েছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (দক্ষিণ) মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, গত রাতেও আমরা নগরী এবং জেলার বিভিন্ন স্থানে মুছাসহ কিলারদের খোঁজে অভিযান চালিয়েছি। আমাদের তিনটি টিম তাদের গ্রেফতারে কাজ করছে। খুব শিগ্গিরই মুছাসহ কিলারদের গ্রেফতার করতে পারবো বলে আশা করছি।
তদন্ত ভিন্নখাতে নেয়া হচ্ছে : বিবিসি বাংলাকে এসপি বাবুলের শ্বশুর
বাংলাদেশে স্ত্রী হত্যার মামলায় পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতারকে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনা এবং তদন্ত নিয়ে তাঁর পরিবার প্রশ্ন তুলেছে। তাঁর শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তদন্ত অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে এখন তারা মনে করছেন।
মোশাররফ হোসেন আরও বলেছেন, “আমার মেয়ে হত্যার বিচার আমি চাই। আমার মেয়ে কোনো চাকরি বা ব্যবসা করতো না। কিন্তু পুলিশের তদন্তকারীরা হত্যাকা-ের তদন্তের মূল জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে বা এড়িয়ে যাচ্ছে। তদন্ত ডাইভার্ট করা হচ্ছে বা অন্যদিকে নেয়া হচ্ছে। কেন এটা করা হচ্ছে, সেটাই আমাদের প্রশ্ন।”
স্ত্রী মাহমুদা খানমের হত্যাকা-ের পর থেকে বাবুল আকতার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় তাঁর শ্বশুর বাড়িতে থাকছেন। তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন সাবেক পুলিশ পরিদর্শক। গত শুক্রবার বাবুল আকতারকে গোয়েন্দা পুলিশের দপ্তরে নিয়ে প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। এরপর নানান প্রশ্ন উঠলেও পুলিশের পক্ষ থেকে এখনও পরিষ্কার কোন বক্তব্য দেয়া হয়নি। তবে সংবাদ মাধ্যমে বাবুল আকতারের পুলিশে থাকা না থাকার বিষয়েও নানান ধরনের খবর প্রকাশ হচ্ছে।
তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে বাবুল আকতার তাঁর সাথে কোন কথা বলেননি।তিনি পত্রিকায় দেখেছেন যে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় বাবুল আকতারের কাছ থেকে জোর করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। এসব খবর সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। কিন্তু বাবুল আকতার স্ত্রী হত্যায় জড়িত থাকতে পারেন, এটা তাঁরা বিশ্বাস করেন না বলে মোশাররফ হোসেন উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, তিনি হত্যাকা-ের মূল বিষয়ে সঠিক তদন্ত চান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন